বাজেট বাস্তবায়নে গতি আনতে সরকারের নানা উদ্যোগ
জাতীয় বাজেটের আকার প্রতিবছর বাড়লেও বাস্তবায়নের হার ক্রমান্বয়ে কমছে। প্রতি অর্থবছরের শুরুতে যে বাজেট ঘোষণা করা হয় বাস্তবে তা ব্যয় হচ্ছে না। প্রতিবছর বরাদ্দ বাড়লেও আগের চেয়ে আনুপাতিক হারে ব্যয় কম হচ্ছে। ফলে বাজেটের প্রাক্কলন এবং প্রকৃত ব্যয়ের পার্থক্য ক্রমশ বাড়ছে। তাই বড় বাজেট ঘোষণা করে সরকার বাহবা পেলেও এর বাস্তবায়ন না হওয়ায় সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নেও হতাশাজনক চিত্র দেখা গেছে। বাজেট নিয়ে ধারাবাহিক তিন পর্বের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।
বিগত পাঁচ বছর ধরে জাতীয় বাজেট বাস্তবায়নের হার ক্রমন্বয়ে কমছে। তাই বাজেট বস্তবায়নের সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। নেয়া হয়েছে নানা উদ্যেগ। অর্থ অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ সংশ্লিষ্ট অনেক প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো ব্যয় করতে পারে না। ফলে জাতীয় উন্নয়নে নেয়া প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হয় ধীরগতিতে। তাই ব্যয় সক্ষমতা বাড়ানো খুবই জরুরি। এ বিষষে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দক্ষ করে তোলার জন্য বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে সরকার।
সূত্র জানায়, বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ের মতো বাড়ানোর বিষয়ে নজরে এনে উদ্যোগ নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এরই অংশ হিসেকে প্রত্যেক মন্ত্রণালয়কে প্রতি তিন মাসে বাজেট বাস্তবায়নের তথ্য বাধ্যতামূলকভাবে অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানাতে বলা হয়েছে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা এক পরিপত্রে এসব কথা বলা হয়।
এছাড়া সামগ্রিক আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও বাজেট বাস্তবায়ন সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘ফিসক্যাল ইকনোমিক্স অ্যান্ড ইকনোমিক ম্যানেজমেন্ট (ফিম) কোর্সের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এ প্রশিক্ষণটি এর আগে বৈদেশিক সহায়তায় করা হলেও এবারই প্রথম বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নের করা হচ্ছে।
সূত্র আরও জানায়, বিপুলসংখ্যক আবেদনকারী কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রতিটি কোর্সে মোট ২৫ প্রশিক্ষণার্থীকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়। কোর্সটিতে সামগ্রিক আর্থিক ব্যবস্থাপনা, সামষ্টিক অর্থনীতি, আর্থিক কাঠামো সংস্কার, বাজেট ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত বিষয়গুলো এবং রাষ্ট্রের উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন সংশ্লিষ্ট সমসাময়িক বিষয়গুলোর ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এছাড়া বছর বছর বাড়ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার। তবে বাড়ানো যাচ্ছে না বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যবহারের সক্ষমতা। তাই অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এডিপি বাস্তবায়ন চিত্র থাকে হতাশাজনক। অবশ্য বছর শেষে জুনে তড়িঘড়ি করে দেখানো হয় উন্নয়ন ব্যয়।
এ চিত্র প্রতি বছরের এবং বহুকাল ধরেই চলে আসছে। কিন্তু এবার এ চিত্রের পরিবর্তন ঘটাতে চায় সরকার। তাই এডিপি বাস্তবায়নে গতি আনতে কাঠামোগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে করা হচ্ছে নীতিমালা। এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবনা তৈরি করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। সেখানে প্রস্তুতিমূলক কাজের সময় কমিয়ে আনার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। নতুন প্রস্তাবে গুরুত্ব পেয়েছে বাস্তবায়ন সংক্রান্ত নানা দিক।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের নতুন পর্যবেক্ষণ বলছে, নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পে মূল কাজ শুরু করতেই চলে যায় দেড় বছর। বলা হয়, প্রকল্প অনুমোদনের পর সমীক্ষা, ভূমি অধিগ্রহণ, পরামর্শক ও বিশেষজ্ঞ নিয়োগসহ পূর্ত কাজের টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে এ সময় লাগে। এ বিলম্ব এড়াতে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন পর্যায়ে কাঠামো ও পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
