রামপাল ইস্যুতে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারছে সরকার
অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম। বিশিষ্ট খনিজ সম্পদ বিশেষজ্ঞ। অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগে। খনিজ সম্পদ, জ্বালানি, পরিবেশসহ জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন করছেন দীর্ঘদিন থেকে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ-এর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু। আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
জাগো নিউজ: প্রতিবাদ, সমালোচনার মধ্যেই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি সম্পন্ন হলো। রামপাল ইস্যুতে রাজনীতি, গণমাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে গুরুত্ব দিয়ে। আপনি কীভাবে দেখছেন?
বদরুল ইমাম: স্পষ্টভাবে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপক্ষে অবস্থান করছি। এটির কোনো দরকার ছিল না। কেবল দেশের সচেতন নাগরিক, বিশেষজ্ঞরা এটির বিপক্ষে অবস্থান করছে তা নয়, বাইরের অনেকেও এর বিরোধিতা করছে। আন্তর্জাতিক সংগঠন ইউনেস্কো, রামসার সেক্রেটারিয়েটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এটি নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। বিদেশিদের অনেকেই এখানে ফিন্যান্স করতে রাজি হয়নি। সুন্দরবনের পরিবেশ বিপজ্জনক অবস্থায় পড়বে বিধায় নরওয়ের সরকারি পেনশন ফান্ড তাদের এথিকস কমিটির সুপারিশে এই প্রকল্পে অর্থায়ন করা থেকে সরে গেছে। ভারতের ওয়ার্ল্ড লাইফ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া রামপাল প্রকল্প পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক গণ্য করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি অর্থনীতি বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান আইইইএফএ স্পষ্ট করে বলছে পরিবেশ বিনষ্টকারী এ প্রকল্প আর্থিকভাবে লাভজনকও হবে না বরং এ থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম চলমান দামের চেয়ে অনেক বেশি হবে। সার্বিকভাবে আমরা নিশ্চিত যে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে লাভের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি হবে।
জাগো নিউজ: কেন এভাবে নিশ্চিত হয়ে বলছেন?
বদরুল ইমাম: এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০২০ সালের পর উৎপাদনে যেতে পারে। এই সময়ে বাংলাদেশে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকার ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে। অনেক দেশের কাছেই যেতে হচ্ছে। সরকার মহেশখালী, মাতারবাড়ী, পায়রা, চট্টগ্রামে এরকম আরও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে। সুতরাং এই ২৪ হাজার বিদ্যুৎ থেকে রামপালের ১৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাদ পড়লে গোটা দেশ তো অন্ধকার হয়ে যাবে না। সরকারের ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে পরিকল্পনা তাকে আমরা আগেই স্বাগত জানিয়েছি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এত বিশাল পরিকল্পনায় সুন্দরবনের মতো জায়গায় ১৩০০ মেগাওয়াট কেন এত গুরুত্ব পাচ্ছে? এমন মহামূল্যবান জায়গা গুরুত্বহীন করে ১৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এভাবে গুরুত্ব পাওয়ার কোনো কারণ আছে বলে মনে করি না। আমরা তো বড় ধরনের বিদ্যুৎ ঘাটতি নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছি। সরকার এই প্রকল্পের পেছনে কেন এভাবে জোর দিয়েছে, তা বুঝে আসে না। এটি না হলে দেশ এগোবে না, উন্নয়ন একেবারেই থেমে যাবে, সরকার যেন এমনটিই বোঝাতে চাইছে।
জাগো নিউজ: এই প্রকল্পের পক্ষেও তো মত দাঁড়িয়ে গেছে। এর ভিত্তি কী?
বদরুল ইমাম: যারা এর পক্ষে তারা একবারেই সরকারঘনিষ্ঠ লোক। মন্ত্রী, সচিব, প্রকল্পের কর্তারা এর পক্ষে কথা বলছেন। তাদের জন্য পক্ষে বলা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু আমি একেবারে লিখে দিতে পারি কোনো স্বতন্ত্র ব্যক্তি কোনোভাবেই এর পক্ষে মত দিতে পারেন না।
জাগো নিউজ: দেশের বাইরে থেকেও অনেকে এসে এটির পক্ষে মত দিচ্ছেন?
