ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

পানিশূন্য হচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চল

প্রকাশিত: ১১:৩৬ পিএম, ০৪ মার্চ ২০১৭

ক্রমেই পানি সংকটপূর্ণ হয়ে উঠছে বরেন্দ্রখ্যাত রাজশাহী অঞ্চল। দুই বছরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমেছে অন্তত ১০ ফিট। এর মধ্যে সব চেয়ে বেশি পানির স্তর ১২ ফিট ৯ ইঞ্চি নিচে নেমেছে রাজশাহীর তানোর উপজেলার বাধাইড় ইউনিয়নে।

এর মধ্যে ৮ ফিট ৯ ইঞ্চি নেমেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের ঝিলিম ইউনিয়নের পানির স্তর। বিকল্প সমাধান খুঁজতে এলাকাগুলোকে ‘পানি সংকটপূর্ণ’ হিসেবে ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার।

প্রতি বছরই খরা মৌসুমে পানির জন্য হাহাকার বরেন্দ্র অঞ্চলের নিয়মিত চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাষের জন্য এ অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানি উঠোনো হচ্ছে দেদার। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অটোরাইস মিলের গভীর নলকূপ। এতে অব্যাহতভাবে নিচে নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। ফলে ঝুকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে সুপেয় পানির যোগান।

পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পানীয়জল সরবরাহে বসানো বহু টিউবয়েল বন্ধ হয়ে গেছে। বিভিন্ন এলাকার বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গভীর নলকূপের সঙ্গে গড়ে তোলা হয়েছে পানযোগ্য পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক। কিন্তু অনেক এলাকায় এসব গভীর নলকূপও বন্ধ।

শুধু পানযোগ্য পানি নয়, ক্রমেই কৃষির জন্যও ন্যূনতম পানি পাওয়া হয়ে উঠছে কঠিন। এ তীব্র সংকটে এসব এলাকার মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে দারুণভাবে। এ পরিস্থিতিতে বরেন্দ্র অঞ্চলের কয়েকটি এলাকাকে দেশের প্রথম ওয়াটার ট্রেস এরিয়া বা ‘পানি সংকটপূর্ণ’ এলাকা হিসেবে ঘোষণা দিতে যাচ্ছে সরকার।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পানি সংকটের কারণে রাজশাহীর তানোর উপজেলার বাধাইড় ইউনিয়নকে ‘পানি সংকটপূর্ণ’ এলাকা হিসেবে ঘোষণা দিতে যাচ্ছে সরকার। আর এ জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ এরই মধ্যে শেষ।

বরেন্দ্র অঞ্চল নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ‘ডাসকো ফাউন্ডেশন’। সংস্থাটির এর সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের (আইডব্লিউআরএম) জরিপে বাধাইড় ইউনিয়ন এলাকাকে নিরাপদ পানির জন্য অতি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরপর ভূগর্ভস্থ পানি তোলা বন্ধে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে।

ডাসকো ফাউন্ডেশনের জরিপ থেকে জানা গেছে, ২০১৫ সালে বরেন্দ্র অঞ্চলের ৩ পৌরসভা ও ১৫ ইউনিয়নকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে বাধাইড় ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এই ইউনিয়নে বিএমডিএ ৭০টি গভীর নলকূপ বসিয়েছে। ২০ বছর ধরে এলাকার দুই হাজার হেক্টরের বেশি জমি এসেছে সেচের আওতায়।

কিন্তু পানি সংকটে বর্তমানে তা বন্ধের পথে। এরইমধ্যে বৌদ্যপুর মৌজার নলকূপটি বন্ধ হয়ে গেছে। ঝুঁকিতে আরও ২৫টির বেশি গভীর নলকূপ। তানোরের বাধাইড় ও মণ্ডুমালা এলাকায় সরকারি ১৫ হাজার ও ব্যক্তিগত ৮ হাজার টিউবওয়েল রয়েছে। এর মধ্যে এখন ৯ হাজারের মতো টিউবওয়েলে পানি উঠে না।

