ফুলবাড়ীর অভিজ্ঞতা রামপালে প্রয়োগ করছে সরকার
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক। শিক্ষকতার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী শোষণ, বৈষম্য, নিপীড়ন ও আধিপত্যবিরোধী তত্ত্বচর্চা ও লড়াইয়ে সক্রিয় রয়েছেন। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনসহ যে কোনো নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করছেন তিনি। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব। দেশে মার্কসীয় অর্থনীতি ও রাজনৈতিক অর্থনীতি সংক্রান্ত আলোচনায় তিনি বিশেষ পরিচিত লেখক। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ইস্যু নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু। আজ থাকছে এর প্রথম পর্ব।
জাগো নিউজ : ফুলবাড়ী আন্দোলনের মুখে তৎকালীন সরকার অনেকটাই পিছু হটলো। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন জাতীয়ভাবে। প্রতিবাদ, সমালোচনার মধ্যেই সরকার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি সম্পন্ন করলো। এখন কি বলবেন?
আনু মুহাম্মদ : ফুলবাড়ী আর রামপালের বিষয় দুটির ক্ষেত্র আলাদা। ফুলবাড়ী হচ্ছে জনবসতিপূর্ণ একটি অঞ্চল। আর সুন্দরবন একটি বন। সেখানে মানুষের বসবাস একেবারেই কম। সুন্দরবনের পশু-পাখি যদি আন্দোলন করতে পারত, তাহলে এতদিন অনেক কিছুই ঘটে যেত। ফুলবাড়ী আন্দোলনের প্রধান শক্তি ছিল সেখানকার জনগণ। এর সঙ্গে জাতীয় আন্দোলন এবং বুদ্ধিভিত্তিক তৎপরতা যোগ ছিল। গবেষণা, তথ্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের ফলেই ফুলবাড়ীতে জনগণের বিজয় হয়েছে।
জাগো নিউজ : রামপাল আন্দোলনে এসবের ঘাটতি থাকল কিনা?
আনু মুহাম্মদ : ফুলবাড়ীর অভিজ্ঞতা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রয়োগ করছে। আমরা ২০১০ সালে সেখানে গিয়ে দেখতে পেলাম সরকার অপারেশন শুরু করেছে। ক্রসফায়ারসহ নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে মানুষকে ইতোমধ্যেই উচ্ছেদ শুরু করেছে। দুর্বল শ্রেণির মানুষ যে কয়জন ছিল, তাদেরও উচ্ছেদ করে ফেলল। সেনাবাহিনীর নাম উল্লেখ করে সাইবোর্ড লাগানো হয়েছে। দেশবাসী, এমনকি খুলনা অঞ্চলের সচেতন মানুষ জানার আগেই রামপালের মানুষের জমি অধিগ্রহণ করে তাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। কোনো প্রকার পরিবেশ সমীক্ষার আগেই তারা এই কাজগুলো সম্পন্ন করেছে। মূলত ফুলবাড়ী কয়লা খনির ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েই সরকার এমন কৌশল নিয়েছে বলে আমার বিশ্বাস।
জাগো নিউজ : আপনারা তো অবগত ছিলেন?
আনু মুহাম্মদ : ২০১১ এবং ২০১২ সালে আমরা যখন সেখানে যাই, তখন সরকার পক্ষের মাস্তানরা আমাদের ওপরই হামলা করতে শুরু করলো। সমস্যা হচ্ছে ফুলবাড়ীর মতো সেখানে আমাদের কোনো সংগঠন বা কমিটি নেই। এখন অনেকটাই সজাগ করতে পেরেছি ওই অঞ্চলের মানুষদের। ২০১৩ সালে আমরা যখন সুন্দরবন অভিমুখে লংমার্চ করি, তখন উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের ব্যাপক সাড়া পেলাম। এখনতো তারা আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। ধীরে ধীরে উপকূলীয় মানুষ বুঝতে পারছে, এটি বাঁচা-মরার লড়াই।
আমরা এখন তাদের কাছে বার্তা দিতে সক্ষম হচ্ছি। সুন্দরবন অঞ্চলের জনপদে আমাদের আন্দোলনের ভিত এখন অনেক শক্ত। আমাদের দ্বিতীয় শক্তি হচ্ছে, সুন্দরবন নিয়ে দেশের মানুষের হৃদয়ের ভালোবাসা। এই বন নিয়ে প্রত্যেকের আবেগ-অনুভূতি কাজ করে। এ কারণেই গোটা দেশের মানুষ এই আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে আমি বিশ্বাস করি। আমরা এই রামপাল ইস্যুতে গণভোট দাবি করে আসছি। আমার বিশ্বাস ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো যদি যুদ্ধাবস্থা তৈরি না করে গণভোট নেয়া হয়, তাহলে সুন্দরবনের পক্ষে শতকরা ৯৯ ভাগ ভোট পড়বে।
জাগো নিউজ : কোথায় পান এই বিশ্বাস?
আনু মুহাম্মদ : মানুষ সুন্দরবনের পক্ষে। এটিই আমাদের বিশ্বাস। শুধু জাতীয়ভাবে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও সুন্দরবনের পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। কারণ পরিবেশ, প্রকৃতি তো নির্দিষ্ট কোনো সীমারেখায় আটকে থাকে না। এ কারণেই যারা এ বিষয়ে বুঝছেন তারাই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিবাদ করছেন। ভারতের সুনির্দিষ্ট কতিপয় প্রতিষ্ঠান ছাড়া পৃথিবীর কোনো প্রতিষ্ঠানই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষে নয়।
জাগো নিউজ : বলছেন, সুন্দরবন আবেগের জায়গা। কিন্তু এ ইস্যুকে কেন্দ্র করেও তো আপনারা ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারলেন না। বিভাজন প্রগতিশীল, বাম সংগঠনগুলোর মধ্যেও।
আনু মুহাম্মদ : প্রগতিশীল বা বামপন্থী সংগঠনগুলোর যারা সরকারের সঙ্গে আছে, তারাও জনসম্মুখে এই দাবির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সংগঠনগুলোর মধ্যকার বিভাজনের বিষয়টির কোনো ব্যাখ্যা আমার দেয়া ঠিক হবে না। তবে তেল-গ্যাস-জ্বালানি ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে বলা আছে, কোনো সংগঠন যদি হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে আমাদের নীতির বিরোধিতা করে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ওই সংগঠনকে কমিটি থেকে বহিষ্কার করা হবে। তবে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর নিজস্ব কর্মসূচি থাকে। তারা অনেক সময় জাতীয় কমিটির সঙ্গে এক হয়ে কর্মসূচি পালন করতে পারে না। ফলে জাতীয় কমিটির আন্দোলনের জন্য এটি একটি সমস্যাও বটে।
এএসএস/এএইচ/এসএইচএস/আরআইপি/এমএফ