জঙ্গি সমাধানে মানুষের ভাবনাকে গুরুত্ব দেয়া জরুরি
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। নিরাপত্তা বিশ্লেষক। সাবেক নির্বাচন কমিশনার। লিখছেন দেশের নিরাপত্তা, রাজনীতি এবং সমাজের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। গুলশান ট্র্যাজেডির প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি জাগো নিউজের মুখোমুখি হন তিনি। বলেন, এমনটি হতে পারে সে শঙ্কা আমরা বহু আগে থেকেই প্রকাশ করে আসছিলাম। এর দায় সমাজের সবার।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : অনেকেই জঙ্গি ইস্যুতে সামাজিক অস্থিরতাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। কেউ আবার এটিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির অংশ মনে করছেন। আপনার বিশ্লেষণ কি?
সাখাওয়াত হোসেন : আমি সব কিছুকেই গুরুত্ব দিচ্ছি। সমাজ তো আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাইরের কিছু না।
জাগো নিউজ : সমাজ ঠিক হলেই কি জঙ্গির উত্থান ঠেকানো যাবে?
সাখাওয়াত হোসেন : জঙ্গি ইস্যু রীতিমত গবেষণার বিষয়। তবে সমাজে চরমপন্থা আগে থেকেই ছিল। বামপন্থী, ডানপন্থীদের মধ্যে চরমপন্থার নীতি আগেও ছিল। তবে এখনকার মতো এমন সহিংসতা ছিল না। তার মানে সমাজ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এমন সুযোগ করে দিচ্ছে। পরিবার, সমাজ ভেঙে যাওয়ার পেছনে রাষ্ট্রের যে দায় আছে, তা তো অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
জাগো নিউজ : জঙ্গি দমনে সরকারের যে কৌশল, তা সমাজকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে?
সাখাওয়াত হোসেন : গুলশানের ঘটনা সব পরিষ্কার করে দিয়েছে। দেশ তো অন্ধকারে যাচ্ছে। এর দায় সবার। দেশ অন্ধকারে গেলে কেউ রক্ষা পাব না। আজকের যে পরিস্থিতি তার দায় তো সরকারের উপরেই বেশি। এখন পুলিশের মহাপরিদর্শক চোখের পানি মুছছেন। র্যাবের মহাপরিচালকের সুর পাল্টে গেছে।
আজকের এই পরিস্থিতি নিয়ে আমরা আগে থেকেই বলে আসছি। আমরা তো সরকারের কোনো শত্রু না। কিন্তু আমাদের কথা আমলে নেয়া হয়নি। যে সরকারের ভুল কাজের সমালোচনা করছে সেই শত্রু হয়ে গেছে।
আমি সেনাবাহিনীর দুটি পর্বের সঙ্গে কাজ করেছি। বর্তমান সেনাবাহিনী এবং পুরনো সেনাবাহিনী। বিশ্বের দশটা সেনা টিমের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। আমেরিকান সেনাবাহিনীতে থেকে এক বছর পড়াশোনা করেছি। তবুও অনেকেই আমার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। আমরা সবাই দেশের মঙ্গল চেয়েই এমন শঙ্কার কথা বলে আসছি। আমাদের কথার কোনোই গুরুত্ব দেয়া হয় না। কষ্ট লাগে। কারণ দেশটা আমারও। আমি তো অন্যের মতো পালিয়ে যেতে পারি না।
আমার স্ত্রী এখন বাজারে যেতেও ভয় পাচ্ছে। গুলশান মার্কেটের অনেকেই তাদের ব্যবসার মন্দার কথা বলছেন। বিদেশিদের কেউ মার্কেটে আসছেন না। হোটেল সোনারগাঁওয়ে গেলাম। পুরো হোটেল খাঁ খাঁ করছে। গোটা লবি ফাঁকা। এমন দৃশ্য কখনো দেখিনি। হোটেল কর্তৃপক্ষ বললো, বিদেশিরা চলে গেছে। যারা আসার কথা ছিল, তারা বুকিং বাতিল করেছেন। এই চিত্র তো কারো জন্যই মঙ্গল নয়।
জাগো নিউজ : উপায় কি?
