ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার কতদূর

প্রকাশিত: ০৩:১০ পিএম, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বিচার নিয়ে দীর্ঘ সাত মাস তদন্ত শেষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাঠোনো হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা থেকে সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়া হয় ২০১৪ সালের ২৫ মার্চ৷ তদন্ত রিপোর্ট দেয়ার পর প্রসিকিউশন ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করবে এবং জামায়াতে ইসলামীর বিচার শুরু হবে এমনটা জানিয়েছিলেন সংশ্লিষ্টরা৷ তবে আইনি জটিলতায় তা আর সম্ভব হয়ে উঠেনি।

জানা গেছে, বিচার পরিচালনার জন্য প্রসিকিউশন থেকে বিভিন্ন ট্রাইব্যুনালের ৩৮টি রায়ও পযর্বেক্ষণে রয়েছে। তদন্ত সংস্থা থেকে ৩৭৩ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনসহ ৯ হাজার ৫৫৭ পৃষ্ঠার মোট দালিলিক প্রমাণপত্র প্রসিকিউশনের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। এখন শুধু আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রস্তুত করে প্রতিবেদনটি ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হবে। অন্যদিকে, জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে অভিযোগ গঠনের কাজ করছিলেন যে সাতজন আইনজীবী। তাদের সঙ্গে আইনজীবী প্যানেলের ভারপ্রাপ্ত প্রধানের দ্বন্দ্বের কারণে সেই প্রক্রিয়া থেমে গেছে।

এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত আইনজীবী জেয়াদ আল মালুম বলেন, জামায়াতের ব্যাপারে তাদের কাজ শেষ হওয়ার আগেই আইনজীবী প্যানেলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান সব দলিল চেয়ে নোটিশ দিলে সমস্যা দেখা দেয়। ২০১৪ সালের ১৯ মে থেকে তাদের কাজ বন্ধ রয়েছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সংশোধন আইন-২০১৩ সংশোধন করে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার করার জন্যে পাস করা আইনে অপরাধী ব্যক্তির সঙ্গে সংগঠনকেও যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু আইনে সংগঠনের শাস্তি কি তা উল্লেখ করা হয়নি। আইন সংশোধন করে সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার এখনো শুরু না হওয়ায় সংশয় বাড়ছে বিচার প্রার্থীদের৷

প্রসিকিউটররা তদন্ত রিপোর্ট এবং দলিল-দস্তাবেজ নিয়ে প্রস্তুত রয়েছেন৷ আইনের সংশোধনী পাশ হলেই তারা ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন৷ কিন্তু কবে আাইনের সংশোধনী করা হবে, তা সারকারের মন্ত্রিপরিষদই ভালো জানেন।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘আইনটি সংশোধনের জন্য কেন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, সেটা একমাত্র আইনমন্ত্রীই ভালো বলতে পারবেন৷ কিন্তু এ কারণে মানুষের হতাশা বাড়ছে এবং সবাই ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ছেন৷ যারা এতদিন ধরে বিচারের জন্য অপেক্ষা করছেন, তারা আর কতদিন অপেক্ষা করবেন সেটা আমাদের বোধগম্যের বাইরে৷’

তিনি আরো বলেন, ‘সরকার চাইলে নির্বাহী আদেশেই সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে৷ ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ের পর্যবেক্ষণে জামায়াতকে অপরাধীদের দল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ জামায়াত দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে অপরাধ করেছে৷ এখানে ‘চেইন অফ কমান্ড`-এর দায়ও পরিস্কার৷’

হাইকোর্টে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ:
নির্বাচন কমিশনে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দল হিসেকে নিবন্ধন বাতিল করা হয় হাইকোর্টের একটির রায়ে। সেই রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল আবেদন করলে তা এখনও শুনানি হয়নি।

হঠাৎ থেমে যায় জামায়াতের বিচার প্রক্রিয়া:
প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজসহ সাতজন আইনজীবীর একটি প্যানেল ২০১৪ সালে আড়াই মাস ধরে প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অভিযোগ তৈরির কাজ করছিলেন। কিন্তু তা প্রস্তুত করে আদালেতে উপস্থাপন অভিযোগ আমলে নেওয়া এবং আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) গঠন প্রক্রিয়া থেমে যায়। কারণ হিসেবে জানা যায়, সংগঠনের বিচারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে কিছু ত্রুটি রয়েছে। তারা এই ত্রুটি সংশোধন করতে চান।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সংশ্লিষ্ট আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সংগঠনে বিচার করার কথা থাকলেও শাস্তির ব্যবস্থা নেই। এটাকে মন্ত্রী বড় ত্রুটি হিসেবে দেখছেন।

