নেতৃত্ব নিধনের নিখুঁত নকশায় ২১ আগস্ট
আগস্টের কান্না যেন থামে না। আগস্ট মানেই বাঙালির মন আকাশে মেঘের ঘনঘটা। আগস্ট মানেই ঘাতকের রক্ত-খুনের হলিখেলা। জাতীর জীবনে আগস্ট এসেছে কলঙ্কের সাক্ষী হয়ে। পিতা হারানোর মাস আগস্ট যেন আজও রক্তখেলায় মাতোয়ারা।
আজ রক্তাক্ত ২১ আগস্ট। সেদিনের বিভীষিকাময় এমন হত্যাযজ্ঞ সভ্য জগতের ললাটে কালিমা লেপে দিয়েছে। সেদিন ছিল একটি সংগঠন নির্মূলের কালো অধ্যায়।সেদিন ছিল শনিবার, বিকাল বেলা। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে সন্ত্রাস ও বোমা হামলার বিরেুদ্ধে এক সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুপুরের পর থেকেই সমাবেশস্থলে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হতে থাকে। সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে সন্ত্রাসবিরোধী একটি মিছিল হওয়ার কথা। মিছিল-পূর্ব সমাবেশের জন্য মঞ্চ করা হয় ট্রাকের ওপর।
ঘড়ির কাটায় তখন ৫টা বেজে ২২ মিনিট। কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্য শেষে প্রধান অতিথি শেখ হাসিনা বক্তব্য দিচ্ছেন। শেখ হাসিনার সন্ত্রাসবিরোধী ঝাঁঝালো বক্তব্যে গোটা সমাবেশ তখন উদ্দীপ্ত। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে বক্তব্যের ইতি টেনেছেন। হাতে একটি কাগজ ভাঁজ করতে করতে মঞ্চের সিঁড়ির কাছে এগিয়ে আসছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। নিচে মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমান হাত বাড়িয়ে শেখ হাসিনার জন্য অপেক্ষারত।
ঘাতকদের তর যেন আর সইলো না। ঠিক তখনই বিকট শব্দ। মুর্হুর্মুহু গ্রেনেড বিস্ফোরণে কেঁপে উঠলো গোটা বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। মুহূর্তেই রক্তগঙ্গা বয়ে গেল পিচঢালা কালোপথ। আওয়ামী লীগ কার্যালয় চত্বর যেন এক মৃত্যুপুরী। রক্ত-মাংসের স্তূপে ঢেকে যায় সমাবেশস্থল। পরপর ১৩টি গ্রেনেড বিস্ফোরণে প্রাণ হারান আওয়ামী লীগের ২৪ নেতাকর্মী। আহত হয় শত শত মানুষ।
ওই হামলার প্রধান টার্গেট ছিলেন শেখ হাসিনা। এ কারণে প্রথম গ্রেনেডটি মঞ্চ অর্থাৎ ট্রাক লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু ট্রাকের ডালায় লেগে গ্রেনেডটি নিচে বিস্ফোরিত হয়। দেহরক্ষী এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের ত্যাগের বিনিময়ে প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা।
এদিকে ১৩টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করেই ঘাতকরা ক্ষান্ত হয়নি। জীবিত আছেন জেনে ঘাতকরা শেখ হাসিনা এবং তার গাড়ি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। কিন্তু শেখ হাসিনার গাড়িটি বুলেটপ্রুফ হওয়ায় এ বেলায়ও তিনি প্রাণে রক্ষা পান। ঘাতকের গুলি গ্লাস ভেদ করে শেখ হাসিনাকে আঘাত করতে পারেনি। তবে শেখ হাসিনাকে আড়াল করে ঘাতকের গুলির সামনে দাঁড়িয়ে নিজের জীবন বিলিয়ে দেন তার দেহরক্ষী ল্যান্স কর্পোরাল (অব.) মাহবুবুর রহমান।
বর্বর ওই হামলায় প্রাণে বেঁচে গেলেও শেখ হাসিনা বাম কানে মারাত্মক আঘাত পান। আঘাতপ্রাপ্ত কানের শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেন। শেখ হাসিনাকে হত্যার মূল পরিকল্পনা ব্যর্থ হলেও ওইদিনের বীভৎসতা এক কালো অধ্যায়ের জন্ম দেয়। ঘাতকের প্রথম নিক্ষেপ করা গ্রেনেডটি ট্রাকের ওপর বিস্ফোরিত হলে ওইদিন হয়তো আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই প্রাণে রক্ষা পেতেন না। রচিত হতো আরেক ১৫ আগস্ট।
বিস্ফোরিত ১৩টি গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় বহু মানুষ। অনেকের হাত-পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। নিহতের নিথর শরীর আর আহতের বেঁচে থাকার করুণ আর্তনাতে ভারি হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আকাশ-বাতাস।
এএসএস/এএইচ/আরএস