ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

সুযোগের জানালা খুলে দিতে হবে

প্রকাশিত: ০৯:১৮ এএম, ১৮ জানুয়ারি ২০১৭

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে অর্থনীতি বিষয়ে অধ্যাপনা করছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। শ্রমবাজার, কর্মসংস্থান, কর্মমুখী শিক্ষাসহ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ-এর। বলেন, গণতন্ত্র, সুশাসন এবং জবাবদিহিতা ছাড়া উন্নয়ন গণমানুষের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। দীর্ঘ আলোচনায় উঠে আসে ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদে পরিবর্তনের বিষয়টিও। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু ও শফিকুল ইসলাম।

জাগো নিউজ : সিডারের গবেষণায় নিষ্ক্রিয় তরুণ বেকারদের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। এই তরুণ বেকারদের নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
সালেহউদ্দিন আহমেদ : এটি সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর চিত্র বলে মনে করি। আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে কর্মক্ষম মানুষের কাজে লাগাতে পারছি না। তরুণদের দক্ষতা বাড়িয়ে শ্রমবাজারে কাজে লাগাতে না পারলে সামাজিক অস্থিরতা আরও বাড়বে।

জাগো নিউজ : বেকারদের প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ তরুণ উচ্চশিক্ষিত, যারা কোনো প্রকার কাজে নেই বলে ওই প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখানো হয়েছে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ : একটি চিত্র সহজেই অনুমেয়। প্রতি বছর বহু তরুণ অনার্স-মাস্টার্স পাস করে বের হচ্ছেন। অনেকেই প্রথমসারির বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বের হচ্ছেন। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠান যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মী খুঁজলে তখন আর মিলছে না।
 
দক্ষতাসম্পন্ন জনবলের খুবই অভাব। আমি ব্যাংকে থাকা অবস্থায় দেখেছি, একজন চাকরিপ্রত্যাশী যুবক হয়তো তার জীবনবৃত্তান্তে লিখেছেন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু প্রায়োগিক দক্ষতায় সে কিছুই জানে না।
 
ভারত থেকে দক্ষ জনবল এনে ব্যাংকগুলোতে প্রযুক্তি সাপোর্ট নেয়া হয়। এতো শিক্ষিত যুবক থাকতে যখন বাইরে থেকে জনবল আনা হয়, তখন বুঝতে হবে কোথাও না কোথাও গলদ আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ জালিয়াতি এর বাস্তব উদাহরণ।
Incert

জাগো নিউজ:  কিন্তু অনেকে তো ভালোও করছেন?
সালেহউদ্দিন আহমেদ : যারা ভালো করছেন, তারা কদরও পাচ্ছেন। কিন্তু সংখ্যার দিকটিও আমলে নিতে হবে।
অনেকেই এমবিএ-বিবিএ পাস করে বোঝাতে চান অনেক শিক্ষিত হয়ে গেছেন। দেখেন কত এমবিএ শেষ করা যুবক বেকার। তারা কোনো কাজ পাচ্ছেন না।

এটি মনোভাবেরও ব্যাপার। গার্মেন্টের জন্য একটি ফ্যাশন টেকনোলজি ইনস্টিটিউট রয়েছে। কিন্তু মেধাবীরা সেখানে পড়ে না। অথচ বাইরে থেকে লোক এনে কাজ করানো হচ্ছে। একইভাবে সিরামিক বা লেদার ক্ষেত্রেও দক্ষ জনবল পাবেন না। বিদেশিরা এসে বলে বাংলাদেশের লোকরা শিখতে চায় না।
 
