ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

বিজেপি চাইছে বাংলাদেশে সহিংস আন্দোলন হোক

সায়েম সাবু | প্রকাশিত: ০৮:৫০ এএম, ০৪ মার্চ ২০২০

আলতাফ পারভেজ। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসবিষয়ক গবেষক। লিখছেন রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। দিল্লির দাঙ্গা নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। দাঙ্গার ফলে বিজেপির জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে বলে মত দেন।

বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ায় বিজেপিকে মোকাবিলা দুরূহ হয়ে পড়ছে বলেও উল্লেখ করেন। দিল্লির আগুন যেন বাংলাদেশে না লাগে, সেজন্য সতর্ক থাকারও আহ্বান জানান এ বিশ্লেষক। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ : ভারতের রাজনীতিতে বহুত্ববাদের উপস্থিতি ছিল বেশ জোরালোভাবে। নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যমও এ বহুত্ববাদের নীতিকে অনুসরণ করে সরব থেকেছে। অথচ, বিজেপির নীতির কাছে সবাই হেরে যাচ্ছে। এর কী কারণ?

আলতাফ পারভেজ : ভারতের রাজনীতিতে বহুত্ববাদের উপস্থিতি আছে, এটি অস্বীকার করা যায় না। বিশেষ করে সংখ্যালঘুরা রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল বটে। কিন্তু এর বিপরীতেও কথা আছে।

রাষ্ট্রীয়ভাবে সংখ্যালঘুরা আগে থেকেই ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত। ভারতের সংস্কৃতিতে বহুত্ববাদের উপস্থিতি আছে ঠিক, কিন্তু অর্থনীতি ও ক্ষমতার পরিসরে সংখ্যালঘুরা বঞ্চিত। আপনি সেনাবাহিনী, আদালত, পুলিশ প্রশাসন দেখেন; আনুপাতিক হারে সংখ্যালঘুদের পাবেন না।

উদাহরণ দিয়ে বলি, পশ্চিমবঙ্গে শতকরা ২৫ ভাগ মুসলমান জনগোষ্ঠী। সেখানে বামফ্রন্ট ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল। সেই বামফ্রন্টের আমলেও দেখা গেছে, সরকারি চাকরিতে মুসলমানরা মোট ৫ ভাগ চাকরির সুবিধা পেয়েছেন। তার মানে, বহুত্ববাদের আলোচনা থাকলেও তার সঠিক চর্চা করা হয়নি। এ কারণেই আমি মনে করি, বিজেপি তার রক্ষণশীল আচরণ নিয়ে জোর করে ক্ষমতায় বা রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছে, ব্যাপারটি তেমন নয়। বিজেপিকে অন্যরাই জায়গা করে দিয়েছে।

জাগো নিউজ : এরপরও দিল্লির ঘটনায় মুসলমানদের পাশে কোনো কোনো হিন্দু দাঁড়িয়েছে। দাঁড়াচ্ছে অন্য জায়গাতেও…

আলতাফ পারভেজ : এটি সত্য। এ সত্য কথা যে মিডিয়ায় আসে, আমরা তা দেখতে অভ্যস্ত। অন্য খবর হয়ত দেখি না। এ নিরপেক্ষ গোছের গণমাধ্যমগুলোও তো এখন সংখ্যালঘু। বাস্তবতাটা বুঝতে হবে।

delhi

ভারতের অনেক হিন্দু চায়, মুসলমানরা থাকুক। তারা দাঙ্গার বিপক্ষে। কিন্তু তারা সংখ্যায় খুবই কম। তারা ভোটে বিজেপিকে থামাতে পারবে না।

আমার পর্যবেক্ষণ হলো, ভারতের মুসলমানরা আপাতত মার খেয়েই যাবে। ধর্মনিরপেক্ষ, মানবতাবাদীরা এ হিংসা থামাতে পারবেন না

