শেখ হাসিনা থাকলে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই
শাহরিয়ার কবির। বিশিষ্ট সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি। সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ এবং যুদ্ধাপরাধ বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন দীর্ঘকাল। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে নানা ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে ‘ভারত অকৃত্রিম বন্ধু’ উল্লেখ করে দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রাখার অভিমত ব্যক্ত করেন। ভারত-চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের বিষয় নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। আলোচনা করেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রসঙ্গ নিয়েও। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন আপনারা। চীন-বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে ভারতের মিডিয়াও সমালোচনা করেছে। কেন আপনাদের উদ্বেগ?
শাহরিয়ার কবির : বাংলাদেশের রাজনীতি ও ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত রেখে কূটনৈতিক আলোচনা করতে হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত-রাশিয়ার যে ভূমিকা তার বিপরীতের ভূমিকা হচ্ছে পাকিস্তান-চীন-যুক্তরাষ্ট্র এবং তথাকথিত মুসলিম দেশগুলোর। মূল্যায়নও করতে হবে দুই বিপরীত দিক থেকে।
পাকিস্তান ও চীনের ভূমিকাকে একবারেই এক করে দেখতে চাই। চীন শুধু মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাই করেনি, জাতিসংঘের সদস্য পদ পেতে বাংলাদেশর বিপক্ষে বারবার ভেটো দিয়েছে। চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল বঙ্গবন্ধু হত্যার ১৬ দিন পর। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর চীন বলেছিল, এখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া যেতে পারে। তার মানে, বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রে চীনকেও সম্পৃক্ত করার সন্দেহ থাকতে পারে।
জাগো নিউজ : চীন নিয়ে বাঙালির একসময় কিন্তু মোহ ছিল…
শাহরিয়ার কবির : হ্যাঁ। আমাদের মধ্যে চীন নিয়ে একসময় মোহ ছিল। বঙ্গবন্ধু নিজেও চীন ঘুরে এসে সমাজতন্ত্রের প্রশংসা করেছেন। কিন্তু সেই চীন আজ আর নেই। আমরা এর আগে বলেছি, চীন এখন সাম্রাজ্যবাদে রূপ নিয়েছে। আমেরিকার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। আধিপত্য বিস্তারে চীনের যে মহাপরিকল্পনা সেখানে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো নিয়ে বিশেষ নকশা আছে। গরিব দেশগুলোকে ঋণের ফাঁদে ফেলছে।
এর একটি ইউনিক উদাহরণ হচ্ছে পাকিস্তান। আমি পাকিস্তানে বহুবার গিয়েছি। পাকিস্তানের গভীর সমুদ্র বন্দর যেভাবে দখলে নিয়েছে, তাতে মনে হয়েছে সেটি চীনের একটি ভূখণ্ড। হাইওয়ে তৈরি করতে চীনের কাছ থেকে ৪০ বিলিয়ন ঋণ নিয়েছে পাকিস্তান, যা কখনও শোধ করতে পারবে বলে মনে হয় না।
সাধারণ পাকিস্তানিদের মধ্যে চীনের বিরুদ্ধে আমি ক্ষোভ দেখেছি। চীনারা কয়েকগুণ বেশি দামে বাড়ি ভাড়া নিয়ে নিচ্ছে। ফলে স্থানীয়রা বাড়ি ভাড়া পাচ্ছে না। পাকিস্তানের মানুষ আমাকে বলেছে, ‘চীন যাদের বন্ধু, তাদের আর শত্রুর দরকার হয় না।’
বাংলাদেশেও চীন বড় আকারে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোনাদিয়া পোর্ট এবং বঙ্গোপসাগরে চীনকে ঘাঁটি করার ব্যাপারে সরাসরি না করে দিয়েছেন। শেখ হাসিনা থাকলে চীন বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কা বা আফ্রিকার মতো আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে না।
জাগো নিউজ : তাহলে ভয় কীসের?
শাহরিয়ার কবির : আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকবে; তবে সেটা সচেতন থেকে।
জাগো নিউজ : যুক্তরাষ্ট্রসহ যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল বাংলাদেশ তাদের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়ন করেছে। তাহলে চীনের বেলায়...
শাহরিয়ার কবির : কূটনৈতিক সম্পর্ক যার সঙ্গেই রাখুন সেখানে দেশের স্বার্থ সবার আগে। এমনকি ইসরায়েলের সঙ্গেও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আমি বিশেষ কোনো সমস্যা দেখি না। ২৫ নম্বর দেশ হিসেবে ইসরায়েল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
জাগো নিউজ : আপনি কি চান ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ভালো হোক?
