বন্ধের পথে এমারেল্ড অয়েল
কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি ও ঋণ পরিশোধের কথা বলে ২০১৩ সালে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ২০ কোটি টাকা উত্তোলন করে এমারেল্ড অয়েল। তবে তালিকাভুক্তির তিন বছরের মাথায় প্রতিষ্ঠানটির ঋণের বোঝা কমেনি উল্টো বেড়েছে। প্রায় ৯ মাস ধরে বন্ধ শেরপুরের কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম। রাজধানীর বিজয়নগরে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়টিও বন্ধ থাকে বেশিরভাগ সময়।
শেরপুরের কারখানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ। শুধু একজন নিরাপত্তারক্ষী এবং তত্ত্বাবধায়ক আছেন। আর ঢাকা অফিসে একাধিক দিন গিয়েও কাউকে পাওয়া যায়নি।
নাম না প্রকাশের শর্তে কোম্পানির উৎপাদন কাজে জড়িত এক কর্মকর্তা জানান, ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি ছেড়েছেন। তবে মাঝে মধ্যে কয়েকজনকে কিছু বেতন দেয়া হয়।
শেরপুরের কারখানার উৎপাদন বন্ধের বিষয়ে এমারেল্ড অয়েলের পরিচালক সজন কুমার বশাক জাগো নিউজকে বলেন, কিছু সমস্যা হচ্ছে। তবে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলা এজন্য দায়ী। আশা করছি ফেব্রুয়ারি থেকে আবার উৎপাদনে যেতে পারবো।
এর আগে গত ২০ আগস্ট থেকে উৎপাদন শুরুর ঘোষণা দিয়েছিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কিছু সমস্যার কারণে উৎপাদন শুরু হয়নি। অনেকে চাকরি ছেড়েছেন। আমরাও কিছু ছাঁটাই করেছি। তবে ফেব্রুয়ারি থেকে উৎপাদনে যেতে পারবো।
ঢাকা অফিস না খোলার বিষয়ে তিনি বলেন, বিজয়নগরের অফিস খোলা হয়। তবে অফিসের আগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান অর্থ কর্মকর্তা এখন নেই। অন্যজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এদিকে বেসিক ব্যাংকের টাকা জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতের অভিযোগ রয়েছে এমারেল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হাসিবুল গনি গালিবের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বেসিক ব্যাংকের জালিয়াতি ধরা পড়ায় ২০১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর মোট ৫৪টি মামলার অনুমোদন দেয় দুদক। এ ঘটনায় গালিবের বিরুদ্ধে পৃথক পাঁচটি মামলা হয়। ২০১৬ সালের ২৭ মার্চ দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল তাকে গ্রেফতার করে।
মামলায় ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে গালিবের জামিন নামঞ্জুর হলে তিনি হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেন। হাইকোর্ট ওই বছরের জুনে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিলে তিনি মুক্তি পান। তবে হাইকোর্টের জামিন আদেশ স্থগিত চেয়ে দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষ পৃথক আবেদন চেম্বার বিচারপতির আদালতে উঠলে গত ২৮ জুলাই জামিন বাতিল করেন হাইকোর্ট।
এ বিষয়ে এমারেল্ড অয়েলের পরিচালক সজন কুমার বশাক জাগো নিউজকে বলেন, এমডি না থাকায় নানা সমস্যা হচ্ছে। আমরা নতুন এমডি নিয়োগও দিতে পারছি না।
এমারেল্ড অয়েলের আর্থিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির মুনাফায় ধস নেমেছে। কোম্পানির ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ব্যবসায় ৯৭ দশমিক ৩২ শতাংশ মুনাফা কমেছে। প্রথম প্রান্তিকে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৩ পয়সা, যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরের একই সময়ে হয়েছিল ১ টাকা ১২ পয়সা। এ হিসাবে ইপিএস কমেছে ১ টাকা ৯ পয়সা।
