অর্গানিক খাদ্য উৎপাদনে পিছিয়ে বাংলাদেশ
জৈবখাদ্য বা অর্গানিক ফুড কোনো প্রকার রাসায়নিক বা কীটনাশকের ব্যবহার ছাড়াই উৎপাদিত খাদ্য। বিশ্বব্যাপী এ নিরাপদ খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে, বাড়ছে চাষাবাদও। কিন্তু সেই তুলনায় কৃষিনির্ভর দেশ হয়েও অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ।
এখনও বিশ্বের যেসব দেশে মোট চাষযোগ্য জমির মাত্র এক শতাংশ জমিতে অর্গানিক চাষাবাদ হয়, সেই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থানও রয়েছে। তাও আবার অনেক দেশের পেছনে। বাংলাদেশে মাত্র ৮ হাজার ৩০ হেক্টর জমিতে অর্গানিক চাষাবাদ হচ্ছে। এশিয়ার অধিকাংশ দেশেই বাংলাদেশের চেয়ে বেশি অর্গানিক পণ্য উৎপাদন হয়। সম্প্রতি ‘বিশ্ব জৈব কৃষি ২০২১ : পরিসংখ্যান ও দ্রুত বর্ধনশীল প্রবণতা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সারাবিশ্বে এখন ৫৭ দশমিক ৮ মিলিয়ন জমিতে অর্গানিক চাষাবাদ হচ্ছে, যা মোট জমির ১ দশমিক ২ শতাংশ। এশিয়া মহাদেশে সার্বিক অর্গানিক চাষাবাদের হার দশমিক ৩ শতাংশ। এ অঞ্চলে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে চীন ও ভারত। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে খারাপ। অর্গানিক চাষাবাদে বাংলাদেশের তুলনায় এগিয়ে ভুটান, নেপাল ও পাকিস্তান।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর অর্গানিক এগ্রিকালচার মুভমেন্টের (আইএফওএএম) সদস্য ও বাংলাদেশ জৈব কৃষি নেটওয়ার্কের ড. মো. নাজিম উদ্দিন বলেন, দেশে সামগ্রিক কৃষিতে অর্গানিকের অবদান অনেক কম, তা অস্বীকার করা যায় না। রাতারাতি সারাদেশে অর্গানিক চাষাবাদ প্রবর্তন করা সম্ভবও নয়। এজন্য ব্যাপক প্রস্তুতি দরকার। সরকার কৌশলগত কিছু উদ্যোগ নিলেও বাস্তবে এর অগ্রগতি উল্লেখ করার মতো নয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ খাদ্যনিরাপত্তার দেশে অর্গানিকের বিকল্প নেই। কিন্তু এখনও অর্গানিক ফুড নিয়ে কিছু ভুল ধারণাও আছে। রাসায়নিক সার প্রয়োগে উৎপাদনকে গুরুত্ব দেয়া হলেও অর্গানিক উৎপাদনকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। ফলে আমরা পিছিয়ে পড়ছি।
এদিকে বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশের খাদ্যের জোগান দেয়া জৈব কৃষির পক্ষে আদৌ সম্ভব কি-না তা নিয়ে দেশের নীতিনির্ধারক মহল এখনও সন্দিহান। যদিও এ বিষয়ে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) নিশ্চিত করছে যে, জৈব কৃষি সারা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম। এফএও’র বিজ্ঞানীরা একটি তাত্ত্বিক মডেলে বিশ্বের মোট আবাদি জমির পরিমাণ ও ফলন না বাড়িয়েই শুধু জৈব কৃষির মাধ্যমেই বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্য দৈনিক দুই হাজার ৬৪০ থেকে চার হাজার ৩৮০ কিলো ক্যালরি খাদ্যের জোগান দেয়া সম্ভব হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছে, অধিক উৎপাদনের আশায় দেশে উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড ও জিএম শাক-সবজিসহ অন্যান্য ফসল ও ফলমূল উৎপাদনে ঝুঁকছে কৃষক। এসব পদ্ধতিতে দফায় দফায় প্রয়োগ করা হচ্ছে বিষাক্ত কীটনাশক। আবার বাজারজাত করার আগে পাকানোর জন্য কার্বাইডসহ পচন রোধে অতিমাত্রায় রাসায়নিক প্রয়োগ করতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য শাকসবজি ও ফলমূলে মেশানো হচ্ছে নানা বিষাক্ত রঞ্জক, যা ওই সব খাদ্যের সঙ্গে মানবদেহে প্রবেশ করছে। এসব খাদ্য খেয়ে কমে যাচ্ছে জীবনী শক্তি ও আয়ুষ্কাল। সঙ্গে শরীরে ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগসহ নানাবিধ রোগব্যাধির প্রকোপ বাড়ছে।