জাগো নিউজ : এই শিক্ষিত যুবকরাই দেশের বাইরে গিয়ে কুলির কাজ করছে। অথচ দেশে শিখতে চায় না, এর কারণ কী?
সালেহউদ্দিন আহমেদ : প্রথমত দেশের মধ্যে কাজের মূল্যায়ন হয় না। শিখে একজন যুবক কাজে যোগদান করলেও তার যথাযথ বেতন হয় না। দ্বিতীয়ত সামাজিক স্ট্যাটাস। রাষ্ট্র, সমাজই এমন পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছে। নিম্ন শ্রেণির কাজ হলে সমাজ তাকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে চায় না। এ পরিস্থিতি অনেক দেশেই নেই। একজন সিরামিক মিস্ত্রিও সে দেশে সচিবের স্ট্যাটাস ধারণ করতে পারেন।

একবার ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক কানাডিয়ান আসলেন। আমি জিজ্ঞাস করলাম, আপনি কী করেন? বললেন, সিল্ক ডিজাইনার। তাকে নিয়ে এসেছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক। আমাদের দেশে কল্পনাই করা যায় না। আমরা হয়তো নিয়ে যাব রেশম বোর্ডের একজন কর্মকর্তাকে, যিনি রেশম সম্পর্কে কিছুই জানেন না। অথচ সেখানে দক্ষ জনবল থাকলেও তাকে সঙ্গে নিচ্ছি  না। সুতরাং সুযোগের জানালা খুলে দিতে হবে।
Incert

জাগো নিউজ : এর জন্য শিক্ষাব্যবস্থাকে কতটুকু দায়ী করবেন?
সালেহউদ্দিন আহমেদ : শিক্ষার দুটি উদ্দেশ্য থাকে। প্রথমত নিজের ভাগ্য উন্নয়ন। দ্বিতীয়ত সমাজের জন্য কিছু করতে পারা। সত্যিকার শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারলে সমাজের জন্য এমনিতেই কিছু করা হয়ে যায়।
 
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সামাজিক দায়ের বিষয়টি অনেকটাই অনুপস্থিত। মূলত কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুত্ব না থাকার কারণেই সমাজের প্রতি দায় কাজ করে না। একজন শিক্ষিত তরুণ নিজেকে নিয়ে ভাবলেই তো সমাজের ভাবনা হয়ে যায়। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে ভাবতে শেখাচ্ছে, যা সমাজ থেকে আলাদা করে। শিক্ষায় সঠিক অর্থে কোনো পরিকল্পনা নেই। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্পর্ক থাকবে। কিন্তু এখানে তা নেই।

সার্বজনীন নীতির প্রতিফলনের চেয়ে ব্যক্তি চেতনা বা দলের আদর্শও এখন শিক্ষায় গুরুত্ব পাচ্ছে। আবার পাঠ্যবই ভুলে ভরা। সবই তো এখন পরিষ্কার। এসবের কারণেই শিক্ষার মৌলিক বিষয় নৈতিক জ্ঞান উবে যাচ্ছে।

জাগো নিউজ : এর জন্য আর কাকে দায়ী করবেন?
সালেহউদ্দিন আহমেদ : যারা মানুষ গড়ার কারিগর, সেই শিক্ষকদের মানও আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। আমাদের সময় একজন বিজ্ঞান বা অঙ্কের শিক্ষক যে জ্ঞান নিয়ে শিক্ষা দিতেন এখন শিক্ষকরা তার ধারে কাছেও যেতে পারবেন না।  শিক্ষকদের আর আগের মতো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয় না। অন্যদিকে প্রশিক্ষিত ভালো শিক্ষকদের মূল্যায়নও করা হয় না। শিক্ষক রাজনীতি তো আছেই।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষার জন্য যে বরাদ্দ তার অধিকাংশই চলে যায় শিক্ষকদের বেতনের জন্য। শিক্ষার উপকরণের জন্য ব্যয় নেই বললেই চলে। পরিবর্তন আনতে হলে আপনাকে সামগ্রিক দিক থেকে ভাবতে হবে। একটি দিক অন্ধকারে রেখে আলোর সঠিক বিস্তার ঘটানো যায় না।

