ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

মানসিক ভারসাম্যহীনদের অভিভাবকে পরিণত হয়েছেন শামীম আহমেদ

প্রকাশিত: ১১:৩২ এএম, ২৮ অক্টোবর ২০১৬

মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে গত দুই বছর ধরে মানিকগঞ্জ শহরে ঘুরেছে পারুল। অনেক সময় ছোট ছোট দুষ্ট ছেলেরা ছোট্ট ইট বা পাথরের টুকরো তার দিকে নিক্ষেপ করে দৌঁড়ে পালিয়েছে। কখনো কোনো খাবার হোটেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে কর্মচারীরা তাড়িয়ে দিয়েছে।

এমন কি সে যে রাস্তা দিয়ে হেঁটেছে অজানা ভয়ে সেই রাস্তাটা তাকেই ছেড়ে দিয়ে পাশ দিয়ে চলে গেছে অনেকেই। খাবার চেয়েও না পেয়ে রাস্তার কোথাও কোনো উচ্ছিষ্ট খাবার পেলে খেয়েছে। কখনো আবার না খেয়ে রাত কেটেছে পারুল।


রাস্তায় কোনো মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষকে দেখলে সাধারণ মানুষ তাদের যতটা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন ঠিক তেমনটাই করেছেন পারুলের ক্ষেত্রে। কেউ একবার ফিরেও তাকায়নি তার দিকে।

আরো পড়ুন: রাস্তা থেকে তুলে এনে সুস্থ করছেন তিনি

জীবন সংগ্রামে খেটে খাওয়া মানুষগুলো এতটাই ব্যস্ত যে, মাঝে মাঝে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানগুলোও ভুলে যান তারা। চারপাশে এত মানুষের ভিড়ে এখন আর নতুন কোনো মানুষ দেখে কৌতূহল সৃষ্টি হয় না কারো। সুস্থ মানুষকে ঘিরেই যেখানে কৌতূহল নেই, সেখানে মানসিক ভারসাম্যহীন তো দূরে কথা?

কোথা থেকে সে এসেছে পারুল। কোথায় তার বাড়ি। কেউ তা জানে না। তবে এটা ঠিক যে, এ ধরনের মানুষকে দেখে অনেকে ভয় করে দূরে থাকার চেষ্টা করেন। আর সেই ভয়কে জয় করেছেন বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা শামীম আহমেদ।

Parul
তিনি গত ২৭ আগস্ট রাজধানী থেকে মানিকগঞ্জে হাজির হন পারুলের কাছে। তাৎক্ষণিকভাবে পারুলকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেন। এরপর আশপাশের লোকজনের কাছে পারুলের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেন। সবাই জানান, গত দুই বছর ধরে যাত্রী ছাউনিতে থাকতে দেখছি তাকে। এর চেয়ে বেশি বলতে পারেননি কেউ।

আরো পড়ুন: ভারসাম্যহীন জবার স্মৃতি ও পরিবার ফিরিয়ে দিলেন শামীম

এরপর শামীম আহমেদ স্থানীয় প্রশাসন ও সাংবাদিকদের সহযোগিতায় অ্যাম্বুলেন্সযোগে পারুলকে নিয়ে আসেন রাজধানীর মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। সেখানে তাকে ভর্তি করেন। প্রতিবারের ন্যায় শামীম আহমেদের এবারের মহানুভূবতাকেও সম্মান জানান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তারা হাসপাতালে পারুলের থাকার ব্যবস্থা এবারো ফ্রি করে দেন। এরপর শুরু হয় চিকিৎসা।

হাসপাতালে পারুলকে ঠিকমতো দেখভাল করার জন্য জরিনা নামে একজন বেতনভুক্ত আয়া নিযুক্ত করেন শামীম আহমেদ। যতদিন পারুল হাসপাতালে ভর্তি থাকবেন ততদিনই ওই আয়া তার দেখভাল করবেন এই চুক্তিতে নিয়োগ দেয়া হয় তাকে। চিকিৎসার বাইরেও আয়া জরিনাকে প্রতিমাসে ৮ হাজার টাকা দিতে হয়।

Parul
শুক্রবার বেলা ১১টা। মানসিক হাসপাতালে পারুলকে নিতে হাজির হলেন শামীম আহমেদ। যদিও গতকাল বৃহস্পতিবারই পারুলের ছাড়পত্র দিয়ে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পারুলের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে সেখানেই দুপুর ১২টা বেজে যায়।

