ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

মাদকের নতুন ছোবল ‘ই-লাইটার’

আদনান রহমান | প্রকাশিত: ১১:০২ এএম, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ভালো-মন্দের বিবেচনাবোধ তৈরির আগেই অনেক শিশু বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পরিবার থেকে। অনেকে পারিবারিক কলহ ও অশান্তির কারণেও বিচ্ছিন্ন হয়। এরপর জীবিকার তাড়নায় তাদের জড়াতে হয় নানা কাজে। হাতে অর্থ আসতে শুরু হলে শুরু হয় অবক্ষয়ও। স্বাভাবিক জীবনের পরিবর্তে এসব শিশু মাদক গ্রহণ শুরু করে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গবেষণা অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১৫ বছরের নিচে মোট ৩ দশমিক ৬০ শতাংশ শিশু মাদকের ভয়াল ছোবলের শিকার। কেন এই অবক্ষয়? তা নিয়ে জাগো নিউজে থাকছে চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আজ চতুর্থ ও শেষ পর্বে থাকছে একেবারেই নতুন এক পদ্ধতিতে বিত্তশালীদের সন্তানদের মাদকে ডুবে যাওয়ার গল্প।

রাজধানী ঢাকার বিত্তশালী পরিবারের কিশোর সন্তানদের টানছে নতুন এক মরণ ছোবল। মাদকের অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার গল্প পুরনো হলেও একেবারে নতুন খোলসে এসেছে ই ‘ই-লাইটার’। ইলেক্ট্রনিক লাইটার বা ই-লাইটারের গল্পে সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে রাজধানীর কিছু কোচিং সেন্টারে এ লাইটার ব্যবহার করে মাদক নেয়ার প্রমাণ মিলেছে। ই-লাইটার ব্যবহার করে যারা মাদক নিচ্ছে তাদের বেশিরভাগই সপ্তম শ্রেণি থেকে এসএসসি-এইচএসসির শিক্ষার্থী।  
 
ই-লাইটারের সাধারণ ব্যবহার কেবল সিগারেট জ্বালানো। তবে কিছু অসাধু বিক্রেতা এর ভেতর সিসার উপাদান, নিকোটিন ঢুকিয়ে বিক্রি করছেন।

সাধারণত এ লাইটারের দাম সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকা হলেও বাংলাদেশে আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এর ভেতর ইয়াবা ঢুকিয়ে তা সেবন করছে কিশোররা।

প্রথম পর্ব : মায়ের ওপর বাবার নিপীড়ন ভুলতে মাদক নেয় মেহেদী

এর ভেতর বিভিন্ন ধরনের মাদক ঢুকিয়ে সেবন করা হলেও বাংলাদেশের বাজারে যেই লাইটারটি পাওয়া যায়, তার ভেতর আগে থেকেই নিকোটিন দেয়া থাকে। এ লাইটারের ধোঁয়া ৫-৭ মিনিটের মধ্যে চলে যায়। আর খুব অল্প সময়ে এ মাদক নেয়া যায়। সেজন্যই দ্রুত বিস্তার লাভ করছে সর্বনাশা এ মাদক সেবন পদ্ধতি।

Incerts
 
সম্প্রতি মালিবাগের উদ্ভাস কোচিং সেন্টারে ‘ক্যাংগারটেক’ ব্র্যান্ডের এই ইলেক্ট্রিক লাইটারের ব্যবহার দেখে এক শিক্ষার্থী তার বাবাকে জানায়। পরে তার বাবা ওই লাইটারটি দেখে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেন।

ই-লাইটারের নামে নতুন এ মাদকের আখড়ার সন্ধানে মাঠে নামেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা। প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের জন্য ১২ জন করে তিনটি টিমে ৩৬ জন কর্মকর্তা ভাগ হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে যান এবং রোগীদের সঙ্গে কথা বলেন। শ্যামলীর ‘নিরাময়’ নামে একটি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ইলেক্ট্রিক লাইটারের মাধ্যমে মাদক নেয়া দুই রোগীকে খুঁজে পান তারা।
 
কোচিং সেন্টার থেকে উদ্ধারকৃত আলামত ও মাদকাসক্তদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দারা সেই লাইটারের খোঁজ শুরু করেন রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে। খোঁজে নেমে রাজধানীর বৃহৎ দুটি শপিংমলে এটি বিক্রির প্রমাণ পান গোয়েন্দারা। জাগো নিউজের পক্ষ থেকেও দুটি শপিংমলের বেশ কয়েকটি দোকানে নিকোটিন দেয়া ই-লাইটার বিক্রি করতে দেখা যায়।

কারা এসব লাইটার কিনছে- বিক্রেতাদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, তিন হাজার টাকার লাইটার তো রাস্তার কেউ কিনবে না।
 
দুই শপিংমলের বেশ কয়েকটি দোকান থেকে ভিন্ন ভিন্ন ই-লাইটারের নমুনাও সংগ্রহ করেছেন গোয়েন্দারা। লাইটারটি ল্যাবে টেস্ট করতে দিলে লাইটারের ভেতরে থাকা মাদকের বিষয়ে জানতে পারেন বিশেষজ্ঞরা। রিপোর্টে এ লাইটারে উচ্চমাত্রার নিকোটিন পাওয়া যায়।