এই পটভূমিতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের বিচার হচ্ছে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আইনে। এই আইনে সংগঠনের বিচারের কথা থাকলেও শাস্তির ব্যবস্থা নেই। ত্রুটিগুলো শুদ্ধ করার পর বিচার কাজ শুরু করতে হবে। তা না হলে দেখা যাবে, বিচার হচ্ছে, কিন্তু সাজা হবে না। তখন সেটা হাস্যকর হবে।

তিনি আরো বলেন, সরকার জামায়াতের বিচারের প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসেনি। জামায়াতের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হবে। কিন্তু আইনে যেন কোনো ত্রুটি না থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। যাতে এই বিচার একটা প্রহসনের বিচার না হয়।

তবে এখন কতটা সময়ের মধ্যে ত্রুটিগুলো খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে -সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি মন্ত্রী।

আইন সংশোধন প্রক্রিয়া:
তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, ব্যক্তির শাস্তির বিষয়টি আইনে নির্ধারিত হলেও সংগঠনের শাস্তির বিষয়টি এখনও নির্ধারিত হয়নি। তবে বর্তমান আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ী সংগঠনের বিচারের বিধান রাখা হয়েছে।

জানা গেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নাৎসি বাহিনীর যেভাবে সাজা দেয়া হয়েছিল সে প্রক্রিয়াটি খুঁজে দেখছে আইন মন্ত্রণালয়। সেটিকে মডেল ধরেও আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, পাস হওয়া আইনে শাস্তির বিধান সুনির্দিষ্ট করে আইন সংশোধন করতে দ্রুতই পদক্ষেপ নেয়া হবে। অভিযোগ প্রমাণের পর ব্যক্তির বিরুদ্ধে যে শাস্তির বিধান করা হয়েছে, সে সময় সংগঠনের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবেও শাস্তির বিধান করা যেতে পারে।

প্রসঙ্গত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল বা নূরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের সনদের নবম অনুচ্ছেদে বলা হয়, কোন গোষ্ঠী বা সংগঠনের একজন সদস্যের বিচারের সময় ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্ট সংগঠন বা গোষ্ঠীকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করতে পারবেন। ১৯৪৫ সালে ওই ট্রাইব্যুনালে বিচার কাজ শুরু হওয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষ ২২ ব্যক্তি এবং সাতটি সংগঠন ও গোষ্ঠীর বিচার করে।

এদিকে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কয়েকটি রায়ের পর্যবেক্ষণে সংগঠন হিসেবে জামায়াতের অপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত করে খতিয়ে দেখতে বলেছেন।

জামায়াতকে রাজনৈতিক দল নয়, ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় দলটির কৃত অপরাধের বিচার করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। তিনি বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা নজির সৃষ্টি করতে যাচ্ছি। কারণ নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে হিটলারের দল নাৎসীর বিচারের পর বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনালে প্রথমবারের মতো কোনো সংগঠনের বিচার করা হচ্ছে। অপরাধের দায়ে পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোনো সংগঠনের বিচার শুরু হতে যাচ্ছে।

তুরিন আফরোজ আরো বলেন, জামায়াত ইসলামী একটি বড় দল। তাই এ সংগঠনের সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো ও দৈনিক সংগ্রাম বন্ধের কথাও বলা হবে। এ বিচারের মাধ্যমে আমাদের দাবি কি হবে তা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের পর জানা যাবে।

চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু বলেছেন, তদন্ত প্রতিবেদনে যা পাওয়া গেছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট। এখন এ প্রতিবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হবে। তবে তা করা হবে আইনের সংশোধন করার পর।

আইন সংশোধনের খসরায় যা থাকছে:
আইনটির খসড়া অনুমোদন হলে ট্রাইব্যুনাল আইনের ২০ (২) ধারায় সংগঠনের শাস্তির বিধান যুক্ত হবে৷ তাতে ট্রাইব্যুনাল দোষী সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করবেন এবং এই নামে বা অন্য কোনো নামে সংগঠনটির ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবেন৷ পাশাপাশি সংগঠনটির সদস্যদেরও ট্রাইব্যুনাল সাজা দিতে পারবেন৷ বর্তমানে এ ধারায় শুধু ব্যক্তির সাজার বিধান রয়েছে৷

এছাড়া আইনের ৪ নং ধারা সংশোধনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোনো সংগঠনের কার্যনির্বাহী কমিটি অথবা কেন্দ্রীয়, আঞ্চলিক বা স্থানীয় কমিটির সদস্য যদি অপরাধ করেন, তাহলে ওই অপরাধের জন্য সদস্যের পাশাপাশি সংগঠনও দায়ী হবে৷

সংশোধনের খসড়া অনুযায়ী, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ওই নামে বা অন্য নামে কার্যক্রম চালাতে পারবে না৷

এফএইচ/আরএস/আরআইপি

আরও পড়ুন