বদরুল ইমাম: স্বাধীন কোনো ব্যক্তির পক্ষে মত দিতে পারে না। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখেন দেশের বাইরে থেকে এসে যদি কোনো ব্যক্তি এর পক্ষে মত দেন, তাহলে বুঝতে হবে তিনি অবশ্যই প্রকল্প থেকে সুবিধা নিচ্ছে। আমার চোখে একজন স্বাধীন বিশেষজ্ঞও ধরা পড়েনি, যিনি এর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এমনকি সচিব বা সরকারের কর্তারা যারা এর পক্ষে অবস্থান নিয়ে কথা বলছেন, তাদের শারীরিক ভাষা দেখে মনে হয়, শুধু বলার জন্যই বলা। পক্ষে অবস্থান নেয়া ছাড়া তো তাদের আর কোনো উপায়ও নেই।
জাগো নিউজ: আপনি আন্দোলনের মানুষ। দেখছেন দীর্ঘদিন থেকে। এত বিরোধিতার পরেও সরকার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি সম্পন্ন করলো। আসলে সরকারের শক্তির উৎসটা কী?
বদরুল ইমাম: একই প্রশ্ন আমারও। জনমতকে উপেক্ষা করে সরকার আসলে এত শক্তি কোথায় পাচ্ছে? আমি মনে করি, রামপাল ইস্যুতে সরকার নিজের পায়ে কুড়াল মারছে। সম্প্রতি সুশীল সমাজের সদস্য সুলতানা কামাল বলেছেন, রামপাল হচ্ছে স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী কাজ। এই চুক্তি গোপনে এবং তা অন্যকে খুশি করার স্বার্থে করা হয়েছে। সুলতানা কামাল তো মুক্তিযোদ্ধা। তিনি স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি। তিনি যখন এভাবে বলেন, তখন প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক। আমরা তো আসলে কাউকে ঘাড়ে চাপিয়ে রাখতে চাই না। পাকিস্তান পারেনি, ব্রিটিশরা পারেনি। এই সময়ে ঘাড়ে চাপাতে হবে কেন? অন্যের স্বার্থে, অন্যের খবরদারিতে আমাদের সব জলাঞ্জলি দিতে হবে, এটি তো আর হতে পারে না। তবে আমার কাছে মনে হয়, বাইরের চাপের কারণেই সরকার সুন্দরবনে বিদ্যুৎকেন্দ্র করছে। সরকারের মধ্যেও এ নিয়ে দ্বিধা আছে বলে আমার বিশ্বাস।
জাগো নিউজ: উন্নয়ন তো সময়ের দাবি। ঘনবসতি দেশ। যেখানেই এমন প্রকল্প করতে যাবে সেখানেই তো প্রতিবাদ আসতে পারে...
বদরুল ইমাম: জনস্বার্থে প্রকল্প হলে জনগণ অবশ্যই স্বাগত জানাবে। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় যা হয়েছে, তা ভিন্ন কারণে। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কথা বলে সেখানে গার্মেন্ট করছিল। এ কারণেই সেখানে মানুষ প্রতিবাদ করেছে। কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে জেনেও তারা উন্নয়নের স্বার্থে স্বাগত জানিয়েছে। কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র হতেই পারে। অন্যরা করছে। আমরা বসে থাকবো কেন। প্রশ্ন হচ্ছে, সেটা সুন্দরবনে কেন?
জাগো নিউজ: আপনি কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষে!
