গৃহবধূ থেকে চিকিৎসক হওয়ার গল্প
‘বাবা ছিলেন মাদরাসার মাওলানা। মসজিদে ইমামতিও করতেন। অষ্টম শ্রেণি পাস করে নবম শ্রেণিতে ওঠার পর পরই গ্রামের মানুষ বলাবলি শুরু করে মাওলানা কেন মেয়ের পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছেন, এখনও কেন মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছেন না। মেয়ের পড়াশুনা বন্ধ না করলে মাওলানাকে ইমামতি থেকে বাদ দেয়া হবে।’
‘সামাজিক চাপে মাওলানা বাবা পড়াশুনা বন্ধ করে দেন। কয়েক মাসের মধ্যে পাত্র খুঁজে বিয়েও দেন। ভুলেও তখন ভাবিনি আবার পড়াশুনা শুরু করতে পারব। শুধু মনে মনে দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে বলতাম, হে আল্লাহ তুমি আমাকে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দাও। স্বামীর উছিলায় আল্লাহ সেই ডাক কবুল করেছিলেন।’
বিয়ের পর শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে স্ত্রীকে এসএসসি পর্যন্ত পড়াশুনা করাতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। মেয়ের জামাতা যে যুক্তি দিয়ে তার মেয়েকে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে বলেছিলেন সেই যুক্তি মেনে নিয়েছিলেন কিন্তু খেসারত হিসেবে মসজিদে নামাজে ইমামতি ছেড়ে দিতে হয়েছিল বাবাকে। ৯ মাস বন্ধ থাকার পর আবার স্কুলে ভর্তি। স্কুল ও কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তি।এরপর বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ।’
নাটক বা সিনেমার গল্পের মতোই পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া সদরের এক গৃহবধূ থেকে চিকিৎসক হয়ে ওঠা জীবনের গল্প শুনাচ্ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) সমন্বয়ক ডা. বিলকিস বেগম।
গত এক দশকেরও বেশি সময় তিনি নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রাম বায়োলেন্স এগেইনস্ট উইম্যান প্রকল্পাধীন ওসিসিতে চাকরি করছেন। প্রতি বছর শত শত নির্যাতিতা মেয়ের চিকিৎসাসেবা, আইনি সহায়তা, কাউন্সিলিংসহ সব ধরনের সহায়তা প্রদানে সুনামের সঙ্গে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন। ৯ম শ্রেণিতে যে গৃহবধূর পড়াশুনা বন্ধ হয়েছিল সেই গৃহবধূ নিজে তো সফল চিকিৎসক হয়েছেনই তদোপরি তিন সন্তানের মধ্যে দুই ছেলেমেয়েকে ইতোমধ্যেই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছেন।
বুধবার ৮ মার্চ আর্ন্তজাতিক নারী দিবস। এ দিবসের প্রাক্কালে মঙ্গলবার ওসিসিতে এক সাক্ষাৎকারে ডা. বিলকিস বেগম তার জীবনের গল্প শুনাচ্ছিলেন। স্বামীর পর চিকিৎসক হয়ে ওঠার পেছনে মা ও বড় ভাইয়ের অবদানের কথা শ্রদ্ধাচিত্তে স্মরণ করেন। মেয়েকে পড়াশুনার সুযোগ করে দিতে দুই নাতি-নাতনিকে কোলে করে মানুষ করেছেন বাবা। আর বড় ভাই যিনি নিজেও ডাক্তার, তিনি বোনকে মেডিকেলে পরীক্ষা দেয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা করেছেন।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ডা. বিলকিস বেগম বলেন, মায়ের সুপ্ত বাসনা ছিল মেয়েকে ডাক্তারি পড়াবেন। কিন্তু তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা ও বাবা মাওলানা হওয়ায় অষ্টম শ্রেণির পর পড়াশুনা করানোর কথা বলতে সাহস করেননি। কিন্তু জামাতা যখন তাদের মেয়ের পড়াশুনা চালিয়ে যেতে আগ্রহ দেখান তখন মেয়েকে সর্বাত্মক সহায়তা করেন তারা।
ডা. বিলকিস জানান, ১৯৭৬ সালের আগস্টে তার বিয়ে হয়। পরবর্তীতে স্বামীর অনুপ্রেরণায় ১৯৭৮ সালে ছয় বিষয়ে লেটারসহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। মঠবাড়িয়া সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেয়ার সময় অন্তঃসত্ত্বা হন। এ অবস্থায় মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দেন। মেডিকেলের প্রথমবার লিখিত পরীক্ষায় টিকলেও ভাইভায় ( তার মতে প্রেগন্যান্ট হওয়ায় ) বাদ পড়েন। তবু হাল ছাড়েননি তার স্বামী। স্ত্রীকে উৎসাহ দিয়ে পরের বছর আবারও মেডিকেলে পরীক্ষা দিতে উৎসাহ দেন। এভাবেই তিনি বরিশাল মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পান।
ডা. বিলকিস বেগম বলেন, অনেকবার নিজে থেকেই পড়াশুনা না করার সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত করেছিলাম। ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে পড়াশুনা চালাতে মন চাইতো না। কিন্তু স্বামী, মা ও বড় ভাইয়ের উৎসাহে ডাক্তারি পাস করেন।
পরবর্তীতে দশম বিবিএস দিয়ে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন। তিনি জানান, তার স্বামী নিজেও মাওলানা। তবে তিনি ছিলেন প্রগতিশীল ও আধুনিকমনা। বর্তমানে তিনি কমলাপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষকতা করছেন।
কি কারণে স্ত্রীকে চিকিৎসক হতে উৎসাহ দিয়েছিলেন তা জানতে চাইলে ডা. বিলকিস বেগম জানান, এক সময় তার স্বামী খুলনায় পড়াশুনা করতেন। ওখানে এক ভদ্র মহিলার স্বামীর মৃত্যুর পর অর্থাভাবে তাকে দেহ ব্যবসায় নামতে দেখেছিলেন। মেধাবী হয়েও পড়াশুনা না করলে নারীদের যে বিপদে পড়তে হয় তা স্বচক্ষে দেখে তিনি স্ত্রীকে পড়াশুনায় মনোযোগী ও প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেন।
আগের তুলনায় বর্তমানে সমাজে নারীদের অবস্থান অনেক ভালো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সমাজের সার্বিক উন্নয়নে নারী-পুরুষের সমঅংশগ্রহণ জরুরি। নারীকে সামনে এগিয়ে যেতে পুরুষদের সহযোগিতা খুবই প্রয়োজন।
এমইউ/এএইচ/এমএস