জাগো নিউজ : জুলুম থেকেও কিন্তু প্রতিরোধ হয়…

আলতাফ পারভেজ : সেই প্রতিরোধ ভারতের মুসলমানরা গড়ে তুলতে পারবেন না। তবে মার খেতে খেতে ভিন্ন কিছু ঘটতে পারে। জুলুমের একপর্যায়ে মুসলমানদের কেউ কেউ র‌্যাডিক্যাল (উগ্রবাদী) আচরণ প্রকাশ করতে পারেন।

তখন কিন্তু মুসলমানদের জঙ্গি বলাটা সহজ হবে। বলাটা আরও সহজ হবে এ কারণে যে, ভারতের বন্ধু এখন আমেরিকা ও ইউরোপ। যদিও ব্যবসার জন্য এ বন্ধুত্ব। বিজেপি খুব ভালো করে বুঝতে পারছে যে, এ ব্যবসায়িক বন্ধুত্বের কারণেই ইউরোপ-আমেরিকা ভারত নিয়ে নাক গলাবে না।

জাগো নিউজ : উগ্রবাদের বিস্তার কারও জন্য ভালো নয়…

আলতাফ পারভেজ : নরেন্দ্র মোদি সরকার এমন উগ্রবাদীতাকেই দেখাতে চাইবে। উগ্রবাদের বিস্তার ঘটবে, আমি তা বলছি না। কিন্তু মোদির জন্য এটি প্রয়োজন। বিশ্ব ও বিশ্ব মিডিয়াকে দেখানো সহজ হবে এবং মুসলিমবিরোধী অবস্থানে একপ্রকার ন্যায্যতা পাবে। আসাম, কাশ্মীর, গুজরাট, দিল্লির ঘটনা মানুষ ভালোভাবে নিচ্ছে না। এসব আড়াল করতেই জঙ্গি ইস্যু তৈরির তাগিদ অনুভব করছেন মোদি।

জাগো নিউজ : ভারতের এ পরিস্থিতি আসলে কোথায় গিয়ে ঠেকবে? সময়সীমা ধরে কোনো পর্যবেক্ষণ আছে কি-না?

আলতাফ পারভেজ : যারা বিজেপিবিরোধী রাজনীতি করছেন, তারাও নরম সুরে বিজেপির রাজনীতিই অনুসরণ করছেন। এ রাজনীতি দিয়ে বিজেপিকে ঠেকাতে পারবে না। মুসলিম বা অন্যান্য সংখ্যালঘুদেরও রক্ষা করতে পারবে না। কারণ তাদের রাজনীতি আপাতত পরিবর্তন হওয়ার কোনো সম্ভবনা দেখা যাচ্ছে না।

delhi

আগেই বলেছি, বামপন্থীরা যদি মানুষের আবেগ ধারণ করতে পারে, তাহলে পরিবর্তন হতেও পারে। ভারতে এখনও ৩০ ভাগ মানুষ দরিদ্র। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে এ ৩০ ভাগ মানুষের আসলে কিছুই পাওয়ার নেই। মুসলমানদেরও নেই। গরিব-সাধারণ মানুষরা যখন বুঝতে পারবে বিজেপির রাজনীতি আসলে ধোকা ছাড়া কিছুই নয়, তখন হয়তো বিজেপির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারে।

জাগো নিউজ : ভারতের এ রাজনীতি বাংলাদেশের জন্য কি চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে?

আলতাফ পারভেজ : বিজেপি মনেপ্রাণে চাইছে, বাংলাদেশে যেন ভারতের মুসলিমবিরোধী ঘটনার সহিংস প্রতিবাদ হয়। বাংলাদেশে সহিংসতা হলে বিজেপি-আরএসএসের জন্য সুবিধা। বিজেপি-আরএসএস যা চাইছে, বাংলাদেশকে তার উল্টো আচরণ করতে হয়। বিশ্বকে দেখাতে হবে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আছে।