Incert

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ল্যাবে পরীক্ষিত রিপোর্টটিতে লেখা ছিল, ইলেক্ট্রিক লাইটারটি ধোঁয়া সৃষ্টিতে সহায়ক। এর ভেতরের ক্যামিকেলের নমুনায় উচ্চমাত্রায় নিকোটিন পাওয়া গেছে। এই নিকোটিনের পরিমাণ ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে; যা একটি সাধারণ সিগারেটের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর।
 
ঢাকার বেশিরভাগ কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থীরা এ মাদকের ব্যবহার করছে বলে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে জাগো নিউজকে নিশ্চিত করেছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) নজরুল ইসলাম শিকদার।

গোয়েন্দাদের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যায়ে কেবল উচ্চবিত্তরাই এ মাদক নিচ্ছে বলে তথ্য আছে গোয়েন্দাদের কাছে। কারণ, আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা দিয়ে লাইটার কিনে অতিরিক্ত মাদক ঢুকিয়ে কেনা সাধারণ আসক্তদের পক্ষে সম্ভব নয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থীর মা জাগো নিউজকে বলেন, আমার অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলেকে মডেল টেস্ট দেয়ার জন্য এক মাস কোচিং সেন্টারে দেই। মডেল টেস্ট হওয়ার কারণে ছেলে সারাদিন কোচিংয়েই থাকতো। দুই সপ্তাহ পর দেখি ছেলের চোখের নিচে কালো হয়ে গেছে। তার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম সে লাইটার থেকে মাদক নিচ্ছে।  

তিনি প্রশ্ন রাখেন, কোচিং সেন্টারের কেউ বিষয়টা জানে না, না কি নিজেদের সুনাম নষ্টের ভয়ে আমাদের জানায়নি?

দ্বিতীয় পর্ব : বন্ধুর হাত ধরেই মাদকের কবলে শিশুরা

প্রতিষ্ঠানের ভেতর ই-লাইটার ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়ার বিষয়ে মালিবাগের উদ্ভাস কোচিং সেন্টারের ইনচার্জ মো. নাজমুল জাগো নিউজকে বলেন, ‘উদ্ভাসের ক্লাসরুমে এ ধরনের মাদক নেয়া হয় বলে আমার জানা নেই। কেউ অভিযোগও করেনি। আমাদের অফিসরুমগুলোতে সিসি ক্যামেরা রয়েছে, ক্লাসরুমে নেই। তবে আমরা নিয়মিত শিক্ষার্থীদের মনিটর করি।’
 
ই-লাইটার ব্যবহার করে মাদক সেবনের বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) নজরুল ইসলাম সিকদার বলেন, নতুন এ মাদকের বিষয়টি সম্পর্কে আমরা জ্ঞাত রয়েছি। এটা শুধু নিকোটিন সেবন নয় বরং সব ধরনের ‘হার্ড ড্রাগ’ তরল করে ব্যবহারের উপযোগী। আমরা বাবা-মাকে তার সন্তানের প্রতি এবং কোচিং সেন্টারগুলোকে তাদের শিক্ষার্থীদের প্রতি নজরদারি করার আহ্বান জানাচ্ছি। অনেক শিশু দিনের অধিকাংশ সময় কোচিং সেন্টারে থাকে। কোচিং সেন্টারে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়ে তাদের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে আনা উচিত।’

তিনি আরো বলেন, অধিকাংশ শিক্ষিত ও বিত্তশালীর সন্তানরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কোচিং সেন্টারে বন্ধুদের সঙ্গে মাদকাসক্ত হয়। নতুন এ মাদকের ব্যবহার বন্ধে শিগগিরই কোচিং সেন্টারগুলোতে অভিযান চালানো হবে।

তৃতীয় পর্ব : শৈশব পেরোনোর আগেই সাত ধরনের মাদকাসক্তি
 
এদিকে বিত্তশালীদের সন্তানদের মাদকের পথে পা বাড়ানোর বিষয়ে ২০১৫ সালের ‘মাই ড্যাড ওয়ান্ডারফুল’ স্বীকৃতি পাওয়া নাট্যব্যক্তিত্ব ও সফল বাবা ড. ইনামুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘যারা মাদকের ব্যবসা করে তাদের চোখ প্রধানত বিত্তশালীদের সন্তানদের ওপর। বিত্তশালীরা তাদের সন্তানের সব খরচের জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখে। তবে কাজ ও ব্যস্ততার ভিড়ে তাদের সন্তানরা এমনিতেই বাড়ি থেকে লেফট আউট করে এবং মাদকের পথে পা বাড়ায়। দেশের ক্ষতি করে। আমার মতে বিত্তশালীদের দেশপ্রেমের অভাব রয়েছে। তা না হলে তারা সন্তানকে ঠিকভাবে দেখভাল করতেন, দেশের উন্নয়ন করার জন্য সন্তানকে প্রস্তুত করতেন।’

এআর/এসএম/এনএফ/আরআইপি

আরও পড়ুন