নিজেকে নারী নয় মানুষ মনে করি
সভ্যতার বিকাশে প্রাচীন আমলের তুলনায় বর্তমানে নারীর অবস্থানে আমূল পরিবর্তন এসেছে। এখন নারীদের ওপর শারীরিক নির্যাতন কমলেও থামেনি মানসিক নির্যাতন। এগিয়ে চলার পথে নারীর ওপর যে মানসিক চাপ রয়েছে তা কমাতে হবে। নিজেদের কোনো চাপে নতিস্বীকার করলে চলবে না। নিজেকে নারী নয়, ভাবতে হবে মানুষ।
আজ বিশ্ব নারী দিবস। ‘নারী-পুরুষের সমতায় উন্নয়নের যাত্রা, বদলে যাবে বিশ্ব, কর্মে নতুনমাত্রা’ স্লোগান যথোপযুক্ত মনে করছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের(ডিএমপি)ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তা ফেরদৌসী রহমান। ডিএমপির ট্রাফিক উত্তর বিভাগে বাড্ডা জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
রোববার বাড্ডায় নিজ কার্যালয়ে নারী দিবস উপলক্ষে জাগো নিউজকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে কর্মক্ষেত্রে নারীদের যোগ্যতা, বৈষম্য, পদায়ন, অধিকার ও মর্যাদার বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি। পাঠকদের উদ্দেশ্যে এর চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।
জাগো নিউজ : কেমন আছেন?
ফেরদৌসী রহমান : জ্বি ভালো আছি।ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নতি ও ট্রাফিক সচেতনায় আজ ভ্রাম্যমাণ আদালত চলছিল। অভিযান নিয়েই মূলত ব্যস্ত সময় যাচ্ছে।
জাগো নিউজ: ৮ মার্চ নারী দিবস। সার্বিক দিক বিবেচনায় নারীদের প্রতি বৈষম্য কি কমছে? আপনার কী মনে হয়?
ফেরদৌসী রহমান : নারীরা এখন বেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এখন শারীরিক নির্যাতন কমলেও মানসিক নির্যাতন বন্ধ হয়নি। পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার বেশ পরিবর্তন আসলেও সুযোগ ও পারিপার্শ্বিকতা নারীদের এগিয়ে নেয়ার পথে বাধা। এখনও পরিবার ও সমাজের অনেকেই মনে করেন নারীরা অযোগ্য। তাদের ঘরের কাজেই বেশি রাখতে ইচ্ছুক তারা।
জাগো নিউজ : নিজ বাহিনীতে নারীদের অবস্থাটা আপনি অবজার্ভ করতে পারছেন। পুলিশে নারীদের অগ্রগতি যদি বলতেন?
ফেরদৌসী রহমান : এক সময়তো পুলিশে নারীদের নিয়োগই ছিল না। তবে নারীদের নিয়োগ শুরু হওয়ার পর সরকারের আস্থার প্রতিদান দিয়ে চলেছে নারী পুলিশ সদস্যরা। নারীরা পুলিশে অসাধারণ ভালো করছে। পুরুষের তুলনায় নারীদের কর্মঘণ্টা কিন্তু এক সেকেন্ডও কম নয়। সমানতালে দায়িত্ব পালন করতে হয়। নারী ট্রাফিক কর্মকর্তারা বিশেষ করে নারী সার্জেন্টরা তো প্রশংসা পাওয়ার মতো দায়িত্ব পালন করে চলছেন। অনেক সময় সকাল ৮টা থেকে শুরু করে রাত ১০-১১ পর্যন্ত কাজ করতে হয়।
জাগো নিউজ : নারীদের সমঅধিকার ও মর্যাদা পাওয়ার ক্ষেত্রে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে আপনি কতোটা দায়ী করেন?
ফেরদৌসী রহমান : এখনও কর্মক্ষেত্র, পরিবার ও সমাজের প্রতিটা স্তরেই পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার মানুষ রয়েছে। অনেক নারীর মধ্যেও পুরুষকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে এগিয়ে রাখার প্রবণতা রয়েছে। যেসব নারী পিছিয়ে কিংবা যোগ্যতা ও মেধা থাকার পরও উঠে আসতে পারেননি খেয়াল করে দেখবেন তাদের এগিয়ে নেয়ার মতো কেউ নেই। বরং পেছন থেকে টেনে ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা তো অবশ্যই দায়ী।
জাগো নিউজ : মেধা কিংবা যোগ্যতার কারণে কি অবস্থানগত ও মর্যাদায় নারীরা পিছিয়ে যাচ্ছে?
