দরবার হলে সেদিন যা ঘটেছিল
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) দরবার হলে ঘটে ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য হত্যাযজ্ঞের ঘটনা। এদিন দরবার হলে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। দরবার হল থেকে কয়েকজন বেরিয়ে আসতে পাড়লেও বেশিরভাগ কর্মকর্তাই শহীদ হন সেদিন। আদালতে প্রত্যক্ষদর্শী অফিসার ও সৈনিকদের বক্তব্যে উঠে আসে সেদিনের দরবার হলের ভেতরের ভয়াবহ চিত্রের বর্ণনা।
২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯ টার পর দরবার হলে প্রবেশ করেন তৎকালীন বিডিআরের মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ। তার পাশেই বসেছিলেন উপ-মহাপরিচালক (ডিডিজি)। অনুষ্ঠান শুরুর আগে বিডিআরের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পেশ ইমাম সিদ্দিকুর রহমান পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করেন।
এর পরপরই বক্তব্য দিতে আসেন ডিজি শাকিল আহমেদ। বক্তব্যে এক পর্যায়ে তিনি ‘অপারেশন ডাল-ভাত’ কার্যক্রম প্রসঙ্গ তোলেন। জানতে চাইলেন সবাই ডালভাতের দৈনিক ভাতা পাচ্ছে কিনা। কিন্তু সৈনিকদের জবাব জোরালো ছিল না।
দরবারে সাধারণত সৈনিকদের যে ধরনের তাৎক্ষণিক স্বতঃস্ফূর্ত ইতিবাচক প্রত্যুত্তর থাকে, সেদিন তেমন ছিল না। ডিজি তার বক্তব্যের এক অংশে ২০০৮ সালে সৈনিকদের শৃঙ্খলা ভালো ছিল না বলে মন্তব্য করেন। একথা বলার পরপরই সৈনিকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
ঘড়ির কাঁটায় সকাল সাড়ে ৯টা বাজে প্রায়। ডিজির বক্তব্যের এক পর্যায়ের ১৩ ব্যাটালিয়নের সিপাহী মাঈন অস্ত্রহাতে মঞ্চে উঠে ডিজির দিকে অস্ত্র তাক করেন। ডিজি শাকিলও পূর্ণ ব্যক্তিত্ব নিয়ে মাথা ঘুরিয়ে তাকান। ডিজির চোখের দিকে তাকিয়ে সৈনিক মাঈন মঞ্চে অজ্ঞান হয়ে যায়।
প্রায় একই সময় মঞ্চে উঠে কাজল নামের আরেক সিপাহী। কিন্তু মাঈনকে পড়ে যেতে দেখে দরবার হলের আশপাশের জানালার কাঁচ ভেঙে লাফ দিয়ে বাইরে চলে যায় সে। তখনই ভেতরে শুরু হয় গোলাগুলি। দরবার হল মুহূর্তে ফাঁকা। প্রায় ৩ হাজার সৈনিক এবং জেসিও মুহূর্তের মধ্যে যে যেভাবে পেরেছে জানালা বা দরজা দিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে যায়। অনেক কর্মকর্তাও ওই সময় বেরিয়ে যান।
ডিজি, ডিডিজি ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাসহ ৪৫-৫০ জন দরবার হলে অবস্থান করে আলোচনা করতে থাকেন। অন্যদিকে সিপাহীরা বাইরে গিয়ে নিজেদের সংগঠিত করে। ১৫-২০ মিনিট পর দরবার হলের পূর্ব-দক্ষিণ কোণ থেকে গুলির আওয়াজ আসতে থাকে। সে সময় দরবার হলের ভিতরের সামনের লোকজন দৌড়াদৌড়ি করে বের হয়ে যায়। ডিজি চেয়েছিলেন সবকিছু স্বাভাবিক করতে। সে সময় তিনি কর্মকর্তাদের বলেন, সবাইকে যেন আবার দরবার হলের ভিতর ডেকে আনা হয়, দরবার আবার শুরু হবে।
সকাল ৯টা ৪০ মিনিটের দিকে দরবার হলের বাইরে গুলির শব্দ বাড়তে থাকে। এর মধ্যে দেখা গেল লাল সবুজ রঙের কাপড় দিয়ে নাক-মুখ বাঁধা বিডিআরের একদল সৈনিক দরবার হল ঘিরে কিছুক্ষণ পর গুলি করছে। এ সময় ভিতরে অবস্থানকারী অফিসাররা দেখেন, ফাঁকা গুলিবর্ষণকারী সৈনিকদের আরেকদল গুলি সরবরাহ করছে।
সদর রাইফেল ব্যাটালিয়নের একটি পিকআপ রাস্তা দিয়ে দরবার হলের পাশের মাঠে এসে দাঁড়ায়। ততক্ষণে কাঁচ ভেঙে গুলি দরবার হলের ভিতর ঢুকছিল। কর্মকর্তারা আত্মরক্ষার্থে কেউ দেয়াল ঘেঁষে, কেউ পিলারের আড়ালে আশ্রয় নেন।
ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল তখনও সমাধানের পথ খুঁজছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর (এসএম) নুরুল ইসলামকে বলেন, ‘সৈনিকদের এ রকম ক্ষোভ আছে আপনি তো কোনো দিন একবারও বলেননি!’