ব্যবসায় সম্প্রসারণের লক্ষে যেকোনো কোম্পানি বোনাস শেয়ার দিলেও এমারেল্ড অয়েলের ক্ষেত্রে ভিন্ন। উৎপাদন বন্ধ হলেও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ব্যবসায় ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার ঘোষণা করে। তবে ১০ শতাংশ হারে নগদ লভ্যাংশ দিতে ৫ কোটি ৪৩ লাখ টাকা দরকার হলেও আছে মাত্র ৯৭ লাখ টাকা। আর চলতি অর্থবছরের (২০১৬-১৭) প্রথম প্রান্তিকে প্রতিটি শেয়ারে নিট অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ১২ পয়সা।
ঋণ পরিশোধের কথা বলে এমারেল্ড অয়েল শেয়ারবাজার থেকে ২০ কোটি টাকা সংগ্রহ করলেও তালিকাভুক্তির প্রথম বছরেই কোম্পানিটির ঋণের পরিমাণ বেড়ে যায়। কোম্পানি তালিকাভুক্তির প্রথম বছরেই ঋণ পরিশোধের পরিবর্তে নিট ১০ কোটি ৩ লাখ টাকার ঋণ বাড়ে।
প্রসপেক্টাস অনুযায়ী, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির সময় এমারেল্ড অয়েলের মোট ঋণ ছিল ৭৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, যা গত ৩০ সেপ্টেম্বর দাঁড়িয়েছে ১২২ কোটি ৪৯ লাখ টাকায়। এ হিসাবে ঋণ বেড়েছে ৪৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
এদিকে কোম্পানিটি ২০১৩ সালে আইপিও’র মাধ্যমে ২০ কোটি টাকা সংগ্রহের সঙ্গে ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ারের মাধ্যমে আরও ২ কোটি ৩৫ লাখ টাকার মূলধন বাড়ায়। এরপর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১০ শতাংশ বা ৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকার বোনাস শেয়ার দেয়। এরপরও নিয়মিতভাবে ঋণে জড়াচ্ছে কোম্পানিটি।
বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক হিসাব মান অনুযায়ী, গ্রাহকের কাছে বকেয়া পাওনার ওপর সঞ্চিত গঠন করতে হয়। ভবিষ্যৎ সৃষ্ট ঝুঁকির হাত থেকে রক্ষা পেতে এ সঞ্চিতি গঠন করা হয়। এ হিসাবে এমারেল্ড অয়েল কোম্পানির সঞ্চিতি গঠন করা আবশ্যক। কারণ এমারেল্ড অয়েল বিভিন্ন গ্রাহকের কাছে ৭২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। যেসব টাকা শতভাগ পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ অনাদায়ী পাওনা সঞ্চিতি গঠন না করে মুনাফা বেশি দেখিয়েছে।
এমারেল্ড অয়েল কর্তৃপক্ষ প্রতারণা করছে কোম্পানিটির শ্রমিকদের সঙ্গেও। ২০০৬ সালের শ্রম আইন অনুযায়ী কোম্পানিটি ফান্ড গঠন করলেও শ্রমিকদের মধ্যে তা বিতরণ করছে না। কয়েক বছরে কোম্পানিটি শ্রমিকদের জন্য ২ কোটি ৩২ লাখ টাকার ফান্ড গঠন করে। কিন্তু কোথাও বিনিয়োগ করেনি।
এ বিষয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. বখতিয়ার হাসান জাগো নিউজকে বলেন, একটি কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির মাত্র ৩ বছরের মাথায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম ভয়ঙ্কর ব্যাপার। এমন কোম্পানি বাজারে আসলে বিনিয়োগকারীদের আস্থার ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তিনি বলেন, উৎপাদন বন্ধের পর নতুন উৎপাদনের ঘোষণা দিয়েও না করা বড় ধরনের অপরাধ। এতে বোঝা যায়, ওই ঘোষণার পেছনে কর্তৃপক্ষের অসৎ উদ্দেশ্য ছিল। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) উচিত দ্রুত কোম্পানিটির বিষয়ে খোঁজ নিয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া।
এমএএস/এএইচ/পিআর