ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

শিশুদের টাকা কর্তাদের পকেটে

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ০৮:৩৮ এএম, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬

দেশের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার পৌনে এক লাখ শিশুর জন্য রয়েছে সরকারি বেসরকারি ও বিভিন্ন প্রকল্পভিত্তিক প্রায় ৪০২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ উপজেলাতেই রয়েছে জেলার সর্বাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারের পর্যাপ্ত বরাদ্দ থেকে প্রতিনিয়ত চলছে কর্তা ব্যক্তিদের তহবিল তছরুপ। খাতা-কলমে নাম সর্বস্ব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেও তারা হাতিয়ে নিচ্ছে লাখো টাকা। শিশুদের বিনা পয়সার বই বিক্রি থেকে শুরু করে উপবৃত্তির টাকা পর্যন্ত আত্মসাৎ হচ্ছে। সব মিলিয়ে দুর্নীতির মহোৎসব চলছে এ উপজেলায়। ১০ দিন ধরে পুরো উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষায় দুর্নীতির অনুসন্ধানে চিরুনি অভিযান চালিয়েছেন আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক শাহেদ শফিক। হাতিয়া থেকে ফিরে এ নিয়ে তার ৮ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে সপ্তম পর্ব।
 
Educationনোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার প্রাথমিক স্কুলের শিশুদের জন্য বরাদ্দ উপবৃত্তির কোটি কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে। প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য বরাদ্দ টাকার ৬০ শতাংশ যাচ্ছে একটি চক্রের পকেটে। উপবৃত্তি বিতরণে অনিয়মের প্রতিবাদে বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও স্থানীয় জনগণ স্কুল ঘেরাও করেছে। অভিযোগ ওঠার পর মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে উপবৃত্তির টাকা সরাসরি শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার নিয়ম চালু হলে এই অনিয়ম হাতেনাতে ধরা পড়ে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত অর্থবছর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের হাতে হাতেই উপবৃত্তির টাকা পৌঁছে দেয়া হতো। তখন শতভাগ শিক্ষার্থী এই সুবিধার আওতায় ছিল না। সে সময় হাতিয়া উপজেলায় ৫৪ হাজার ৭৯৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে চার কিস্তিতে ৫ কোটি ১৪ লাখ ৪১ হাজার ১০০ টাকা বিতরণ করা হয়। তখন স্কুলের ৬০ থেকে ৭০ ভাগ শিক্ষার্থী এ সুবিধা পেতো।

চলতি অর্থবছরে শতভাগ শিক্ষার্থীকে সরকার এ সুবিধার আওতায় আনলেও গত বছরের চেয়ে এ বছর সে চাহিদা কমে দাঁড়ায় ৪৬ হাজার ১৮১ জনের বিপরীতে ১ কোট ২১ লাখ ৬ হাজার ৭০০ টাকায়।

শতভাগ শিক্ষার্থী স্কুলের এ সুবিধার আওতায় আসার পর যেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এবং টাকার চাহিদা বাড়ার কথা সেখানে হাতিয়া উপজেলায় কমেছে প্রতি কিস্তিতে গত চাহিদাপত্রের চেয়ে প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী। আনুপাতিক হারে গত বছরের তুলনায় এ বছর চাহিদা অন্তত দ্বিগুণ বাড়ার কথা।

এ বিষয়ে জেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির জাগো নিউজকে বলেন, পুরোটাই অনিয়মে ভরা। গত বছরের তুলনায় এ বছর তো চাহিদা বাড়ার কথা। কিন্তু নিজেদের (শিক্ষক বা উপজেলা শিক্ষা অফিস) হাতে সে সুযোগ না দেয়ায় তারা অনিয়ম করে ভুয়া শিক্ষার্থী দেখাতে পারেনি। তাই চাহিদা কমে গেছে।

জানা গেছে, অনিয়মের অভিযোগ আসার পর সরকার ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে উপবৃত্তির টাকা সরাসরি শিক্ষার্থী বা তাদের অভিভাবকের হাতে পৌঁছে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যখন হাতে হাতে টাকা পৌঁছে দেয়া হতো তখন স্কুল শিক্ষক, সভাপতি ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা ভুয়া শিক্ষার্থী দেখিয়ে অধিকাংশ টাকা আত্মসাৎ করতেন। ব্যাংকিং সিস্টেম চালু করায় তারা সেটা করতে পারেননি বলেই এ বছর শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে।

Upokul

শতভাগ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তির আওতায় আনা হলেও বিগত বছর থেকে এ বছর চাহিদা কমলো কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, দেখেন আগে কী হয়েছে না হয়েছে তা আমি জানি না। আমার সময় থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হাতে টাকা দেয়া হচ্ছে। এখন কোনো অনিয়মের সুযোগ নেই। সে হিসেবে চাহিদা কমতে পারে।
 
উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, ব্যাংক কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে উপবৃত্তির টাকা বিতরণ করার কথা। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে এ নিয়ম মানা হয়নি। প্রধান শিক্ষকের চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংক কর্মকর্তারা পুরো টাকা প্রধান শিক্ষক ও সভাপতির হাতে তুলে দিতেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ ও ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে সুন্দর ও সফলভাবে টাকা বিতরণ হয়েছে বলে একটি প্রত্যয়নপত্র দিয়ে দেয়।

বিষয়টি স্বীকার করে উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ভবরঞ্জন দাস জাগো নিউজকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী উপবৃত্তির টাকা কোনো শিক্ষক বা কমিটির হাতে তুলে দেয়ার কথা নয়। কিন্তু ব্যাংকে জনবলের অভাবে তা শিক্ষকদের হাতে তুলে দেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা।