জানা গেছে, দেশে ষাটের দশকের আগে স্বাভাবিকভাবেই পুরো কৃষি ব্যবস্থা ছিল জৈবনির্ভর। কিন্তু এরপর থেকে বাণিজ্যিক চাষাবাদ বৃদ্ধির সঙ্গে বিলুপ্ত হতে থাকে এ ধরনের কৃষি। বাড়তে থাকে খাদ্য ঝুঁকি। এভাবে বিগত সময়ে খাদ্যনিরাপত্তায় নিম্ন সারিতে এসে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। এমতাবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ অন্যান্য দেশ নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ কৃষির টেকসই উন্নয়নে অর্গানিককে গুরুত্ব দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করছে।
এদিকে বাংলাদেশে এখন যেটুকু অর্গানিক পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে তাও শতভাগ অর্গানিক নয়- জানিয়ে বাংলাদেশে অর্গানিক পণ্য উৎপাদনকারী সমিতির সভাপতি কামরুজ্জামান মৃধা বলেন, দেশে শতভাগ অর্গানিক পণ্য উৎপাদন এখনও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এখন সেমি-অর্গানিক পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। ফলে অর্গানিক পণ্য উৎপাদনকারী হিসেবে বাংলাদেশ স্বীকৃত নয়।
ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, বিশ্ব স্বীকৃত উপায়ে শতভাগ অর্গানিকভাবে কোনো পণ্য বা ফসল উৎপাদনের জন্য সেই উৎপাদকের খাদ্যও অর্গানিক হতে হয়। অর্থাৎ অর্গানিকের সব স্তরের উপাদানগুলো অর্গানিক হওয়া প্রয়োজন, যা বাংলাদেশে হচ্ছে না।
এদিকে বিশ্ব জৈব কৃষির ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০১৩ সালের পর থেকেই অর্গানিক চাষাবাদের জমি বাড়ছে না। সর্বশেষ ২০১৯ সালে এদেশে ১০১টি অর্গানিক চাষাবাদের প্রকল্প চালু ছিল। যেখানে প্রায় ১০ হাজার উদ্যোক্তা সম্পৃক্ত।
বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার অর্গানিক চাষাবাদ বাড়াতে ‘ন্যাশনাল অর্গানিক এগ্রিকালচার পলিসি-২০১৬’ বাস্তবায়ন ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘ন্যাশনাল অর্গানিক স্ট্যান্ডার্ড বোর্ড’ গঠনের পরিকল্পনা করেছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের চা একটি উল্লেখযোগ্য অর্গানিক পণ্য। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘কাজী অ্যান্ড কাজী’ ২০১০ সাল থেকে অর্গানিক পদ্ধতিতে চা রফতানি করছে। এছাড়াও সরকারের দুটি সংস্থার উদ্যোগে পাট পাতার চা আবিষ্কার করা হয়েছে। এ পর্যন্ত আড়াই টন অর্গানিক চা জার্মানিতে রফতানি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। এছাড়া ২০১৭ সালে ‘সাহবাজপুর টি লিমিটেড’ ১২ দশমিক ৪ টন অর্গানিক ব্ল্যাক টি উৎপাদন করেছে। এছাড়া দেশে ব্যক্তি উদ্যোগে অর্গানিক কাজুবাদাম উৎপাদন করে বিদেশে রফতানি হচ্ছে।
দেশের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, এসব প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেশে অর্গানিক চাষাবাদ নিয়ে কাজ করছে প্রশিকা, উবিনীগ, উন্নয়নধারা, হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড, অ্যাকশনএইড, রাজশাহী কৃষি পাঠাগার, বারসিক, এএলআরডি, কারিতাসের মতো আরও শতাধিক প্রতিষ্ঠান।
এনএইচ/এআরএ/এসএইচএস/জিকেএস