এ লক্ষ্যে তৈরি করা হয়েছে ‘প্রকল্পের প্রস্তুতিমূলক কাজের অর্থ বরাদ্দ ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালা’ এবং ‘প্রকল্পের প্রস্তুতি কাজের চেকলিস্ট’। এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে পৃথক ‘উন্নয়ন ব্যয় খাত’। নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পের প্রস্তুতিমূলক কাজ ছয় মাস এবং বৈদেশিক অর্থায়নপুষ্ট প্রকল্পের প্রস্তুতিমূলক কাজ নয় মাসের মধ্যে সম্পন্ন করারও সুপারিশ করেছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, গত পাঁচ অর্থবছরে এডিপির আকার পাঁচগুণ এবং বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ আড়াইগুণ বেড়েছে। কিন্তু বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যবহারে সক্ষমতার ঘাটতি থাকায় প্রায় প্রতি অর্থবছরই এডিপি বরাদ্দ ও আরএডিপিতে বরাদ্দ কমানোর প্রয়োজন হয়।
এ লক্ষ্যে প্রকল্পের ডিপিপি/টিপিপি অনুমোদনের আগে প্রকল্প প্রণয়ন ও প্রস্তুতিমূলক কাজের অর্থ বরাদ্দের জন্য অর্থের উৎস ও খাত, প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ ও অনুমোদন, অর্থের ব্যবহার ও তদারকি ইত্যাদি বিষয়ে দিকনির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত করে তৈরি করা হয়েছে ‘প্রকল্পের প্রস্তুতিমূলক কাজের অর্থ বরাদ্দ ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালা’।
এছাড়া ‘প্রকল্পের প্রস্তুতিকাজের চেকলিস্ট’ও করা হয়েছে। চেকলিস্টে বলা হয়েছে, প্রকল্পে বৈদেশিক সাহায্য সংগ্রহকারী কর্তৃপক্ষ কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে পারবে। জিওবি অর্থায়িত ও বৈদেশিক অর্থায়নে গৃহীত প্রকল্পের জন্য দুটি চেকলিস্টের খসড়া করা হয়েছে। জিওবি অর্থায়িত প্রকল্পের চেকলিস্টে তিন ধাপে মোট ২০টি করণীয় এবং বৈদেশিক অর্থায়নপুষ্ট প্রকল্পে চার ধাপে ২২টি করণীয় তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। জিওবি অর্থায়নে বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্পের প্রস্তুতিমূলক কাজ অনধিক ছয় মাস এবং বৈদেশিক প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ থাকলে অনধিক নয় মাসের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতাই প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির প্রধান কারণ। এর বড় উদাহরণ ঢাকা-চট্রগ্রাম চার লেন প্রকল্প। তাই প্রকল্প গ্রহণের আগেই যদি আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করা যায় তাহলে কাজে গতি আসবে। বছর শেষে বাস্তবায়নের জন্য তাড়াহুড়া করতে হবে না।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআইএর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতা অবশ্যই বাড়াতে হবে। না হলে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেন, চাহিদা অনুযায়ী আরও বড় বাজেট করা দরকার। কিন্তু পারা যাচ্ছে না। কারণ রাজস্ব আদায় কম। আয় না বাড়ালে বড় বাজেট করা সম্ভব নয়।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরও বাজেট বাস্তবায়ন হচ্ছে ধীরগতিতে। অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) ব্যয় হয়েছে মাত্র ৪১ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের মাত্র ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩৭ হাজার ১২১ কোটি টাকা, যা ছিল মোট বাজেটের ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৩৬ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ।
সূত্র জানায়, চলতি (২০১৬-১৭) অর্থবছরের মোট বাজেটের আকার ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছর সরকারের ব্যয়ের পরিকল্পনা ছিল ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় ২ লাখ ৬৪ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা। সেই হিসাবে সংশোধিত বাজেটের তুলনায় নতুন বাজেটের ব্যয় লক্ষ্যমাত্রা ২৯ শতাংশ বেশি।
এমইউএইচ/এমএমজেড/এমএস