দফতরি নিয়োগে উপেক্ষিত কমিটির সভাপতি
দেশের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার পৌনে এক লাখ শিশুর জন্য রয়েছে ৪০২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ উপজেলায়ই রয়েছে জেলার সর্বাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারের পর্যাপ্ত বরাদ্দ থেকে প্রতিনিয়ত চলছে কর্তাব্যক্তিদের তহবিল তছরুপ। খাতা-কলমে নামসর্বস্ব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেও তারা হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ টাকা। শিশুদের বিনা পয়সার বই বিক্রি থেকে শুরু করে উপবৃত্তির টাকা পর্যন্ত আত্মসাৎ হচ্ছে। সব মিলিয়ে দুর্নীতির মহোৎসব চলছে এ উপজেলায়। ১০ দিন ধরে পুরো উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষায় দুর্নীতির অনুসন্ধানে চিরুনি অভিযান চালিয়েছেন আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক শাহেদ শফিক। হাতিয়া থেকে ফিরে এ নিয়ে তার ৮ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে ষষ্ঠ পর্ব।
নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে দফতরি কাম নৈশ প্রহরী নিয়োগে লক্ষাধিক টাকা ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও উপজেলা পরিষদের শীর্ষ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে নিয়োগ কমিটির সভাপতিকে উপেক্ষা করে নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন বলেও জানা গেছে।
প্রথম দফায় উপজেলার ১০৫টি স্কুলের মধ্যে ১০৪টি স্কুলে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরই মধ্যে দুই ধাপে ৭০ জনের নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে অনিয়ম ধরা পড়ায় এখন তৃতীয় ধাপে নিয়োগ পাওয়া ৩৪ জনের বেতন-ভাতা আটকে গেছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর সূত্র জানায়, সরকার ২০১২ সালের শুরু থেকে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সম্পূর্ণ অস্থায়ী ভিত্তিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দফতরি কাম প্রহরী নিয়োগ শুরু করে। এজন্য একটি নীতিমালাও করা হয়।
নীতিমালা অনুযায়ী, ২০ নভেম্বরের মৌখিক পরীক্ষায় সর্বাধিক নম্বর পাওয়া ও শারীরিকভাবে যোগ্য তিনজন আবেদনকারীকে বাছাই করার কথা। তাদের মধ্যে একজনকে চূড়ান্ত করে নিয়োগের সুপারিশ করবেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। এরপর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনোনীত প্রার্থীর নাম সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে পত্র দিয়ে জানাবেন। প্রধান শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করবেন।
অধিদফতরের নতুন এই সিদ্ধান্তের ফলে এসব পদে নিয়োগে সংসদ সদস্যের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হলো বলে বিদ্যালয় সভাপতি ও শিক্ষক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাই বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ তোলেন। তাদের আশঙ্কার সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে। এই নীতিমালার সুযোগে দলীয়করণের পাশাপাশি আর্থিক লেনদেনের ঘটনা ঘটছে। এমনকি নীতিমালা লঙ্ঘনের ঘটনাও ঘটেছে। অনিয়মের বিভিন্ন অভিযোগে একাধিক মামলাও হয়েছে।
অনিয়মের অভিযোগে দ্বীপ উপজেলার উত্তর বেজুগালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির বিরুদ্ধে হাতিয়া সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে মামলা করেছেন স্কুলের দাতা পরিবারের সদস্য মো. নূর নবী।
মামলায় তিনি বলেছেন, ইন্টারভিউয়ের নির্ধারিত তারিখের আগে স্কুল সভাপতি ও উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার তার কাছ থেকে তিন লাখ টাকা দাবি করেন। টাকা দিতে না পারায় অন্য এক প্রার্থীকে দিয়ে তার বিরুদ্ধে একটি লিখিত মিথ্যা অভিযোগ নেয় স্কুল কমিটি। পরে বিষয়টি মীমাংসার জন্য তাকে উপজেলা শিক্ষা অফিসে শুনানির জন্য ডাকা হয়।
তিনি বয়স সংক্রান্ত সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র নিয়ে শুনানির মুখোমুখি হন। শুনানি চলাকালে এক ফাঁকে উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার ভবরঞ্জন দাস তাকে একাকী ডেকে আবারো তিন লাখ টাকা দাবি করেন। টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় তাকে শুনানির ফল পরে জানানো হবে বলে জানিয়ে দেয়।
কিন্তু শুনানির ফল না জানিয়ে অপর চাকরি প্রার্থীদের ইন্টারভিউ কার্ড ইস্যু করা হয়। বিষয়টি তিনি জানতে চাইলে স্কুল সভাপতি, প্রধান শিক্ষক ও উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা তাকে বলেন, ‘টাকা ছাড়া চাকরি হয় না।’
নূর নবী বলেন, আমার বাবা তার জমিতে এ স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। তাছাড়া নীতিমালা অনুযায়ী আমি স্কুল এলাকার মধ্যে। শুধু ঘুষ দিতে না পারায় তারা আমাকে বাদ দিয়েছে।
একই অভিযোগে মামলা হয়েছে উপজেলার তমরদ্দিন ইউনিয়নের নিলক্ষী সিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে। স্কুলটির পাশের পাড়ির রবিয়ল হোসেন আদালতে মামলাটি দায়ের করেন।