ফেরদৌসী রহমান : যোগ্যতা ও মেধা নারীর যথেষ্ট রয়েছে। অসহযোগিতার কারণে নারীরা কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না। আমি নিজেকে নারী মনে না করে মানুষ মনে করি। ‘অন্য কেউ পারলে, আমিও পারব’ এ ধারণা এখনো সবার মধ্যে তৈরি হয়নি।
আমার কথাই ধরুন, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করেছি। বরিশাল বিএম কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স, মাস্টার্স শেষে বিসিএস দিয়ে পুলিশে যোগ দিয়েছি। ৩০তম বিসিএস দিয়ে আমি পিএসসি’র মেধা তালিকার দ্বিতীয় স্থান দখল করেছিলাম। নিজেকে নারী ভাবলে হয়তো সেটা নাও হতে পারতো।
পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘সমানে সমান’ মানসিকতা নিয়ে যদি নারীকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্র তৈরি করা হয় তাহলে প্রমাণ হবে নারীরা সত্যিই সমানে সমান।
জাগো নিউজ : দেশে নারীরা উদ্যোগী হচ্ছে। ব্যবসা, চাকরি, শিক্ষা, রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রে নারী উদ্যোগ আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃতি পেয়েছে। আপনি কীভাবে দেখছেন?
ফেরদৌসী রহমান : সব কিছুর মূলে মূল্যবোধ। নারীদের মধ্যে মূল্যবোধ জন্মেছে। দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য এখন নারীরাও উদগ্রীব। ব্যবসা, চাকরি, শিক্ষা, রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রে দেখবেন যেখানে নারীরা অংশীদারিত্ব পেয়েছে, দায়িত্ব পালন করছে- সেখানেই সফলতা এসেছে। এটা অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানচিত্রে বাংলাদেশকে এগিয়ে রাখছে। এ প্রাকটিসটা আরও বাড়াতে হবে।
জাগো নিউজ : এবারের নারী দিবসে নারীদের এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আপনার ব্যক্তিগত অভিমত যদি ব্যক্ত করেন।
ফেরদৌসী রহমান : সভা-সেমিনারে গলাবাজি তো কম হয় না। নারীর জন্য অনেক কর্মসূচি নেয়া হয়। দিন শেষে ঘরে ওই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার প্রতিফলন ঘটছে। তাই আগে নারী ও পুরুষের মধ্যে জিইয়ে থাকা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। নারীবাদী বলে কথা নয়, আমি বলবো মানবতার দাবি মানেই নারীকে এগিয়ে নেয়া। এক্ষেত্রে সবার আগে নারীদের সংশোধন হতে হবে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব জায়গা থেকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে।
জাগো নিউজ : ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু বলুন।
ফেরদৌসী রহমান : বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায়। ২০০০ সালে এসএসসি ও ২০০২ সালে এইচএসসি পাসের পর বাবার চাকরির সুবাদে বরিশালে যাওয়া। সেখানে বিএম কলেজে ইংরেজিতে অনার্স, মাস্টার্স। ৩০তম বিসিএস দিয়ে পুলিশে যোগদান। র্যা ব-২ এ দায়িত্ব পালন শেষে ট্রাফিক উত্তরের সহকারী কমিশনারের (প্রশাসন) দায়িত্ব পালন। এরপর গত ২০ জানুয়ারি বাড্ডা ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব শুরু। বাবা রূপালী ব্যাংকে, মা বিটিএসএলে কর্মরত। আর স্বামী চাকরি করেন একটি দূতাবাসে।
জাগো নিউজ : নারী দিবস উপলক্ষে শুভ কামনা, ভালো থাকবেন।
ফেরদৌসী রহমান : জাগো নিউজকেও ধন্যবাদ। আশা করছি জাগো নিউজও তাদের পাতায় নারীদের নিয়ে আলাদা কাজ করবে।
জেইউ/এমএমজেড/এমএস