নাফ নদীর দুই তীরেই রোহিঙ্গাদের কান্না
জাতিসংঘের মতে, বিশ্বের অন্যতম নিপীড়িত এক জনগোষ্ঠী মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের মুসলিম রোহিঙ্গা। দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশ ছাড়ছেন তারা। দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে খোলা আকাশের নিচে থাকতে হচ্ছে তাদের। হন্যে হয়ে এদিক-সেদিক ঘুরছেন একটু আশ্রয়ের আশায়। ঢুকে পড়ছেন পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশেও।
নির্যাতিত এই জাতিগোষ্ঠীর খবর জানাতে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকা দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে আছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক শাহেদ শফিক। তার ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে পঞ্চম পর্ব।
সুফিয়া বেগম। মিয়ানমারের পোহাখালী গ্রামে কাটিয়েছেন জীবনের ৮০টি বছর। তার ঘরে আট সন্তান। সন্তানদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল তার। ভেবেছিলেন সন্তানেরা সংসারের হাল ধরলে তার সব কষ্ট লাঘব হবে। কিন্তু মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও দেশটির মগ জাতি সুফিয়া বেগমের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। সংসারের হাল ধরা তো দূরে থাক বরং সন্তানদের মৃত্যু দেখতে হয়েছে তার জীবদ্দশাতে, তার চোখের সামনে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তার সন্তানদের জবাই করে হত্যা করেছে। এই দুঃসহ স্মৃতি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না তিনি।
বৃহস্পতিবার ( ০১ নভেম্বর) উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জাগো নিউজের এই প্রতিবেদককে এভাবে বলতে থাকেন পোহাখালী গ্রামে তার দুর্বিষহ কষ্টের কথা। চোখের পানিতে ভেসে যায় সুফিয়া বেগমের মুখ। ভারি হয়ে ওঠে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাতাস।
সুফিয়া বেগম বলেন, ‘গুলি মারি মারি পালাদ্দে। গরকানও পুড়ি দিয়েদ্দে। মোর চাওয়ালোগল এগগাও নাই। মারি পালাইদ্দে। ইনছান অইলে বুঝিবি তুই। ও বাজিওগল মুই ক্যান কত্তুম। ক্যান করি গুলি মাইল্লেরে পুত। গলায় চুরি দিলোরে …। ও আল্লাহ মোর পোলাইনোগলরে এইনাদাও। (গুলি মেরে পালাচ্ছে। ঘড়ও পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার একটা ছেলেও আর নেই। মেরে ফেলেছে। মানুষ হলে আমার কষ্ট তুই বুঝতি। আমি কি করবো? কেন গুলি করলো ওরা। গলায় ছুরি মারলো।)’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে সুফিয়া বেগম জানান, গত ৯ নভেম্বর মিয়ানমার সেনাবাহিনী হঠাৎ হেলিকপ্টার দিয়ে পেট্রল ঢেলে গ্রামের সব ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিতে থাকে। আগের দিন গ্রামের স্কুলগুলোতে এসে অবস্থান নেয় সেনারা। এরপর আকাশ এবং স্থলপথে একযোগে অভিযান করে তারা। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে গ্রামের পর গ্রাম। ভয়ে দিগবিদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন নারী-পুরুষ ও শিশুরা। অন্য সবার মতো তিনিও পালানোর চেষ্টা করলে সেনারা তাকে কোমরে লাথি মেরে ফেলে দেয়। এরপর ঘর থেকে ছেলে মোহাম্মদ, রেজোয়ান, মনহা, আইজিদা ও পুত্রবধূ রোকেয়াকে ধরে নিয়ে ধান ক্ষেতে জড়ো করে সেনাবাহিনী। সবার সামনে রোকেয়াকে ধর্ষণ করে সেনারা। পরে তার ছেলেদের চোখ বেঁধে জবাই করে হত্যা করে।
শুধু সুফিয়া বেগম নয়, জাগো নিউজের এই প্রতিবেদককে দেখতে পেয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা শত শত নির্যাতিত নারী জড়ো হন। বলতে থাকেন তাদের ওপর চালিয়ে যাওয়া রোমহর্ষক সব কাহিনী। নির্যাতনের সেসব দৃশ্য বর্ণনা করতে করতে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন তারা।