মামলায় বলা হয়েছে- দফতরি কাম নৈশপ্রহরী পদে ৭ জন আবেদন করলে স্কুলের যাচাই-বাছাই কমিটি চারজনের আবেদনপত্র ত্রুটিমুক্ত ঘোষণা করে। এরমধ্যে তিনিও আছেন। মৌখিক পরীক্ষায় তিনি ১৯ নম্বর পেয়ে প্রথম হন। উত্তীর্ণ বাকি দু’জন পান ১৬ ও ১২।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ তাকে নিয়োগ দেয়ার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়। এ সংক্রান্ত একটি অনুলিপি তাকেও দেয়া হয়েছে।
কিন্তু আবেদনে অযোগ্য বিবেচিত হওয়া এনায়েত হোসেনের কাছ থেকে তার বিরুদ্ধে একটি ভুয়া অভিযোগ নিয়ে তাকে নিয়োগ দেয়া থেকে বিরত রাখে নিয়োগ কমিটি।
খোকন অভিযোগ করে বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাকে নিয়োগ না দিয়ে চাকরির জন্য যোগ্যতা হারানো ওই ব্যক্তিকে অবৈধভাবে চাকরি দেয়ার জন্য চক্রান্ত করছেন। তিনি অবৈধভাবে তাকে খুশি করতে না পারায় তার নিয়োগ চূড়ান্ত করা হচ্ছে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাতিয়া উপজেলার একাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাগো নিউজকে বলেন, সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়গুলোর সভাপতি, প্রধান শিক্ষক ও উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার যোগসাজশে জনপ্রতি তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা নেয়া হয়েছে। এভাবে ১০৪টি পদের মধ্যে অন্তত ৮০টি পদে নিয়োগেই এই অবৈধ লেনদেন হয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, অনিয়মের অভিযোগ উঠলে তা তদন্ত করে ধরা পড়ার পরেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি হাতিয়া উপজেলার দক্ষিণ চরচেঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দফতরি নিয়োগে। পরে খোদ বিদ্যালয়টির সভাপতি মো. সাহাব উদ্দিন আদালতে মামলা করেছেন।
স্কুলটির এই সভাপতি অভিযোগ করেন, ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর উপজেলা শিক্ষা অফিসারের নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি বিজ্ঞপ্তি দেন। সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ও স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবেদনকৃত প্রার্থীদের যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করেন।
২০১৩ সালের ২২ জানুয়ারি ছিল নিয়োগ পরীক্ষার নির্ধারিত দিন। কিন্তু এদিন সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা উপস্থিত থাকতে পারবেন না বলে পরীক্ষার নতুন দিন ধার্য করেন। কিন্তু ওই দিনও অসুস্থতার কথা বলে তারা উপস্থিত হয়নি। দুদিন পর আবার তারিখ নির্ধারণ করা হবে বলে তাকে জানানো হয়। কিন্তু পরে তাকে না জানিয়েই একজনকে নিয়োগের জন্য প্রস্তুতি নেন তারা।
বিষয়টি তিনি জানতে পেরে ইউএনও ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেন স্কুল সভাপতি। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন। তদন্তে অনিয়ম প্রমাণিত হয়। কিন্তু প্রতিবেদনের তোয়াক্কা না করে অন্য একজনের নামে নিয়োগপত্র ইস্যু করা হয়।
একই অভিযোগে মামলা হয়েছে চরবাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও। শুধু এ কয়টি স্কুলের মামলা সংক্রান্ত নথিপত্র জাগো নিউজের হাতে পৌঁছলেও এমন আরো বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া অনেকেই স্থানীয় প্রভাবশালীদের ভয়ে মামলা কিংবা অভিযোগ করার সাহস পাননি।
এদিকে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে ১০৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ১০৪টিতে দফতরি কাম প্রহরী পদে নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রথম দুই ধাপে ৭০ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। এর মধ্যে দুটি পদে পৃথক মামলা হওয়ায় তারা বেতন ভাতা পাচ্ছেন না। তৃতীয় ধাপে ৩৪ জনকে নিয়োগ দেয়া হলেও মামলার কারণে তা ঝুলে গেছে। এই তৃতীয় ধাপে নিয়োগের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট হওয়ায় নিয়োগপ্রাপ্ত ৩৪ জন এখন পর্যন্ত কোনো বেতন ভাতা পাননি।
এইসব নিয়োগে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ভবরঞ্জন দাসের বিরুদ্ধে। প্রথম ধাপে ২০১৪ সালের দিকে তৎকালীন সংসদ সদস্যের সুপারিশে ৩৬ জন পিয়ন নিয়োগ দেয়া হয়। সে সময় দীর্ঘদিন পর্যন্ত তিনি ফাইলে স্বাক্ষর করেননি। পরে সবক’টি নিয়োগে দুই থেকে তিন লাখ টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
তবে ভবরঞ্জন দাস এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, নিয়োগের জন্য উপজেলাভিত্তিক একটি শক্তিশালী কমিটি রয়েছে। আমরা শুধু চূড়ান্ত নির্বাচিতদের তিনজনের একটি প্যানেল তৈরি করে দিই। সেখান থেকে এমপি মহোদয় একজনকে নিয়োগ দেন। এটা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে রয়েছে। তবে দ্বিতীয় ধাপের পর তৃতীয় ধাপের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি মামলা হওয়ার পর নিয়োগ ঝুলে গেছে। যে কারণে ৩৪ জন এখনো বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না।
এমএসএস/এনএফ/আরআইপি