এরপর তাকে নেয়া হয় রাজধানীর আদাবরে শামীম আহমেদের বাড়ির সামনেই আয়া জরিনার বাসায়। তার পরিবারের সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত পারুল এখন থেকে সেখানেই থাকবে। পারুল যেখানে নেয়া হয়েছে ওই বাড়ির পরিবেশটি অনেকটা গ্রামীণ পরিবেশের মতোই। চারপাশে বড় বড় দালান হলেও ওই স্থানটিতে এখনো গ্রামীণ আবহ বিরাজ করছে। শামীম আহমেদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকও পারুলের বর্তমান ঠিকানা ওই বাড়ি দেখতে হাজির হন।

শামীম আহমেদ জানান, মানিকগঞ্জ থেকে যখন পারুলকে আনা হয় তখন তার সঙ্গে অনেকেই মিশতে ভয় করতো। এখন সেই ভয় কেটে গেছে। কারণ এখন পারুল অন্যসব স্বাভাবিক মানুষের মতোই সুস্থ। তবে পুরোপুরি না।
Parul
তিনি বলেন, আমার বিশ্বাস বর্তমানে পারুল যেখানে থাকবে সেখানকার পরিবেশ তাকে আরো একধাপ সুস্থ করে তুলবে। কারণে এখানে সেই পরিবেশ আছে। এখানে পারুলের সঙ্গে কথা বলার মতো অনেকেই আছে। অনেক বাচ্চা আছে তার সঙ্গে খেলার জন্য। এসবের মাঝে থাকলে হয়তো পুরো স্মৃতি ফিরে পাবে পারুল।

তিনি আরো বলেন, এখন শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও মানসিকভাবে সুস্থ নয় পারুল। কখনো সে বলছে তার বাড়ি যশোরে, কখনো আবার বলছে মানিকগঞ্জে। তবে আমাদের প্রথম ধাপের কাজ আপাতত শেষ। এই পরিবেশে থাকাকালীন শুরু হবে দ্বিতীয় ধাপের কাজ। এখন সবচেয়ে বড় কাজটি হলো পারুলের পারিবারিক ঠিকানা খুঁজে বের করা।
Parul
শামীম আহমেদ বলেন, পারুলসহ এ পর্যন্ত তিনটি মেয়েকে সুস্থ করে তুলেছি। বাকি দুইজন পুরোপুরি সুস্থ। তারা এখন পরিবারের সঙ্গেই রয়েছে। পারুল তৃতীয় মেয়ে।

তিনি বলেন, একেক জনের পেছনে প্রায় সত্তর হাজার টাকা খরচ হয়। তবে সবচেয়ে বেশি খরচ হয়েছে বান্দরবান থেকে নিয়ে আসা অন্তরের (শিউলি রাণী সরকার) ক্ষেত্রে। সেখান থেকে তাকে মাইক্রোবাস যোগে ঢাকায় নিয়ে আসতেই বেশি খরচ হয়েছে। সে এক মাস হাসপাতালে ভর্তি ছিল। তবে ৬ মাস তাকে বাসায় এনে রাখতে হয়েছিল।

তিনি আরো বলেন, আদুরী (জবা) নামে একটি মেয়েকে এনেছিলাম পুরানা পল্টন থেকে। তাকে তিনমাস চিকিৎসা দেয়ার পর সে সুস্থ হয়ে উঠে। প্রতিটি মেয়ের আয়া হিসেবে কাজ করেছেন জরিনা।
Parul
এ ব্যাপারে কথা হয় আয়া জরিনার সঙ্গে। তিনি বলেন, শামীম স্যার যে মহৎ কাজ করছেন উনার সঙ্গী হিসেবে থাকতে পারা আমার ভাগ্যের ব্যাপার। প্রথম অবস্থায় তাদের দেখভাল করা কঠিন হলেও পরবর্তীতে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

এরপর শামীম আহমেদ বলেন, মানুষের উপকার করার যে তৃপ্তি সেই স্বাদ যদি সবাই পেত তাহলে আমাদের সমাজে এত মানুষ আজ অবহেলিত থাকতো না। সেই তৃপ্তি গ্রহণের জন্য হলেও সবাই একে অপরের উপকারে আসতো।

পারুলকে যেন খুব তাড়াতাড়ি তার পরিবারের মাঝে ফেরত দেয়া যায় এক্ষেত্রে তার পরিবারকে খুঁজে বের করতে সবার প্রতি আহ্বান জানান শামীম আহমেদ।

এমএএস/এমএস