রামপালে অন্য কোনো শক্তির স্বার্থ রয়েছে
অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছাড়াও সুন্দরবন রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক। সম্প্রতি সমাজ ও রাজনীতির নানা বিষয় নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন জাগো নিউজের। কথা বলেছেন নারী ও শিশু নির্যাতন এবং রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়েও। তিন পর্বে সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষ পর্ব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : আপনি সুন্দরবন রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিচ্ছে সরকার। কী বলবেন এখন?
সুলতানা কামাল : আপনাকে একটি উদ্ধৃতি দিই। ‘আমরা গাছ লাগাইয়া সুন্দরবন পয়দা করি নাই। স্বাভাবিক অবস্থায় প্রকৃতি এটি করে দিয়েছে বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য। বঙ্গোপসাগরের পাশ দিয়ে যে সুন্দরবনটা রয়েছে, এটি হলো বেরিয়ার। এটি যদি রক্ষা করা না হয়, তাহলে একদিন খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, কুমিল্লার কিছু অংশ ও ঢাকার কিছু অংশের এরিয়া সমুদ্রের মধ্যে চলে যাবে এবং হাতিয়া, সন্দ্বীপের মতো আইল্যান্ড হয়ে যাবে। একবার যদি সুন্দরবন শেষ হয়ে যায়, তো সমুদ্র যে ভাঙন সৃষ্টি করবে, সেই ভাঙন থেকে রক্ষা করার কোনো উপায় আর নাই।’ ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ উদ্বোধনকালে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে এ কথা বলেছিলেন। এরপর তো আর নতুন কথা থাকতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর যে চেতনা ছিল, তা মনে হয় আমরা হারিয়ে ফেলেছি।
উন্নয়নের নামে সুন্দরবনের সর্বনাশ করতে যাচ্ছি। আমরা উন্নয়নবিরোধী নই। আমরাও বিদ্যুৎ চাই। তাই বলে সুন্দরবনকে ধ্বংস করে আমরা বিদ্যুৎ চাইতে পারি না। সুন্দরবনকে রক্ষা করতেই হবে। বিদ্যুৎ যে কোনো উপায়ে উৎপাদন করা যেতে পারে। কিন্তু যে কোনো উপায়ে সুন্দরবন তৈরি করা যাবে না। লাখ লাখ বৃক্ষরোপণ করেও না।
সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির বক্তব্য একটাই, তা হচ্ছে আমরা কোনোভাবেই সুন্দরবনের ক্ষতি করতে দিতে পারি না। আমরা আশা করি শেষ পর্যন্ত হলেও সরকারের বোধোদয় হবে এবং রামপাল প্রকল্প বাতিল করবে।
জাগো নিউজ : সরকার তো বলছে, সুন্দরবন ঠিক রেখেই এ প্রকল্প হচ্ছে?
সুলতানা কামাল : না, সরকারের পক্ষ থেকে কিন্তু একবারও বলা হয়নি যে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না। সরকার বলছে, যে ক্ষতি হবে তা সর্বোচ্চ কমিয়ে এ প্রকল্প করা হবে।
বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে সম্প্রতি একই পরিবারের পাঁচজন মারা গেলেন। খবরে প্রকাশ, বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে চালের ওপর পড়ে ওই দুর্ঘটনার সূত্রপাত। তার যে ছিঁড়ে আছে তা দেখার কেউ নেই। এটা কারও দায়িত্ব নয়। একটি রাষ্ট্রের এই যদি হয় বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা, সেখানে সুন্দরবনের ক্ষতি কীভাবে ঠেকানো হবে তা সহজেই অনুমেয়।
যেখানে আমরা বিদ্যুতের তার-ই ঠিকমতো রক্ষা করতে পারি না, সেখানে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপন্ন সালফার, কার্বন, মার্কারির মতো পদার্থের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সুন্দরবনের বায়ু, পানি, গাছপালা, জীবজন্তুকে রক্ষা করা হবে আমাদের সেটা বিশ্বাস করতে হচ্ছে!
রাজধানীর বুকে হাতিরঝিল। ঝিলের পাড় দিয়ে নাকে কাপড় না দিয়ে যাওয়া যায় না দুর্গন্ধের কারণে। এই ঝিলের পানি পর্যন্ত সরকার শোধন করতে ব্যর্থ হয়েছে। বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে পারিনি। ট্যানারি এখনও সরাতে পারিনি। এর মধ্যে কী করে বিশ্বাস করি সরকার সুন্দরবন রক্ষা করবে?
সরকার যে প্রযুক্তির কথাই বলুক না কেন, সুন্দরবন রক্ষা করার মতো ব্যবস্থাপনা এখনও গড়ে ওঠেনি। তাদের (সরকার) টেন্ডার আমরা অধ্যয়ন করেছি। সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য যেসব ব্যবস্থার আয়োজন করা একান্ত প্রয়োজন সরকারের টেন্ডারে সেসব যন্ত্রপাতি, উপায়ের কোনো উল্লেখ নেই। সুন্দরবন ধ্বংস হলেও সরকার বলবে, আমরা চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। যেমনটি বলা হয়, বুড়িগঙ্গা বা হাতিরঝিলের ব্যাপারে অথবা ট্যানারি স্থানান্তরের ক্ষেত্রে। আমরা তা হতে দিতে পারি না। যে কোনো মূল্যে আমরা সুন্দরবন রক্ষার চেষ্টা করে যাব।
জাগো নিউজ : সুন্দরবন নিয়ে তো সরকারের মধ্যেও এমন ভাবনা কাজ করার কথা?