গত মঙ্গলবার (২৭ নভেম্বর) মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের পোহাখালী থেকে উখিয়ার অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসেন রেহানা বেগম। তিনি জানান, চোখের সামনেই জবাই করে হত্যা করা হয় তার স্বামীকে। পরদিন গভীর রাতে চার ভাই জামাল হোসেন, কামাল হোসেন, ফারুক, আবুল হোসেন ও চাচা সৈয়দ হোসেন এবং চাচাতো ভাই আইয়ুব আলীসহ গ্রামের অন্তত ১৫০ জন রোহিঙ্গা একটি ট্রলারে করে নাফ নদীর মাঝ পথে এলে স্পিডবোডে করে এসে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড ট্রলারটি ফুটো করে নদীতে ডুবিয়ে দেয়। তার সঙ্গে একটি কন্টেইনার থাকা পানিতে ভাসতে ভাসতে বহুদূর গিয়ে বাংলাদেশের সীমানায় পৌঁছেন। বাকিদের এখন পর্যন্ত আর কোনো খবর পাননি।
মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা নাফ নদীর দুই তীরেই চলছে মিয়ানমারের নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের কান্না। তাদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে নদীর দু’পাড়ের আকাশ-বাতাস। থামছে না তাদের কান্না। স্বদেশে অসহনীয় নির্যাতন আর নিপীড়নের শিকার হয়ে বাস্তুহারা এ রোহিঙ্গারা এখন দিন কাটাচ্ছেন খোলা আকাশের নিচে। জীবন রক্ষায় দেশটির আরাকান প্রদেশ থেকে পালাচ্ছে নিপীড়িত এই জাতি। অবৈধভাবে ঢুকে পড়ছেন বাংলাদেশেও।
স্থানীয় জেলে কিংবা বিজিবি সদস্যদের হাতে-পায়ে ধরে কোনোভাবেই নাফ নদী পার হলেই প্রথমে সেজদায় পড়েন রোহিঙ্গা মুসলিমরা। অন্তত কিছু না হোক, জীবন তো বাঁচবে। বাংলাদেশের জেলে গেলেও শান্তি এই নিপীড়িত জাতির। জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে এমনটাই জানিয়েছেন তারা।
বৃহস্পতিবার মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকার টেকনাফ, নীলা, দমদমিয়া, হোয়াইক্যং, জাদিমুরা, নয়াপাড়া, খরাংখালী, শাহপরীর দ্বীপ এবং উখিয়ার বালুখালী, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘংধুমরসহ বিভিন্ন এলাকা দিয়ে এখনো পালিয়ে আসছেন রোহিঙ্গারা। এসব এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শুধু পরনের কাপড় ছাড়া কিছুই নেই তাদের সঙ্গে। সীমান্ত পার হয়েই আশ্রয় চান স্বজাতি অন্য রোহিঙ্গাদের কাছে। কেউ কেউ আশ্রয় দেন আবার কেউ কেউ দিতে পারেন না। কারণ ক্যাম্পগুলোতে পা রাখার জায়গা নেই। কানায় কানায় ভর্তি হয়ে গেছে।
রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৯ নভেম্বর থেকে মিয়ানমারের মংডু আরাকান রাজ্যে মগ সেনাদের হত্যা-ধর্ষণ, দমন-পীড়ন নিত্যদিনের কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে। গত কয়েক দিনে সীমান্ত এলাকার ঢেকিবনিয়া, কুমিরখালী, শিলখালী, বলিবাজার, পোয়াখালী, নোয়াখালী ও নাগপুরাসহ পাঁচটি গ্রামে মিয়ানমারের সামরিক জান্তারা তাণ্ডব চালিয়ে ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। কেড়ে নেয়া হয়েছে তাদের সহায়-সম্বল। তরুণীদের ধরে ধরে ধর্ষণের পর হত্যা করা হচ্ছে। প্রাণে বাঁচাতে হাজারো রোহিঙ্গা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করছেন। এখনো মিয়ানমার সীমান্তের কুমিরখালীর গহিন পাহাড়ে অপেক্ষা করছে হাজার হাজার মানুষ। বুধবার ভোরেও টেকনাফ দমদমিয়া সীমান্ত এলাকা দিয়ে অন্তত পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছেন।
বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত স্থল ও নদীপথ ব্যবহার করে অবৈধভাবে অন্তত অর্ধ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এ রোহিঙ্গাদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠছে ক্যাম্পগুলোর বাতাস। ঠিকমতো খাবার পাচ্ছেন না। দু’মুঠো ভাতের দেখা পেলেই শিশুদের কান্না থামানো যায় না। খাবারের পরিমাণ এতো কম থাকে যে, শিশুদের খাওয়ালে বড়দের খাওয়ার জন্য কিছু থাকে না।
এমএসএস/এআরএস/এনএইচ/পিআর