রিজার্ভ খেয়ে ডিএসইর বিশেষায়িত তহবিলে হাত
সক্ষমতা না থাকলেও ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জন্য শেয়ারহোল্ডারদের ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ। এ জন্য রিজার্ভ শূন্য করে বিশেষায়িত তহবিলেও হাত দিতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকে।
ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশনের মাধ্যমে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর হওয়া ডিএসইর এটি হবে দ্বিতীয় লভ্যাংশ ঘোষণা। গতবার শেয়ারহোল্ডারদের ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিতে ৪৬ কোটি টাকার ওপরে রিজার্ভ ভাঙতে হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটিকে।
এবার শেয়ারহোল্ডারদের ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিতে রিজার্ভে থাকা সব অর্থ নেয়ার পরও প্রায় ৪ কোটি টাকা ঘাটতি পড়ছে। যে ঘাটতি মেটাতে ডেভলপমেন্ট ও বিল্ডিং ফান্ডের মতো বিশেষায়িত তহবিলে হাত দিচ্ছে ডিএসই।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদ সভায় এ লভ্যাংশ দেয়ার সুপারিশ করা হয়, যা আগামী ২৩ মার্চ বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে।
ডিএসইর পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ১ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। এ হিসাবে ১০ শতাংশ হারে লভ্যাংশ দিতে হলে প্রয়োজন হবে প্রায় ১৮০ কোটি ৩০ লাখ টাকা। তবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ডিএসই মুনাফা করেছে ১১৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। অর্থাৎ শেয়ারহোল্ডারদের ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিতে প্রতিষ্ঠানটির আরও ৬০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা প্রয়োজন।
আগের বছর ২০১৪-১৫ অর্থবছরেও ডিএসই রিজার্ভ ভেঙে শেয়ারহোল্ডারদের ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছিল। ওই বছর প্রতিষ্ঠানটি মুনাফা করেছিল ১৩৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। বছরটিতে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে রিজার্ভ থেকে নিতে হয়েছিল ৪৬ কোটি টাকার ওপরে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত নিয়ম হচ্ছে মুনাফার সম্পূর্ণ অংশ শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ হিসেবে না দিয়ে কিছু অংশ রিজার্ভে রেখে দেয়া। যাতে আপদকালীন সময়ে তা কাজে লাগানো যায়। তবে রিজার্ভ শূন্য করে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয়া উচিত না। এতে প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা কমে যায়।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, রিজার্ভ শূন্য করে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয়া আমার মতে ঠিক হবে না। যদি এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয় তবে বিএসইসির বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত।
বিএসইসির সাবেক আরেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, আমি মনে করি রিজার্ভ শূন্য করে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয়া উচিত না। এতে ডিএসইর সক্ষমতা কমে যাবে।
এদিকে রিজার্ভ ভেঙে লভ্যাংশ দেয়ার বিষয়ে ডিএসই কর্তৃপক্ষ বলছে, ধারাবাহিকতা রক্ষা করা এবং স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারদের কথা চিন্তা করে লভ্যাংশ দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া শেয়ারহোল্ডাররা বিনিয়োগ করেন কিছু পাওয়ার আশায়। আর রিজার্ভ থেকে লভ্যাংশ দেয়ার ক্ষেত্রে আইনগত কোনো বাধা নেই। এছাড়া ডিএসইর যে আর্থিক অবস্থা তাতে রিজার্ভ ভেঙে লভ্যাংশ দিলে কোনো ক্ষতি হবে না।
ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এ এম মাজেদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, রিজার্ভ থেকে লভ্যাংশ দেয়ার ক্ষেত্রে আইনগত কোনো বাধা নেই। ডিএসইর যে রিজার্ভ আছে তা থেকে মুনাফা দিলে কোনো সমস্যা হবে না। আর শেয়ারহোল্ডাররা প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু পাওয়ার ইচ্ছা করেন। তাই রিজার্ভের অর্থ থেকে লভ্যাংশ দেয়া হচ্ছে।
ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, শেয়ারবাজারে মন্দা থাকায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে লেনদেন কম হয়েছে। আবার ডিপোজিটের সুদের হারও কমে গেছে। যে কারণে ডিএসইর আয় কিছুটা কমেছে। তবে বর্তমানে লেনদেনের যে গতি দেখা যাচ্ছে তাতে আগামী বছর ভালো আয় হবে।
রিজার্ভ ভেঙে লভ্যাংশ নেয়া ঠিক হচ্ছে কি না এমন প্রশ্ন করলে রকিবুর রহমান বলেন, আমরা বোর্ড সভায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জন্য শেয়ারহোল্ডারদের ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়ার সুপারিশ করেছি। এ জন্য রিজার্ভ থেকে অর্থ নিতে হবে এটি সত্য। তবে শেয়ারহোল্ডারদের কিছু লভ্যাংশ তো দিতেই হবে।
ডিএসইর আরেক পরিচালক শাকিল রিজভী জাগো নিউজকে বলেন, স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারদের কথা চিন্তা করে এবং লভ্যাংশের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। লভ্যাংশের ধারাবাহিকতা না থাকলে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনাররা নিরুৎসাহিত হবেন। আর রিজার্ভ শূন্য হয়ে যাওয়া কোনো বিষয় না। ভবিষ্যতে আবার রিজার্ভ হয়ে যাবে।
ডিএসইর সাবেক সভাপতি আহসানুল ইসলাম টিটু জাগো নিউজকে বলেন, শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশের বিষয়ে কী সুপারিশ করা হয়েছে তা আমার জানা নেই। তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
ডিএসইর বোর্ড সভায় উপস্থাপন করা আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ডিএসইর মুনাফা আগের বছরের তুলনায় ১৪ কোটি ৮১ লাখ টাকা কম হয়েছে। ফলে কমেছে শেয়ারপ্রতি আয়ের (ইপিএস) পরিমাণ। ইপিএস হয়েছে ৬৬ পয়সা, যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ৭৫ পয়সা। মুনাফা কমার পাশাপাশি আয়ও কমেছে। তবে বেড়েছে ব্যয়ের পরিমাণ।
অর্থবছরটিতে প্রতিষ্ঠানটি আয় করেছে ১৮৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। যা আগের বছর ছিল ১৯৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। বরাবরের মতো এবারও ডিএসইর আয়ের প্রধান খাত হিসেবে রয়েছে সুদ ও লভ্যাংশ। তবে আগের বছরের তুলনায় এ খাতে ডিএসইর আয় কমে গেছে। সুদ ও লভ্যাংশ বাবদ আয় হয়েছে ১১০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ১২১ কোটি ১০ লাখ টাকা।
লেনদেন খরার কারণে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে লেনদেন চার্জ থেকেও ডিএসইর আয় কমেছে। সেইসঙ্গে স্টক হোল্ডারদের কাছ থেকেও আয় কমেছে। লেনদেন চার্জ থেকে আয় হয়েছে ৫২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা, যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ৫৫ কোটি ২১ লাখ টাকা। স্টক হোল্ডারদের কাছ থেকে শেষ অর্থবছরে আয় হয়েছে ৪ কোটি ৯ লাখ টাকা, যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।
অপরদিকে আয় বাড়ার খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে- তথ্য বিক্রি, বিবিধ খাত ও তালিকাভুক্ত কোম্পানি থেকে আয়। এর মধ্যে তালিকাভুক্ত কোম্পানি থেকে আয় হয়েছে ১৬ কোটি ৩৬ লাখ টাকা, যা আগের বছর ছিল ১২ কোটি ১৫ লাখ টাকা। তথ্য বিক্রি করে আয় হয়েছে ১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, যা আগের বছর ছিল ৯৬ লাখ টাকা। আর বিবিধ খাত থেকে আয় হয়েছে ২ কোটি ২১ লাখ টাকা, যা আগের বছর ছিল ১ কোটি ২ লাখ টাকা।
এদিকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ডিএসইর ব্যয় হয়েছে ৬৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ৬০ কোটি ২২ লাখ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ব্যয়ের খাতগুলোর মধ্যে ব্যক্তিগত খরচ ২৬ কোটি ৬২ লাখ, সিকিউরিটিজদের পারিশ্রমিক ৪৭ লাখ, ভাড়া ও ট্যাক্স ২ কোটি ৫ লাখ, পরিবহন ১ কোটি ৭৬ লাখ, আইসিটি ১৩ কোটি ৫৯ লাখ, ইউটিলিটিস ৯৪ লাখ, মেরামত ও রক্ষাণাবেক্ষণ ৪৬ লাখ, মনিহারি ৭৪ লাখ, বিজ্ঞাপন ৩১ লাখ, সাধারণ বীমা ৫ লাখ, বিভিন্ন পরামর্শক ফি ৪৯ লাখ, সেমিনার ১ কোটি ৫২ লাখ, বিনিয়োগকারী সুরক্ষা তহবিল ১০ লাখ, অবচয় ১১ কোটি ৫৯ লাখ, ব্যাংক চার্জ ৩৩ লাখ, ডব্লিপিপিএফ (ওয়ার্কাস প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড) ৬ কোটি এবং টেলিফোন, টেলেক্স, ফ্যাক্স, ইন্টারনেট ও ডাকমাশুল খাতে ৩৯ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।
এমএএস/এআরএস/এমএস