সাখাওয়াত হোসেন : সিরিয়াস হওয়া। প্রশাসন এখনো সিরিয়াস নয়। পুলিশের নাম দিয়ে গুম হচ্ছে। পুলিশে নালিশ করেও কোনো সমাধান মিলছে না। নিহত জঙ্গি রোহানের বাবা ইমতিয়াজ খান বাবুল অভিযোগ করে বলছেন, তিনি সন্তানের খোঁজ পেতে বারবার থানা, পুলিশে গেছেন। কোনো সাড়া মেলেনি। এরকম তো অনেকেই থানা, পুলিশের বিরুদ্ধে নালিশ করছে। অনেকেই পুলিশের কাছে নালিশ করতেও সাহস পাচ্ছে না। নালিশ করতে গেলে বিপদ আরো বাড়তে পারে।
এখানেও তো নানা বৈষম্য। পুলিশ চাইলে যে কাউকে ছেড়ে দিচ্ছে আবার যে কাউকে আটক করছে। জঙ্গি পিতা আওয়ামী লীগ নেতা এখনো আটক হননি। অথচ বগুড়ায় এক গরিব পিতা-মাতাকে আটক করা হয়েছে।
এগুলোই তো বিপদ আরো বাড়াচ্ছে। প্রচার রয়েছে, ইতালি এবং জাপান বাংলাদেশে একটি অভিযান পরিচালনা করার সিদ্ধান্তের কথা জানাচ্ছে। এমন আলোচনা তো দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য শুভকর নয়। জি-৭ এর বর্তমান চেয়ারম্যান জাপান। এরপর হবে ইতালি। বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের জন্য খুবই উদ্বেগজনক।
জাগো নিউজ : এটি তো সরকারেরও বোঝার কথা?
সাখাওয়াত হোসেন : অবশ্যই। বুঝতে পারছে বলেই গুলশান ট্র্যাজেডির পর প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে ঢালাওভাবে কাউকে দোষারোপ করেননি। একইভাবে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াও আগের অবস্থান থেকে সরে এসে বক্তব্য রেখেছেন। সজীব ওয়াজেদ জয় তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে প্রশাসনের ব্যর্থতার কথা বলেছেন। এটি অবশ্যই ভালো দিক।
জাতীয় সমস্যা বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন। আসলে তাই। মধ্যপ্রাচ্যে একদিনে কখনো এতগুলো বিদেশি লোক মারা যাননি। অনেক লোক মারা যেতে পারে। কিন্তু বিদেশি এক সঙ্গে এতজন মারা যাননি। ইন্ডিয়ার তাজ হোটেলে এর চেয়ে বেশি লোক মারা গিয়েছিল। কিন্তু সেটার প্রেক্ষাপট ভিন্ন।
জাগো নিউজ : সমাধানের পথ কি?
সাখাওয়াত হোসেন : জঙ্গি সমাধানে মানুষের ভাবনায় গুরুত্ব দেয়া জরুরি। গুলশানের ঘটনায় সবাই ভাবছে। মানুষ কি মনে করে, তা সামগ্রিকভাবে আমলে নিতে হবে। আপনি একক কোনো পথ দিয়ে এর সমাধান বের করতে পারবেন না।
মানুষের বিশ্লেষণ কাউকে ছোট করার জন্য নয়। সরকার বিপদে পড়ুক তা আমরা কেউই চাই না। ভুল সবারই হতে পারে। ভুল হচ্ছে বা হতে পারে তা বুঝতে পারাই হচ্ছে সমাধান।
গুলশানের ঘটনায় তো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অনেকটাই দুর্বল হতে দেখলাম। অনেকেই লাইফ জ্যাকেট পরতেও কাঁপছিলেন। টেলিভিশনে তো অনেক কিছুই দেখতে পেল জাতি। পাঠান কোট বা তাজ হোটেলের মত ঘটনা ঘটলে কি হতো, তা বোঝা মুশকিল।
এরপরও কোনোটির সঙ্গে কোনোটির তুলনা হয় না। কিন্তু প্রতিটি ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হয়।
জাগো নিউজ : গুলশানে অপারেশন থান্ডার বোল্ট নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?
সাখাওয়াত হোসেন : প্রথমে অগোছালো ছিল। কেউ কিছুই বুঝতে পারছিল না। তবে প্রধান দুর্বলতা ছিল ওই এলাকার লাইটের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকা। এমন অপারেশনে আগে লাইটের নিয়ন্ত্রণ রাখতে হয়। প্রয়োজনে লাইট চালু থাকত আবার প্রয়োজনে লাইট বন্ধ থাকত। হঠাৎ করে লাইট বন্ধ হলে হুড়াহুড়ি পড়ে যেত। এতে অনেকেই হয়ত পালিয়ে আসারও পথ পেত। এগুলো হচ্ছে অনুমান। তবে অনুমান অনেক সময় সত্যও হয়। হয়ত নিহতদের কেউ কেউ প্রাণেও রক্ষা পেতেন। লাইটে দেখে দেখে জঙ্গিরা গলা কেটে হত্যা করছে। আবার ছবি তুলে তারা ফেসবুকে পোস্ট করছে। জঙ্গিরা খুব সফলভাবে তাদের অভিযান পরিচালনা করছে।
তবে শেষ বেলায় সেনাবাহিনীর অপারেশন অনেক তীক্ষ্ম এবং ক্ষিপ্র ছিল। এমন অপারেশনের ধরন এরকমই হতে হয়। অনেক গুছিয়ে অপারেশন পরিচালনা করেছে সেনাবাহিনী। কিন্তু যা হবার তা তো রাতেই হয়ে গেছে।
এএসএস/একে/এসএইচএস/আরআইপি