Upokul

নিয়ম অনুযায়ী একজন শিক্ষার্থী প্রতি মাসে গড়ে একশ টাকা করে ১২ মাসে চার কিস্তিতে ১২শ টাকা পাবে। কিন্তু প্রধান শিক্ষকরা অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে মাত্র ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা দিয়ে বাকি টাকা বিভিন্ন অযুহাতে আত্মসাৎ করেন।

উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, উপবৃত্তি বিতরণে অনিয়মের অভিযোগে কাউনিয়া, পশ্চিম সুখচর, দক্ষিণ বিরবিরি, মৌলভী আব্দুল খালেক, তমরুদ্দি সিরাজিয়া, উত্তর চর ঈশ্বরায় হালিমা, উত্তর পূর্ব হরনী, পশ্চিম গুল্যাখালী, পশ্চিম চর আমানুল্যা, উত্তর পশ্চিম জাহাজমারা, উমাচরণ, উত্তর চরঈশ্ব রায় হাজি আব্দুল হাদিসহ বেশ কয়েকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে।

এদের কেউ পূর্ণ টাকা বিতরণ করেনি। এ নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে প্রধান শিক্ষকদের বাগবিতণ্ডা হয়েছে। কোথাও কোথাও ঝাড়ু মিছিল থেকে শুরু করে মারামারিও হয়েছে।

উত্তর চরঈশ্বর রায় হালিমা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে উপবৃত্তির অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে স্থানীয় জনতা ২০ জুলাই সকালে বিদ্যালয় ঘেরাও করলে প্রশাসনের সহযোগিতায় পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। উপজেলা শিক্ষা অফিসার তাৎক্ষণিকভাবে তাকে শোকজ করেন।

Upokul

সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারায় এই প্রধান শিক্ষককে কাউনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়। কিন্তু তিনি সেখানে যোগ দেননি। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আরো সুনাম সম্পন্ন একটি বিদ্যালয় পশ্চিম চরলটিয়া স্কুলে তাকে বদলি করেছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ২৪ জুন ওই স্কুলগুলোর একাধিক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে স্বাক্ষর নিয়ে তাদের পুরোপুরি টাকা দেয়া হয়নি। উপজেলা শিক্ষা অফিসে সেসব শিক্ষার্থী ও তদের অভিভাবকরা লিখিত অভিযোগ করেন।  

পশ্চিম সুখচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে টাকা বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের প্রতিবাদে ২৪ জুন রোববার বিকেলে অভিভাবকরা ঝাড়ু নিয়ে শিক্ষকদের তাড়া করে ও বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের অবরুদ্ধ করে রাখেন। সেন্টার বাজারে শতশত অভিভাবক রাস্তা অবরোধ করে মানববন্ধন করেন। খবর পেয়ে সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ভবরঞ্জন দাস ঘটনাস্থলে গিয়ে পুরো টাকা পরিশোধের আশ্বাস দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেন।

Upokul

এছাড়া উত্তর পূর্ব চরঈশ্বর রায় হালিমা ও পশ্চিম গুল্যাখালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও সীমাহীন অনিয়ম হয়েছে। এই অনিয়মের চিত্র ধরা পরায় স্কুলটির পশ্চিম গুল্যাখালি সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জিন্নাত আরা বেগমকে আলাদি গ্রাম ও সহকারী শিক্ষক এবিএম মাঈদুল ইসলাম মিঠুকে শাস্তিস্বরূপ নিঝুমদ্বীপ বাতায়ন কিল্লায় বদলি করা হয়।

অন্য ৮টি স্কুলকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বিভিন্ন সময়ে এসব স্কুলে উপবৃত্তির টাকা বিতরণে অনিয়মের খবর স্থানীয় একাধিক পত্রিকা প্রকাশ করেছে।

কিছু কিছু অনিয়ম হয়েছে স্বীকার করেছেন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ভবরঞ্জন দাস। তিনি জানান, যাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে তাদের কয়েকজনকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। তবে এ জন্য তিনি শিক্ষার্থীদেরই দায়ী করেন।

Upokul

তিনি বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যেসব শিক্ষার্থী বিভিন্ন শর্ত পূর্ণ করবে না তারা শতভাগ উপবৃত্তি পাবে না। এক্ষেত্রে অনেক শিক্ষার্থীকে নির্ধারিত টাকার চেয়ে কম দেয়া হয়েছে। এখন অনেকে বেশি পেয়েছে, অনেকে কম পেয়েছে। যারা কম পেয়েছে তারাই বিভিন্ন অভিযোগ তুলছে।

কিন্তু শিক্ষার্থীরা বলছে, তারা এ ধরনের ভিত্তিহীন অভিযোগ দিয়েই টাকা আত্মসাৎ করে। অনেক সময় ভুয়া শিক্ষার্থী দেখিয়ে বাম হাতে স্বাক্ষর করে, খাতায় টাকার পরিমাণ উল্লেখ না করে স্বাক্ষর নিয়ে শিক্ষার্থীদের কিছু টাকা দিয়ে বিদায় দেয়। পরে নিজেদের ইচ্ছেমতো টাকার পরিমাণ বসিয়ে বাকিটা আত্মসাৎ করে।

এ ব্যাপারে উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোশারফ হোসেন জানান, অভিযোগ এসেছে ঠিক। তদন্ত করে যেগুলোর বিরুদ্ধে সত্যতা পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

এমএসএস/এনএফ/পিআর

আরও পড়ুন