ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

সর্বোচ্চ আদালতে সাত নারী বিচারপতি

প্রকাশিত: ০৪:২৮ পিএম, ০৭ মার্চ ২০১৭

এগিয়ে চলছে নারী, এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমান সমাজে নারী সেকালের বৃত্তের মধ্যে বন্দি নেই। সমাজ ব্যবস্থার আরোপিত শৃঙ্খল ভেঙে আত্মবিশ্বাসে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন তারা। শুধু ঘরেই নয়, এমন সব কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থেকে আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ় মনোবলের পরিচয় দিয়ে তারা অগ্রগতি ও উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন, যা শুধু নারীর অগ্রগতি নয় দেশের অর্থনীতির ভীত শক্ত ও মজবুত করছে।

দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে দক্ষতা, যোগ্যতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন সাত নারী বিচারপতি। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে দায়িত্ব পালন করছেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। অন্য ছয় বিচারপতি হাইকোর্ট বিভাগে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। তারা হলেন- বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি ফারাহ মাহবুব, বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ, বিচারপতি নাইমা হায়দার, বিচারপতি জিনাত আরা ও বিচারপতি কাশেফা হোসেন।

সর্বোচ্চ আদালতের শীর্ষ পর্যায়ে আসতে তাদের পার করতে হয়েছে নানা প্রতিকূলতা, বাধা-বিপত্তি। তবে সবকিছু জয় করে তারা এখন দেশের ও বিচার বিভাগের ইতিহাসের অংশ।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ইতিহাসে প্রথম নারী বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ২০১৭ সালের ৮ জুলাই অবসরে যাবেন। আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে শপথ নেয়ার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘অনুভূতি অনেক ভালো। আমি আমার কাজের স্বীকৃতি পেয়েছি। প্রথম নারী বিচারক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলাম। হাইকোর্টেও প্রথম বিচারপতি হিসেবে এসেছিলাম। এবার আপিল বিভাগে প্রথম বিচারপতি হিসেবে এলাম। আমি মনে করি, আমার এই নিয়োগ দেশে নারীর ক্ষমতায়নে অবদান রাখবে।’

বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা
১৯৫০ সালের ৮ জুলাই মৌলভীবাজারে জন্মগ্রহণ করেন বিচারতি নাজমুন আরা সুলতানা।বাবার নাম মরহুম চৌধুরী আবুল কাশেম মইনুদ্দিন। মায়ের নাম মরহুমা বেগম রাশিদা সুলতান দ্বীন।

শৈশব কাটিয়েছেন ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে। পরে ময়মনসিংহ সদরের বিদ্যাময়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে মেট্রিকুলেশন, ১৯৬৭ সালে মুমিনুন্নেসা উইমেন্স কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। তিনি ১৯৬৯ সালে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ময়মনসিংহ ল’ কলেজে থেকে ১৯৭২ সালে এলএলবি ডিগ্রি নেন।

১৯৭৫ সালের আগে বিচার বিভাগে কোনো নারীর চাকরির সুযোগ ছিল না। নাজমুন আরা সুলতানাই প্রথম ১৯৭৫ সালের ২০ ডিসেম্বর সহকারী জজ হিসেবে নিয়োগ পান। তিনিই দেশের প্রথম নারী বিচারক। নিম্ন আদালত থেকে ধীরে ধীরে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে তিনি পা রাখেন।

মুনসেফ হিসেবে নাজমুন আরা সুলতানা খুলনা, নারায়ণগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালে সাবজজ হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে তিনি টাঙ্গাইল, চাঁদপুর ও ফরিদপুরে কাজ করেন। কয়েক দফা পদোন্নতির পর ১৯৯১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জেলা জজ হিসেবে যোগ দেন। কোনো নারীর জেলা জজ হওয়ার ঘটনা সেটাই প্রথম। ২০০০ সালের ২৮ মে তিনি হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। এর দুই বছর পর হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হন তিনি। সর্বশেষ ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি আপিল বিভাগের প্রথম নারী বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন।

সেনানিবাসে খালেদা জিয়ার বাড়ি নিয়ে মামলা, বিএনপির আমলে বাদ পড়া ১০ বিচারপতির মামলা, আপিল বিভাগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মামলায়ও তিনি বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন।

এছাড়া তিনি আন্তর্জাতিক নারী আইনজীবী সংস্থায় দু’বার সদস্য সচিব নিযুক্ত হন। তিনি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সম্মেলনে ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, ইতালি, জাপান, আমেরিকা, ইরান, ইরাক ও ইংল্যান্ড সফর করেন।

বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী
আপিল বিভাগের মতো হাইকোর্ট বিভাগেও পিছিয়ে নেই নারী বিচারপতিরা। হাইকোর্টের বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী তাদের একজন। সাবেক বিচারপতি এটিএম মাসুদ ও আমিনুন নেসার বড় সন্তান তিনি। ১৯৫৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন সালমা মাসুদ চৌধুরী।

১৯৮১ সালের ২২ আগস্ট সালমা মাসুদ চৌধুরী ঢাকা জেলা জজ আদালতে আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৮৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর তিনি হাইকোর্টের আইনজীবী হন। ১৯৯৬ সালের ১৪ মে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন।

সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি সালমা মাসুদ চৌধুরী হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত হন। এর দুই বছর পর তিনি হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।

সালমা মাসুদ চৌধুরী আইন চর্চার জন্য কমনওয়েলথ সচিবালয় কর্তৃক আয়োজিত মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে আইনসভা বিষয়ক ড্রাফটিং কোর্স করেন। পাকিস্তানের লাহোরে আন্তর্জাতিক নারী আইনজীবী সম্মেলনে তিনি তার লেখা ‘মুসলিম পারিবারিক আইন ও বাংলাদেশের নারী’ শিরোনামের গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন।

বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে ২৩তম আন্তর্জাতিক নারী আইনজীবী সংস্থা কর্তৃক আয়োজিত সম্মেলনে ‘ড্রাগ অ্যাবিউস অ্যান্ড রেমিডিয়াল মেজার্স ইন বাংলাদেশ’ রিপোর্ট উপস্থাপন করেন। এই রিপোর্ট তিনি কেনিয়ায়ও উপস্থাপন করেন।

বিচারপতি হওয়ার পর সরকারি উদ্যোগে তিনি ‘ইসলাম ও নারী’ শীর্ষক সম্মেলনে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর, ইন্দোনেশিয়ার জার্কাতা ও দক্ষিণ এশিয়ার ইসলামী আইনবিদদের সম্মেলনে যোগ দেন। এছাড়া কাঠমান্ডু ও লন্ডনে আন্তর্জাতিক নারী বিচারক সংস্থা আয়োজিত সম্মেলনে যোগ দেন তিনি। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ হার্ট ফউন্ডেশনের ট্রাস্টি ও নির্বাহী সচিবের দায়িত্বে আছেন।

বিচারপতি জিনাত আরা
বিচারপতি জিনাত আরা মরহুম এইচএমআর সিদ্দিকী ও মরহুম বেগম আয়েশা সিদ্দিকীর মেয়ে। তিনি ১৯৫৩ সালের ১৫ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল আব হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন।

তিনি ১৯৭৮ সালের ৩ নভেম্বর বিচার বিভাগে মুনসেফ হিসেবে চাকরি শুরু করেন। এরপর ১৯৯৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে তিনি পদোন্নতি পান। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৩ সালের ২৭ এপ্রিল তিনি হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত হন। ২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল তিনি হাইকোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ পান।

তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন স্কুল ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্টিফিকেট কোর্স করেন। এছাড়া আন্তর্জাতিক সেমিনার ও ট্রেনিংয়ের জন্য বেইজিং, সাংহাই, আমেরিকা, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ভারত, পাকিস্তান, পানামা, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড সফর করেন।

রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে তিনি বেলজিয়াম, ইরাক, কুয়েত, মালয়েশিয়া, নেদারল্যান্ডস, জর্দান, সিরিয়া, সিঙ্গাপুর ও ইংল্যান্ড সফর করেন।

বিচারপতি ফারাহ মাহবুব
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ১৯৬৬ সালের ২৭ মে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মাহবুবুর রহমান। মায়ের নাম বেগম ফিরোজা বেগম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও এলএলএম পাস করেন।

১৯৯২ সালে তিনি জেলা আদালতে আইন পেশা শুরু করেন। তিনি ১৯৯৪ সালের ১৫ অক্টোবর হাইকোর্টে এবং ২০০২ সালের ১৫ মে আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২০০৪ সালের ২৩ আগস্ট তিনি হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি নিযুক্ত হন। ২০০৬ সালে তিনি হাইকোর্ট বিভাগে পূর্ণাঙ্গ বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।

তিনি ২০১০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেন। এছাড়া ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, দুবাই, জার্মানি ও সৌদি আরব সফর করেন তিনি।

বিচারপতি নাইমা হায়দার
বিচারপতি নাইমা হায়দার সাবেক বিচারপতি মরহুম বদরুল হায়দার চৌধুরী ও বেগম আনোয়ারা চৌধুরীর মেয়ে। তিনি ১৯৬২ সালের ১৯ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন।

তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে পড়াশুনা করেন। এছাড়া কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কেল বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন।

তিনি ১৯৮৯ সালে জেলা আদালতে আইন পেশায় যোগ দেন। ১৯৯৩ সালে হাইকোর্টে আইনজীবী এবং ২০০৪ সালে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন।

তিনি ২০০৯ সালের ৬ জুন হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। ২০১১ সালের ৬ জুন হাইকোর্টের পূর্ণ বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান।

নাইমা হায়দার দেশে-বিদেশে অন্তত ২০টি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেন। এছাড়া তিনি আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, সৌদি আরব, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, পর্তুগাল, অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ড, তুরস্ক, চায়না, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা সফর করেন।

বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ
হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি হিসেবে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল নিয়োগ পান কৃষ্ণা দেবনাথ। ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান তিনি।

এর আগে তিনি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে লেখাপড়া করেন।

বিচারপতি কাশেফা হোসেন
হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি হিসেবে ২০১৫ সালের ৫ আগস্ট নিয়োগ পান কাশেফা হোসেন। ২০১৩ সালের ৪ আগস্ট অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান তিনি।

এর আগে তিনি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ক ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়া লন্ডনেও একই বিষয়ে পড়াশুনা করেন।

এফএইচ/এমএআর/এমএস