শাহরিয়ার কবির : ইসরায়েল যদি আমাদের দাবি মেনে নেয় অর্থাৎ ফিলিস্তিনিদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়, তাহলে ইসরায়েল স্বীকৃতি পেতেই পারে। ইসরায়েল প্যালেস্টাইনের সার্বভৌমত্ব মেনে নিলেই সমস্যার সমাধান হবে। এটি পুরো পৃথিবী চাইছে। ইসরায়েলের আগ্রাসী নীতির বিপক্ষে আমরা।
আমরা এক চীন নীতিতেও বিশ্বাস করি। তাইওয়ানকে স্বীকৃতি না দিয়ে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এখানে আমি অসুবিধার কিছু দেখি না। আমি অসুবিধা দেখছি চীনের ঋণের ফাঁদ নিয়ে। এই ফাঁদ থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব কি-না? দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে কারও সঙ্গে সম্পর্ক আমরা চাই না।
খবরের কাগজে আসছে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন ৩ থেকে ৪ ডলারে মিলবে। চীন বলছে, তাদের ভ্যাকসিন ৭৩ ডলারে বিক্রি করবে। চীন তার জাতীয় স্বার্থের বাইরে কোথাও যাচ্ছে না।
জাগো নিউজ : এমন স্বার্থ ভারতেরও…
শাহরিয়ার কবির : হ্যাঁ, ভারতের সঙ্গে আমাদের অনেক বিষয় নিয়ে টানাপোড়েন আছে। আমি অশোক রায়ের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, যিনি ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে দিল্লির যোগাযোগ নির্ধারণের দায়িত্বে ছিলেন। তার কাছে জানতে চাইলাম, ‘আপনি বলতে পারেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত কত টাকা খরচ করেছিল? অশোক রায় জবাবে বললেন, ‘না। মিসেস ইন্দিরা গান্ধী এই খরচের রেকর্ড রাখতে নিষেধ করেছিলেন।’ ভারত সম্পূর্ণ নিঃশর্তরূপে কাজটি করেছিল।
শরণার্থীদের দিক থেকে একটা হিসাব থাকতেই পারে। কিন্তু ভারতের সাধারণ মানুষ যেভাবে পাশে দাঁড়িয়েছিল, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী যেভাবে সহযোগিতা করেছিলেন, তা বিস্ময়করও বটে।
জাগো নিউজ : মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের কথা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। কিন্তু ভারত কী সেই জায়গায় আছে? ভারতও এখন বাংলাদেশ প্রশ্নে আগ্রাসী নীতিতে...
শাহরিয়ার কবির : অনেকেই এমন করেন। ভারত মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছে, সেটি একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট। প্রশ্নটি যদি আমি ঘুরিয়ে বলি…, ১৯৭১ সালে ভারত যদি সহায়তা না করত তাহলে কী হতো? সীমান্ত যদি সিলগালা করে দিত, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কোথায় গিয়ে দাঁড়াত? ৭০ বছর ধরে ফিলিস্তিনের মানুষ যুদ্ধটা চালিয়ে যাচ্ছে। আরব বিশ্বের কোনো কোনো দেশ ফিলিস্তিনিদের সহায়তা করছে। কিন্তু সেটি খয়রাতির মতো। ভারত মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে যেভাবে সহায়তা করেছে, তা অন্য কোনো সম্পর্কে মেলে না।
জাগো নিউজ : কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এমনকি বামপন্থীদেরও কেউ কেউ মনে করেন, ভারত মূলত মুক্তিযুদ্ধে প্রক্সি ওয়ারে (বদলি যুদ্ধ) লিপ্ত ছিল, যে কারণে বাঙালি সত্যিকার স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি…
শাহরিয়ার কবির : এটি পাকিস্তানের প্রোপাগান্ডা। পাকিস্তানিরা সবসময় বলে যে, ভারত ১৯৪৭ সালের পর থেকেই পাকিস্তানকে ভাগ করতে চেয়েছিল।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসন এবং শোষণের ধারাবাহিকতার ফসল। এটি তো অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। ভারত মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হয়েছে বলে হয়তো নয় মাসে আমরা স্বাধীন হতে পেরেছি। নয়তো ৯ বছর লাগত। ৩০ লাখের জায়গায় হয়তো তিন কোটি লোক মারা যেত।
আসল কথা হচ্ছে, ভারতের এই সহযোগিতা আমাদের ভুলে যাওয়া চলবে না। এই সত্য যারা ভুলিয়ে দিতে চাইছে, তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ১৯৪৭ সালে ফিরে যাওয়া। ২০০০ সালে একটি ইফতার মাহফিল গোলাম আযম পরিচালনা করছিলেন, যেখানে খালেদা জিয়াও উপস্থিত ছিলেন। গোলাম আযম সেখানে বললেন, ‘১৯৭১ নয়, আমাদের ১৯৪৭ সালে ফিরে যেতে হবে।’ তার মানে ধর্মের ভিত্তিতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্বের দিকে যেতে হবে। ধর্মের নামে শোষণ-পীড়ন, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের বৈধতা দেয়া যাবে। আমরা তো এখান থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি।
জাগো নিউজ : মুক্তিযুদ্ধে ভারত সীমানা সিলগালা করেনি বলে উল্লেখ করলেন। অথচ ভারত এখন কাঁটাতারে ঘিরে ফেলছে বাংলাদেশকে। আর ধর্মের রাজনীতি তো গুরুত্ব পাচ্ছে সর্বত্রই, যা গোলাম আযমের স্বপ্ন ছিল...
শাহরিয়ার কবির : এই প্রশ্নের উত্তর শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তার জীবদ্দশায় দিয়ে গেছেন। ভারত যখন সিকিম দখল করল, তখনও প্রশ্ন উঠেছিল যে, বাংলাদেশকে ভারত কলোনি বানাতে চাইছে। তখন ইন্দিরা গান্ধী জবাবে বলেছিলেন, ‘যে জাতি ২৪ বছর লড়াই করে এবং এরকম একটি ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভ করেছে, সে জাতিকে কেউ উপনিবেশ বানাবে, এমন শক্তি পৃথিবীতে নেই।’ বাঙালির শক্তি নিয়ে তিনি এভাবে মূল্যায়ন করেছেন।
জাগো নিউজ : তাহলে চীনকে নিয়ে আপনি উদ্বেগ প্রকাশ করছেন কেন?
শাহরিয়ার কবির : আমি মনে করি, শেখ হাসিনা যত দিন ক্ষমতায় আছেন তত দিন উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ আছে। সোনাদিয়া পোর্ট চীন বা আমেরিকার কাছে দিয়ে দেবেন, তা তিনি জনসম্মুখে বলেছেন।
মূল বিষয় হচ্ছে, বঙ্গোপসাগরে কার আধিপত্য থাকবে। আমেরিকার আধিপত্য নাকি চীনের?
এএসএস/এমএআর/জেআইএম