জাগো নিউজ : এই নিষ্ক্রিয় করে তোলার শিক্ষাব্যবস্থা জাতিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
সালেহউদ্দিন আহমেদ : আমরা কোথায় যাচ্ছি, তা আর বিশ্লেষণের দরকার পড়ে না। শিক্ষায় ত্রুটি আছে বলেই এত বেকারত্ব, সমাজে এত অস্থিরতা।

জাগো নিউজ : উত্তরণের উপায় কী?
সালেহউদ্দিন আহমেদ : সমস্যাগুলো চিহ্নিত হয়েছে। এখন তা শুধু আমলে নেয়া। সরকারের পক্ষে এককভাবে সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব না। প্রয়োজনে বেসরকারি উদ্যোগকেও কাজে লাগাতে হবে।
Incert

জাগো নিউজ : এর জন্য রাষ্ট্র, রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থারও দরকার?
সালেহউদ্দিন আহমেদ : গণতন্ত্র এবং সুশাসন পাশাপাশি অবস্থান করে। কেউ যদি বলে গণতন্ত্র রেখে উন্নয়ন, তাহলে সেটা ভুল ধারণা। কারণ এই ধরনের উন্নয়ন প্রথমত টেকসই  হয় না। দ্বিতীয়ত, এমন উন্নয়ন থেকে সবাই সুবিধা পায় না।

শুধু উন্নয়নের উদাহরণ দিয়ে কয়েকটি কমিউনিস্ট বা স্বৈরাচারী দেশকে সামনে আনলেই হবে না। ওই সব দেশের ভেতরের খবর অনেকেই জানি না। বাইরে থেকে অনেক ভালো কিছু দেখতেই পারেন। কিন্তু ভেতরে অন্য খবরও মিলতে পারে।
 
জাগো নিউজ : ওই সব দেশের দৃশ্যত সফলতা সামনে আসতেই পারে?
সালেহউদ্দিন আহমেদ : বাংলাদেশের জন্ম তো এমন সফলতার জন্য না। গণতন্ত্রের জন্য মুক্তিযুদ্ধ। সেই গণতন্ত্রকে আড়াল করে আপনি উন্নয়নের কথা বলতে পারেন না। হংকং, সিঙ্গাপুর ছোট্ট দেশ। সেই সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা চলে না। জনগণের অংশগ্রহণ অর্থাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণে মানুষের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা দেয়াই হচ্ছে উন্নয়নের পূর্বশর্ত।

সিদ্ধান্ত একপেশে হলে উন্নয়নের সুবিধা সবার দ্বারে পৌঁছায় না। মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা হরণ করে কোনো উন্নয়ন হতে পারে না। একপেশে সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে দুর্নীতির চিত্রও পাল্টে গেছে। এখন দেখবেন, ছোটখাটো ঘুষ আর কোনো বিষয় না। বড় বড় প্রকল্পে বিভিন্ন কায়দায় দুর্নীতি হচ্ছে। প্রকল্প সময়-ব্যয় বাড়িয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করা হচ্ছে। এক বছরের কাজ শেষ করতে সময় লাগছে তিন বছর। ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন সড়ক, ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন সড়ক এর বাস্তব উদাহরণ। এক কোটি টাকার কাজ হচ্ছে দশ কোটি টাকায়।

গণতন্ত্র, সুশাসন, জবাবদিহিতা না থাকলে রাষ্ট্রে যা ইচ্ছা তাই হয়। এখন অনেকটা তাই হচ্ছে। গণতান্ত্রিক সমাজে প্রতিটি মানুষই অডিটর হিসেবে কাজ করে থাকেন। গ্রামে একটি রাস্তা হলে সবাই খবর রাখেন। এখন আর সে সুযোগ নেই। মানুষ চাইলেও কিছু বলতে পারে না। কারণ কেউ তো সমাজের জন্য দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনতে চাইবে না।

এএসএস/এসআই/এআরএস/পিআর

আরও পড়ুন