অন্যদিকে, পানি সংকটপূর্ণ ঝিলিম ইউনিয়নে বিএমডিএর গভীর নলকূপ রয়েছে ১১৩টি। এ থেকে চাষ হচ্ছে প্রায় দুই হাজার ৭০০ হেক্টর কৃষি জমি। তবে সংকট বাড়াচ্ছে এখানার ৩২টি অটো রাইসমিল। এসব রাইসমিলের অন্তত ২০০টি গভীর নলকূপে অনরবত পানি তুলছে।

এ নিয়ে কথা হয় বাধাইড় ইউনিয়নের বহরলই মৌজার গভীর নলকূপ অপারেটর নুরুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি জানান, তার নলকূপ দিয়ে প্রথমে ২০০ বিঘার বেশি জমি আবাদ হতো। এখন নেমে এসেছে ৩৫ বিঘায়। পানি উঠছে না আগের মতো। ফলে খরচ বেড়েছে চার গুণেরও বেশি।

একই ভাষ্য ঝিলিম ইউনিয়নের জামতলা নওহাটা মৌজার গভীর নলকূপ অপারেটর কাবা আলীরও। পানি সংকট ছাড়াও তার এলাকায় কৃষি জমিতে অটোরাইস মিল গড়ে ওঠায় চাষের জমি কমছে বলে জানান কাবা আলী।

জানতে চাইলে বাধাইড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান জানান, বছর দশেক আগেও ইউনিয়নে কুয়া ও টিউবওয়েলের পানি দিয়ে মানুষ দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতেন। পানির স্তর নেমে যাওয়ায় এখন কূপ ও টিউবওয়েলে পানি নেই। পানির জন্য হাহাকার পড়ে যাচ্ছে এলাকায় এলাকায়। খরা মৌসুমে এ সংকট আরও চরম হচ্ছে।

বিএমডিএ তানোর জোনের প্রকৌশলী শরিফুল ইসলাম জানান, রাজশাহী জেলার অন্যসব ইউনিয়নের চেয়ে বাধাইড় ইউনিয়ন সবচেয়ে উঁচু। ফলে এ ইউনিয়ন নিয়ে চিন্তিত বিএমডিএ।

অন্যদিকে, বিএমডিএ চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা জোনের সহকারী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান বলেন, ঝিলিম ইউনিয়নে সংকট তৈরি করেছে এখনারকার অটো রাইসমিলগুলো। বিএমডিএর নলকূপের চেয়ে এগুলো অন্তত ৫০ ফুট গভীরে বসানো। ফলে পানি পাচ্ছে না বিএমডিএর নলকূপ।

ডাসকো’র আইডব্লিউআরএম প্রকল্পের ঝিলিম ও নিজামপুর ইউনিয়নে দায়িত্বেপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শিশির কুমার রায় জানান, ঝিলিম ইউনিয়ন এলাকায় ২০১৫ সালে পানির স্তর পরিমাপ কূপ বসানো হয়েছিল। তখন পানির স্তর ছিল ১০১ ফিট। ২০১৭ সালে পানির স্তর মিলছে ১০৮ ফুট ৯ ইঞ্চি নিচে।

অন্যদিকে, আইডব্লিউআরএম প্রকল্পের বাধাইড় ইউনিয়ন ও মুণ্ডমালা পৌরসভা এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আগস্টিনা হাঁসদা জানান, স্তরপরিমাপক ক‚পে প্রতি মাসে দু’বার করে মাপা হচ্ছে পানির স্তর। বাধাইড় ইউনিয়নের অবস্থা বেশি সংকটপূর্ণ। বাধাইড় ইউনিয়নের ঝিনাইখোর এলাকায় ২০১৫ সালে পানির স্তর ছিলো ৯৯ ফুট নিচে। ২০১৭ সালে ১১১ ফুট ৯ ইঞ্চি নিচে পানির স্তর পাওয়া পাচ্ছে। বিষয়টি অ্যালার্মিং।