সুলতানা কামাল : এটিই আমাদের অবাক করে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু যখন সুন্দরবন রক্ষা করার ব্যাপারে এত প্রত্যয়ী বক্তব্য দিয়েছেন, সেখানে ২০১৬ সালে এসে তারই কন্যা কি করে এমন প্রকল্প হাতে নিতে পারেন, যা একেবারে তার বিপরীতে চলে যায়। প্রধানমন্ত্রীর তো স্পষ্ট জানার কথা, তার বাবা সুন্দরবনকে কি মূল্য দিয়ে গেছেন। কত অমূল্য মনে করেছেন। সুন্দরবন তার ভাষায়, ‘পয়দা’ করা হয়নি, গাছ লাগিয়ে সুন্দরবন তৈরি করা যায় না। এটা নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীর না বোঝার কথা নয়।
ক্ষতি তো অনেক হয়েই গেছে। শেষটুকু রক্ষারও কি চেষ্টা হতে পারে না? আমরা তাই করছি। এর মধ্যে সরকার বিরোধিতার বা সরকারি ভাষায় যে ‘ষড়যন্ত্র’র কথা বলা হচ্ছে তা অবান্তর।
জাগো নিউজ : এত প্রতিবাদের পরও সরকার যখন এ প্রকল্প নিয়ে এগোচ্ছে, তখন অন্য কোনো শক্তির হিসাব-নিকাশ কাজ করছে কিনা?
সুলতানা কামাল : রামপালে অবশ্যই অন্য কোনো শক্তির স্বার্থ রয়েছে, যে শক্তিকে সামাল দিতে পারছে না সরকার। আমাদের এ কথা মনে না করার কোনো কারণ নেই। এখানে বিশেষ কোনো পক্ষের স্বার্থ কাজ করছে, যে শক্তিকে মোকাবেলা করতে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ, আমাদের দাবি সরকারের না বোঝার কথা নয়। এখানেই বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে হবে কেন? অন্য কোথাও করলে কি সমস্যা, কার স্বার্থ রক্ষা করতে এটি করা, তা নিয়েই আমাদের প্রশ্ন।
জাগো নিউজ : সুন্দরবন রক্ষার এ আন্দোলন নিয়ে শেষ পর্যন্ত কতটুকু আশাবাদী?
সুলতানা কামাল : আমরা যারা জনস্বার্থ নিয়ে আন্দোলন করি, তাদের শেষ পর্যন্ত আশা নিয়েই এগোতে হয়। আশা ছেড়ে দিলে তো আর আন্দোলন হয় না। আমরা যে কোনো মূল্যে সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। সরকার এটি বুঝতে পারলেই ভালো। তাহলে ক্ষতি কমানো সম্ভব।
জাগো নিউজ : প্রশ্ন উঠছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়েও?
সুলতানা কামাল : আমরা আগে জেনেছি, রাশিয়া রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্য নিয়ে শোধন করে তা ফেরত পাঠাবে। এখন শুনছি, রাশিয়া বর্জ্য নেবে না। যদি রাশিয়া বর্জ্য নিতে না চায়, তাহলে বাংলাদেশ সরকার সে চুক্তি করতে রাজি হলো কেন? আর যদি রাশিয়া চুক্তি ভঙ্গ করে তাহলে অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারের শক্ত অবস্থানে যাওয়া উচিত। বাংলাদেশের স্পষ্ট বলে দেয়া উচিত যে, আমরা এই প্রকল্প করবো না। কারণ এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ শতভাগ ব্যর্থ হবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
জাগো নিউজ : রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রবিরোধী আরেক নেতা অধ্যাপক আনু মুহাম্মদকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। এই বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
সুলতানা কামাল : এই হুমকিতে আমি ব্যক্তিগতভাবে আশ্চর্য হইনি। আমরা যারা এই ধরনের আন্দোলন করে আসছি, তাদের এমন হুমকি মোকাবেলা করতেই হয়। এছাড়া হুমকি অবশ্যই উদ্বেগের কারণ, তবে এর মধ্য দিয়ে আন্দোলন দমানো যাবে না।
জাগো নিউজ : হুমকির পেছনের শক্তির ব্যাপারে কোনো সন্দেহ?
সুলতানা কামাল : আন্দোলন দমাতেই এমন কিছু হতে পারে বলে মনে করি। তবে সরকারের উচিত দ্রুত এর তদন্ত করে রহস্য উদঘাটন করা। এখন প্রযুক্তির যুগ। সরকার চাইলে মুহূর্তের মধ্যেই হুমকিদাতাকে বের করতে পারে। সরকারের উচিত প্রতিটি নাগরিককে সুরক্ষা দেয়া। দুঃখের বিষয় সুরক্ষা পাওয়া না পাওয়া এখন আর রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতার পরিচয় রাখতে পারছে না।
এএসএস/আরএস/পিআর