গুটি আমেই কৃষকের ভাগ্য বদলাচ্ছে প্রাণ
‘গুটি (আটি) আম এক সময় ফেলে দিতাম। তেমন দাম ছিল না। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আটি আমের সমস্ত গাছ কেটে জমিতে অন্য কিছু করব। তা আর করতে হয়নি। এই আমে যে এত মধু আছে, তা আগে জানতাম না। প্রাণ কোম্পানি আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। আটি আমেই এখন সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছি। এ আমের পুষ্টিমান যে কোনো আম থেকে বেশি এবং এ থেকে উৎপন্ন যে কোনো পণ্যের স্থায়িত্বও বেশি।’
বলছিলেন, নাটোরের বাগাতিপাড়ার চকগুয়াস গ্রামের আমচাষি আকতার হোসেন রুবেল। তিনি নিজের ভাগ্য বদলিয়েছেন, প্রাণ কোম্পানিতে আটি আর আশ্বিনা আম বিক্রি করে। এ বছর ১০৫ বিঘার একটি বাগান থেকেই প্রায় দুই কোটি টাকার আম বিক্রি করতে পারবেন বলে জানান এই লাভবান কৃষক।
গাছের ফলন দেখিয়েই এমন টার্গেটের কথা শোনালেন তিনি। এর মধ্যে প্রায় এক কোটি টাকার আটি আম বিক্রি করার টার্গেট তার। ইতোমধ্যেই আম বিক্রি শুরু করেছেন বলেও জানালেন আকতার হোসেন। দামও পাচ্ছেন বেশ।
তিনি বলেন, ১৯৯৬ সাল থেকে আম চাষ শুরু করি। আটি আম বাজারে বিক্রি করতে পারতাম না। কোনো কোনো বছর হাজার হাজার মণ আম ফেলে দিতে হত। এরপর গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেই। ২০০০ সালের পর থেকে এই এলাকায় প্রাণ কোম্পানি এসে আম কেনায় আমাদের ভাগ্য বদলে যায়। আটি আমের গাছ আর কাটতে হয়নি। দিনে দিনে এর চাহিদা বেড়ে যায়। এখন সমস্ত স্বপ্ন আটি আম চাষ করেই।
সফল এই কৃষক বলেন, আটি আম চাষে এখন অনেক কৃষকই উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। বাণিজ্যিকভাবে অন্যান্য আমের চাষ থাকলেও ব্যাপকহারে এখন আটি আমের চাষ হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে, আটি আম থেকে আমজাত পণ্যের মান সবচেয়ে ভালো এবং স্থায়িত্ব বেশি হয়।
একই বাগানের সহযোগী চাষি দেলাওয়ার হোসেন বলেন, প্রাণের সহযোগিতায় ১০ বছর ধরে আম চাষ করে আসছি। প্রাণের সঙ্গে চুক্তি করে আম চাষ করে অনেকটই নিশ্চিত থাকতে পারি।
দেলাওয়ার আইএ পাস করে একটি জাহাজ কোম্পানিতে চাকরি করতেন। চাকরি ছেড়ে ২০০৫ সালে আম চাষে নামেন। এরপর আর পেছনের দিকে তাকাতে হয়নি। বছর গেলেই ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা লাভ করতে পারছেন।
দেশব্যাপী প্রাণ-এর প্রায় ১৩ হাজার চুক্তিভিক্তিক আমচাষি রয়েছেন। কৃষি হাবের মাধ্যমে আমচাষিদের বছরব্যাপী নানাভাবে সহযোগিতা করে প্রাণ। স্বল্পমূল্যে উন্নত জাতের আমের চারা, রোপণ প্রক্রিয়া, সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, রোগ-বালাই দমন বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
প্রশিক্ষিত কৃষকের কাছ থেকে প্রাণ ন্যায্যমূল্যে আম কিনে নেয় এবং এতে কৃষক অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত থাকতে পারছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ ও দিনাজপুর থেকে বিপুল পরিমাণ প্রাণ কোম্পানি আম সংগ্রহ করে কাঁচামাল হিসেবে। সংগৃহীত আম থেকেই উন্নতমানের ফ্রুট ড্রিংক, ম্যাংগো বার, চাটনি প্রভৃতি আমজাত খাদ্য পণ্য প্রস্তুত করা হয়। দেশ-বিদেশে এসব পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বলে কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে প্রাণ কোম্পানি বর্তমানে ১৩০টি দেশে এসব পণ্য রফতানি করছে।
২০০০ সালে নাটোরের একডালায় ৪২ একর জমির উপর প্রাণ এগ্রো লিমিটেড কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। কারখানাটিতে প্রায় ৬ হাজার লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে, যার এর নব্বই ভাগই নারী।
এছাড়া আমের মৌসুমে আরো বাড়তি হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ মেলে এ কারখানায়। আম ছাড়াও বিভিন্ন মৌসুমে টমেটো, বাদাম, ডাল, পেয়ারা, আনারস, হলুদ ও মরিচসহ বিভিন্ন কৃষিজাত ফসল সংগ্রহ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়।
প্রাণ এগ্রো লিমিটেড কারখানার উপ-মহাব্যবস্থাপক হযরত আলী। তিনি বলেন, ‘দেশীয় উন্নত জাতের আম সংগ্রহ করে প্রাণ আমজাত পণ্য তৈরি করে ইতোমধ্যেই বিশ্ব দরবারে সুনাম অর্জন করেছে। এ বছর আমরা ২৪ মে থেকে আম সংগ্রহ শুরু করেছি। চলবে আগস্ট পর্যন্ত।’
চাষিদের কাছ থেকে মূলত গুটি (আটি) এবং আশ্বিনা আম সংগ্রহ করা হয় উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এ বছর প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন পাকা আম সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা।’
সংগৃহীত আম থেকে ১২টি ধাপে পাল্প তৈরি করা হয়। বাকিটা আমের বিচি এবং খোসা হিসেবে আলাদা হয়ে যায়, যা পরবর্তীতে জ্বালানির কাজে ব্যবহৃত হয়।
প্রাণ এগ্রো লিমিটেড কারখানার ম্যানেজার (পাল্পিং) মো. হেফজল হোসাইন বলেন, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রাণ কোম্পানি আমের পাল্পিং করে থাকে। কোয়ালিটি কন্ট্রোলার দ্বারা আম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এরপর ল্যাবে পাঠানো হয়। পরে আমের ওজন সঠিক কি না, তা দেখা হয়। ল্যাব টেস্টে উত্তীর্ণ হলেই তা ফ্যাক্টরিতে প্রসেসের জন্য নেয়া হয়। এরপর বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্রসিং করে পাল্প সংগ্রহ করে, তা স্বাস্থ্যসম্মতভাবে রাখা হয়।
তিনি আরো বলেন, সংগৃহীত এই পাল্প আ্যাসেপটিক প্রযুক্তিতে সংরক্ষণ করা হয়। এতে হিমায়িতকরণ ছাড়া কমপক্ষে এক বছরের জন্য পাল্প নিরাপদ, তাজা এবং স্বাদ ধরে রাখা যায়।
এএসএস/এসএইচএস/পিআর