ডাসকো’র আইডব্লিউআরএম প্রকল্পের সহকারী সমন্বয়ক জাহাঙ্গীর আলম খান জানান, একযুগ আগেও এই অঞ্চলে ৬০ থেকে ৯০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেত। বর্তমানে ১৬০ ফুট বা তার নিচে না গেলেও পানি মিলছে না। ঝুঁকিপূর্ণ এসব এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০-৪৫ মিটার উঁচুতে অবস্থান করছে। ঝুঁকিপূর্ণ ইউনিয়ন ও পৌর এলাকাগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে আবাদ বন্ধ করতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ঠেকাতে বিদ্যমান বড় পুকুর ও খাড়ি খনন করে ভূমির ওপরের পানি ব্যবহার বাড়াতে বলা হয়েছে।

তিনি বলেন, শুধু তানোর উপজেলাতেই এবার ১৩ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। আলুতে অন্তত চার দফা সেচ দিতে হয়। আর এসব সেচ দেয়া হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানি থেকেই।

এছাড়া বাধাইড় ইউনিয়নের পরই দ্বিতীয় ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নেও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে। এর অন্যতম কারণ হল এই একটি ইউনিয়নেই রয়েছে ৩২টি অটোরাইস মিল। এসব মিলে অন্তত ২০০টি গভীর নলকূপ থেকে অনরবত পানি তোলা হচ্ছে। ফলে এর সংকট ভয়াবহ হচ্ছে।

অন্যদিকে, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) চেয়ারম্যান ড. আকরাম হোসেন জানান, পরিস্থিতি তাদেরও ভাবনায় ফেলেছে চরমভাবে। কৃষি মন্ত্রণালয় এ অঞ্চলে নতুন করে গভীর নলকূপ স্থাপন না করার নির্দেশ দিয়েছে এরই মধ্যে।

বিএমডিএ চেয়ারম্যান বলেন, সেচ সাশ্রয়ী বিভিন্ন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে বিএমডিএ। যেসব ফসল কম সেচে চাষ হয় সেগুলো চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে চাষিদের। দেয়া হচ্ছে কারিগরি সহায়তা। ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সাথে সমন্বয় রেখে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার কথা ভাবছে বিএমডিএ। আর এরই অংশ হিসেবে এগ্রো-ইকো ইনোভেশন রিসার্চ প্লাটফরমের কথা এসেছে।

তাদের উদ্দেশ্যে, অধিক পানি গ্রহণকারী ফসলের পরিবর্তে ক্রমান্বয়ে কম পানি গ্রহণকারী খরা ও তাপ-সহিষ্ণু ফসলের জাত প্রবর্তন। এতে কমে আসবে ভূ-গর্ভস্থ পানির সেচনির্ভরতা। স্বল্প জমি থেকে অধিক ফসল উৎপাদন নিশ্চিত করতে জাতীয় কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞানি, গবেষক, বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলীদের সমন্বয়ে যৌথ গবেষণা প্লাটফর্ম গড়ে তোলা। এ নিয়ে সম্প্রতি প্রথম সম্মেলন করেছেন তারা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ও ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান। তিনি সরকারের পানিবিষয়ক টাস্কফোর্সের সদস্য হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন।

তিনি জানান, গত ১০ ফেব্রুয়ারি তিনি বাধাইড় ইউনিয়নের জোত গোকূল ও কালিকান্দর গ্রাম ঘুরে এসেছেন। বিশেষ করে এই এলাকায় খাবার পানির ভয়াবহ রকমের সংকট চলছে।

এরই মধ্যে গভীর নলকূপ চালু থাকলেও খাওয়ার জন্য তা দিয়ে পানি উঠে না। তবে আনুষ্ঠানিক ওয়াটার ট্রেস এরিয়া ঘোষণা দেয়ার আগে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে এ অঞ্চলের বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রাম ঘুরে দেখছেন তিনি। ডাটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করছেন। বিকল্প সমাধানের পথ খুঁজতেই এ উদ্যোগ।  

ফেরদৌস সিদ্দিকী/এএম

আরও পড়ুন