হাজারীবাগে এখনও সরব ট্যানারি
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করে রাজধানীর হাজারীবাগে চালু থাকা সব ট্যানারি অবিলম্বে বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে সব ট্যানারি থেকে গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) করা আবেদনের শুনানি শেষে গত ৭ মার্চ বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. সেলিমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন, যা গত ১২ মার্চ প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে তিন সদস্যের আপিল বেঞ্চ বহাল রাখেন।
আদালতের এমন আদেশের পরও আগের মতোই স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছে হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোতে। কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ, গ্রেডিং, ফিনিশিং, কেমিক্যাল দিয়ে ওয়েট ব্লু প্রক্রিয়াজাত করার পর ভেজা চামড়া শুকানোসহ চামড়া পাকা করার সব প্রক্রিয়াই চলছে হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোতে।
সোমবার হাজারীবাগের ট্যানারি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, হাজারীবাগের রাস্তা দিয়ে পিকআপ ভ্যান ও ঠেলাগাড়ি বোঝাই করে চামড়া ট্যানারির কারখানাগুলোতে আনা-নেয়া করা হচ্ছে। অধিকাংশ কারখানারই প্রধান গেট বন্ধ রেখে ভিতরে কাঁচা চামড়া পাকা করার সবধরনের কার্যক্রম চলছে। বরাবরের মতো ট্যানারি এলাকায় প্রচণ্ড দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ট্যানারির ময়লায় ড্রেনের পানি কালো ও বাদামি রঙ ধারণ করেছে। ক্রিসেন্ট ট্যানারির সামনে গিয়ে দেখা যায়, কারখানাটির সামনের রাস্তায় প্রাথমিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া চামড়া ঠেলাগাড়ি বোঝাই করে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে কিছু শ্রমিক ওই চামড়া মাথায় করে কারখানার ভিতরে নিয়ে যাচ্ছেন।
কৌশলে কারখানাটির ভিতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, সেখানে প্রাথমিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া ভেজা চামড়া বিভিন্ন মেশিনের মাধ্যমে পাকা চামড়ায় রূপান্তর করা হচ্ছে। বাইরে থেকে চামড়া সাদা রঙের আসলেও কারখানার ভিতরে মেশিনের মাধ্যমে কেমিক্যাল ব্যবহার করে সেই চামড়া কালো, লাল, গোলাপি, সবুজসহ বিভিন্ন রঙে রূপান্তর করা হচ্ছে।
কারখানাটির এক শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আগে কারখানায় যেসব কাজ করা হতো এখনও তার সবগুলোই করা হচ্ছে। কিন্তু ভিতরে অপরিচিত কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। মালিকপক্ষ আমাদের বলেছেন কাজ চালিয়ে যেতে। কোনো সমস্যা হবে না। আয়ুব ব্রাদার্স ট্যানারির শ্রমিক মো. হারুন জানান, কাঁচা চামড়া প্রাথমিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ভেজা অবস্থায় কারখানায় আনা হয়। এরপর বিভিন্ন মেশিনের মাধ্যমে তা পাকা চামড়ায় রূপ দেয়া হয়। চামড়ায় বিভিন্ন কালার (রঙ), শুকানো, মোলায়েম, আয়রন করার সব কাজই করা হয় মেশিনের সাহায্যে।
গ্রেইট ইস্টার্ন ট্যানারির ভিতরে গিয়ে দেখা যায়, কারখানাটির ভিতরের একপাশে কাঁচা চামড়া স্তূপ করে রাখা হয়েছে। পাশেই কিছু শ্রমিক কাজ করছেন। এদের একজন মো. বাদল। তিনি হ্যান্ড স্লাইজিংয়ের(একজাতীয় ছুরি) সাহায্যে কাঁচা চামড়া থেকে নরম অংশ তুলে ফেলার কাজ করছিলেন।
চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করা এই শ্রমিক বলেন, আমি ২৭ বছর ধরে ট্যানারি কারখানায় কাজ করি। কারখানাগুলোতে আগের মতোই সব কাজ চলছে। তবে কাজের চাপ কিছুটা কম। গত মাসে হ্যান্ড স্লাইজিংয়ের কাজ করে মাসে ২০ হাজার টাকার মতো আয় হয়েছে। সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরিত হলে কি করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার দুই মেয়ে কলেজে পড়ে। এক ছেলে ও এক মেয়ে স্কুলে পড়ে। তাদের পড়ালেখার খরচ এবং সংসার খরচ সবই চলে আমার আয়ের ওপর। সুতরাং কাজ করতেই হবে।
ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক বলেন, আদালতের রায়ের বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। আদালত যেহেতু রায় দিয়েছেন সুতরাং হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি অবশ্যই হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্প নগরে স্থানান্তরিত হবে। তবে হাজারীবাগে এখনও ট্যানারির কার্যক্রম চলছে। ‘হেমায়েতপুরে ট্যানারি পুরোপুরি স্থানান্তরিত হলে শ্রমিকরাও সেখানে কাজ করতে যাবেন। শ্রমিকদের কাজ না করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ কাজ না করলে মালিকরা শ্রমিকদের বকেয়া বেতন দেবেন না। অনেক কারখানায় শ্রমিকদের টাকা আটকে আছে’- বলেন আব্দুল মালেক। এই শ্রমিক নেতা জানান, হেমায়েতপুরে কোনো প্রতিষ্ঠানই পুরোপুরিভাবে কার্যক্রম শুরু করেনি। যারা ওখানে কাজ করছেন তারা সর্বোচ্চ ওয়েট ব্লু পর্যন্ত করছে। কাঁচা চামড়া পাকা করার ক্ষেত্রে ওয়েট ব্লু হওয়া মানে ২৫ শতাংশের মতো কাজ সম্পন্ন হওয়া। অর্থাৎ চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের ৭৫ শতাংশ কাজ এখনও হাজারীবাগেই হচ্ছে।
সার্বিক বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, সব প্রতিষ্ঠানই সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে ওয়েট ব্লু কাজ করার মোটামুটি প্রস্তুতি নিয়েছে। এখন ক্রাস্ট ফিনিশিংয়ের জন্য আমাদের তিন-চার মাস সময়ের ব্যাপার। আমরা কোর্টে ওই সময়টিই চেয়েছিলাম। কিন্তু কোর্ট তো তা রিজেক্ট করে দিয়েছে। আমাদের প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলারের রফতানি আদেশ এখন পেন্ডিং আছে। সাভারে এখনও গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়নি। সুতরাং হাজারীবাগে প্রডাক্টশন বন্ধ করে দিলে ওইখানে আমরা উৎপাদন করতে পারব না।
তিনি বলেন, আমরা যতটুকু জানি ট্যানারি কারখানাগুলোতে সপ্তাহখানেকের মধ্যে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হবে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দিলে আমরা সাভারে চলে যাব। তবে সেখানে যে অবস্থা তাতে উৎপাদন অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না।
এমএএস/ওআর/এমএস