বদরুল ইমাম: আমি ঘোর পক্ষে। পরিবেশের কথা বিবেচনায় এনে অনেক সিদ্ধান্তই হয়তো স্থগিত রাখতে হয়। অনেকেই মনে করেন উন্নত বিশ্ব পরিবেশ ধ্বংস করে উন্নয়ন করছে, আমরা করবো না কেন? আমি এই নীতিরও বিরোধী। আবার হাত গুটিয়ে বসে থাকারও সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া যে পরিমাণ কার্বন তৈরি করছে সেই তুলনায় আমরা কিছুই করছি না। ভারত তো বসে নেই। আমরা তো অ্যাটমোসফিয়ারের কোনো ক্ষতিই করছি না।
জাগো নিউজ: উন্নত বিশ্ব করছে বলেই কি করতে হবে? বিকল্পতে তো জোর দিতে পারি?
বদরুল ইমাম: ২০০ বছর ধরে কয়লা পোড়ানো হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বিদ্যুতের শতকরা ৫০ ভাগ কয়লা থেকে। অস্ট্রেলিয়ায় আরো বেশি। চীনে ৭০ ভাগ।
জাগো নিউজ: কিন্তু এই সব দেশও তো পরিবর্তনের কথা বলছে?
বদরুল ইমাম: পরিবর্তনটা তো দেখাতে হবে। বলার মধ্যে থাকলেই তো হবে না। কিয়েটো প্রটোকল তো তারা এখনও গ্রহণ করেনি। তাদের কথা বিশ্বাস করবেন কী করে? বাংলাদেশ যদি কয়লার ব্যবহার কয়েকগুণ বাড়িয়েও দেয়, তবুও তাদের তুলনায় অনেকেটাই নগণ্য।
জাগো নিউজ: কিন্তু অনেকেই তো কয়লাকে একেবারে না করে দিচ্ছেন। তাদের আন্দোলনে আপনিও...
বদরুল ইমাম: দ্বিমত থাকতেই পারে। বিশ্ব পরিবেশবাদীদের সঙ্গে অনেকেই এক হয়ে কথা বলেন। যুক্তিও আছে। কিন্তু আমারও তো পাওনা আছে। আমার পৃথিবী উন্নত বিশ্ব ধ্বংস করেছে, আমার হিসাব কে মেটাবে? আমার প্রাপ্য আমি তো চাইব-ই। আমি তো কোনো দূষণই করিনি পৃথিবীতে। তোমরা তো সব শেষ করে দিয়েছ। আমার এতটুকু দূষণ তোমার সইবে না কেন?
জাগো নিউজ: এমনটি হলে তা প্রতিশোধের পর্যায়ে পৌঁছায় কি-না?
বদরুল ইমাম: প্রতিশোধের প্রশ্ন নয়। বাঁচা-মরার প্রশ্ন। কয়লা ছাড়া আপনি বিদ্যুৎ পাবেন না। গ্যাস শেষের পথে। দেশে শতকরা ৯০ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় গ্যাস দিয়ে। গ্যাস মজুদ থাকলে তো অন্য কোনো পথে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ত না। তেলের ওপরও নির্ভর করা যাবে না। সৌরশক্তির কথা অনেকেই বলেন। আগামী ৫০ বছরের আগে আপনি সৌরশক্তির ওপর নির্ভর করতে পারবেন না। এ কারণেই আমরা চাইলেই তেল, গ্যাস, কয়লা বাদ দিতে পারব না। বাদ দিতে পারবে না উন্নত বিশ্বও। তাই এতো কিছুর পর বলতে হচ্ছে আমাদের কয়লা পোড়ানোর সময় এসেছে এবং প্রয়োজনটা অনেক বেশি।
জাগো নিউজ: এখানে যারা বিরোধিতা করছেন, তারা কোনটাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন?
বদরুল ইমাম: রামপালের বিষয়টি একেবারেই আলাদা। রামপালের বিরোধিতা করা হচ্ছে একটি পয়েন্টে। সুন্দরবন। এটি দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় প্রেক্ষাপটেই বিশেষ গুরুত্ব পায়। আপনি সুন্দরবন বাদে দেশের অন্য যে কোনো জায়গায় এমন প্রকল্প করেন, আমি পক্ষে অবস্থান নিয়ে মাঠে নামবো।
এএসএস/এএইচ/এনএফ/আরআইপি