তখন কেউ একজন ডিজিকে বলেছিলেন, ‘স্যার, গাড়ি লাগানো আছে, আপনি চলে যান।’ ডিজি বলেন, ‘আমি কোথায় যাব? কেন যাব?’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঢাকা সেক্টর কমান্ডার এবং ঢাকার অধিনায়কদের নিজ নিজ ইউনিটে গিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলে তাদের মোটিভেট করতে বলেন। এর মধ্যে বিডিআরের কয়েকজন সৈনিক চারদিক থেকে দরবার হলের দিকে গুলি করতে থাকে। এসবের মধ্যে ডিজি একবার সেনাপ্রধান ও একবার র্যাবের ডিজির সঙ্গে কথা বলেন।
সবাই জানিয়েছেন, কিছুক্ষণের মধ্যে সেনাবাহিনী ও র্যাব চলে আসবে। লে. কর্নেল ইয়াসমিনও লক্ষ্য করেন, তখন ডিজি বিভিন্ন জায়গায় মোবাইল ফোনে সাহায্যের জন্য সেনাবাহিনী পাঠাতে অনুরোধ করছিলেন। ততক্ষণে অফিসার মেসে অফিসারদের গাড়িতে আগুন ধরাচ্ছিল সৈনিকেরা। বিডিআরের সব গেট ও অস্ত্রাগারের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তারা।
দরবার হলে অবস্থানকারী কর্মকর্তারা শুনতে পান গুলির শব্দ অনেক কাছে এগিয়ে আসছে। তখন মঞ্চের সব আলো নিভিয়ে ফেলতে বলেন ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল। কর্নেল আনিস একটি লম্বা কাঠ দিয়ে সব বাল্ব ভেঙে ফেলেন। ডিজি মাইকে সবাইকে শান্ত হতে বলছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘তোমরা গুলি থামাও। তোমাদের সব দাবি মেনে নেয়া হবে।’
ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ১০টা ২০ মিনিট। সিপাহী সেলিম মাইকে কর্মকর্তাদের বেরিয়ে আসতে বলে। ডিজিসহ কয়েকজন কর্মকর্তা মঞ্চের পর্দার ভিতরে উত্তর দিকে ছিলেন। ডিজিকে কোনায় একটি চেয়ারে বসানো হলো। অন্যরা সবাই ডিজির গা ঘেঁষে দাঁড়ালেন। ডিজি শাকিল বললেন, ‘তোমরা মৃত্যুকে কেন ভয় পাচ্ছ? মরতে তো একদিন হবেই।’ কর্মকর্তারা বললেন, ‘স্যার, আপনার সেফটির দরকার আছে।’
সকাল সাড়ে ১০টা। বিদ্রোহী সৈনিকরা চিৎকার করে কর্মকর্তাদের মঞ্চের ভিতর থেকে বের হতে বলে। তখন মঞ্চের নিচে ১৫-১৬ জন বিদ্রোহী কাপড়ে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে ছিল। ১০টা ৩১ মিনিটের পরপরই মঞ্চের পর্দার আড়ালে দক্ষিণ পাশে থাকা তিনজন নারী কর্মকর্তাসহ ২০-২৫ জন কর্মকর্তা হাত উঁচু করে বের হয়ে আসেন।
উত্তর পাশে থাকা ডিজিসহ অন্য কর্মকর্তারা তখনো বের হননি। বিদ্রোহীরা প্রথমেই কর্মকর্তাদের সবার মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। সবাইকে তারা মাটিতে শুয়ে পড়তে এবং র্যাঙ্ক খুলে ফেলতে বলে। কর্মকর্তারা দরবার হলের মেঝেতে শুয়ে পড়েন। তখন তাদের ওপর দরবার হলের ভিতরে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে কিছুটা দূরে দাঁড়ানো মুখে কাপড় বাঁধা একজন বিডিআর সৈনিক তিন-চার রাউন্ড গুলি চালায়। লে. কর্নেল কায়সার ও অন্য দুজন কর্মকর্তা এতে গুলিবিদ্ধ হন।
দরবার হলের মঞ্চের পর্দার আড়ালে উত্তর দিকে ডিজিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন। বিদ্রোহীরা হ্যান্ডমাইকে বলছিল, ‘ভিতরে কেউ থাকলে বের হয়ে আসেন। ’ একই সঙ্গে তারা মঞ্চের দিকে গুলি ছোড়ে। হঠাৎ মুখে কাপড় বাঁধা একজন সৈনিক অস্ত্রহাতে পর্দা সরিয়ে মঞ্চে ঢুকে চিৎকার করে বলে, ‘ভিতরে কেউ আছেন? সবাই বের হন।’
একই সঙ্গে কর্মকর্তাদের দিকে তাকিয়ে দুটি গুলি করে সে। এরপর ডিজিসহ একে একে অন্য কর্মকর্তারা পর্দা সরিয়ে বাইরে আসেন। সবার কাছ থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে নেয় বিদ্রোহীরা। মঞ্চের নিচে নেমেই কর্মকর্তারা ডিজি শাকিলকে মধ্যে রেখে গোল হয়ে দাঁড়ান। একজন সৈনিক চিৎকার করে অশালীন ভাষায় তাদের সিঙ্গেল লাইনে দাঁড়াতে বলেন। এরপরই একে একে হত্যা করা হয় তাদের।
এআর/জেএইচ