বাংলাদেশেও অনেক কাগুজে বাঘ আছে। তারা মিছিল করবে, বিক্ষোভ করবে। মানুষকে উস্কানি দিয়ে সহিংস আন্দোলন করতে চাইবে। এসব ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এটি আসলে কারও জন্যই ভালো হবে না। বিজেপি চাইছে বাংলাদেশে সহিংস আন্দোলন হোক।

জাগো নিউজ : বাংলাদেশে বিক্ষোভ-মিছিল হচ্ছে। ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়ছেও বটে…

আলতাফ পারভেজ : বিজেপির নীতির বিরুদ্ধে সারাবিশ্বেই প্রতিবাদ হবে। হচ্ছে। বাংলাদেশেও হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, দিল্লির দাঙ্গা বা বিজেপির মুসলিমবিরোধী নীতির জন্য বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা কোনোভাবে দায়ী নয়। এ কারণে তারা যেন কোনো প্রকার সহিংসতার শিকার না হন। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেয়া দেশের সংখ্যাগুরুদেরই দায়িত্ব।

আরএসএস-বিজেপি বারবার দেখানোর চেষ্টা করছে, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নেই। এটি একেবারেই ডাহা মিথ্যা কথা। বাংলাদেশ ভারতের অভিযোগ বারবার মিথ্যা প্রমাণ করেছে। মিথ্যা প্রমাণ করার আরেকটি সুযোগ এসেছে। দিল্লির দাঙ্গার প্রতিবাদে বাংলাদেশসহ আশেপাশের কোনো দেশেই সহিংস কোনো ঘটনা ঘটেনি। এটি একটি পজিটিভ সাইন। স্বাভাবিকতা ধরে রাখতে হবে আমাদের।

delhi

জাগো নিউজ : স্বাভাবিকতা থাকলেও ভারতের আজকের পরিস্থিতি গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বিষফোঁড়া কি-না?

আলতাফ পারভেজ : দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য সংখ্যালঘুরা খুব সুখে আছে, তা কিন্তু নয়। তারাও নানাভাবে বঞ্চনার শিকার, নিপীড়নের শিকার। কিন্তু দিল্লির ঘটনার পর যে সহিষ্ণুভাব প্রকাশ পেয়েছে, তা ভারতকেই লজ্জায় ফেলেছে। এ সহিষ্ণু অবস্থাও একধরনের প্রতিবাদ।

আশপাশের দেশে সংখ্যালঘুরা শান্তিতে থাকলে বিজেপি চ্যালেঞ্জে পড়বে। তারা আর নির্যাতনের উদাহরণ দিয়ে মানুষকে প্রভাবিত করতে পারবে না।

জাগো নিউজ : বিজেপির আগ্রাসনের পরের ক্ষেত্র কী হতে পারে?

আলতাফ পারভেজ : পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় ও জাতিগত হিংসা ছড়াবে। সামনে নির্বাচন। বিজেপি বারবার বাংলাদেশি ও বাংলাভাষী মানুষের প্রসঙ্গ এনে রাজনীতি করতে চাইছে। ভারতের যেসব রাজ্যে বিজেপি বিজয়ী হতে পারেনি, তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আগামী বছরের নির্বাচনে বিজয়ী হতে বিজেপি সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে পশ্চিমবঙ্গে। এ শক্তি প্রয়োগে যেকোনো হিংসা ছড়াতে পারে ধর্মবাদী সংগঠনটি।

জাগো নিউজ : দিল্লির দাঙ্গার পর এনআরসি প্রকল্প আরও গতি পাবে কি-না?

আলতাফ পারভেজ : দিল্লির দাঙ্গার পর নানা ঘটনাই ঘটবে। এনআরসি বিজেপির রাজনৈতিক এজেন্ডা। আসামে ইতোমধ্যে করে ফেলেছে। এনআরসি সর্বভারতে করতে চায় বিজেপি।

এনআরসির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও হবে। হচ্ছে। কিন্তু সে প্রতিবাদ হচ্ছে অসংগঠিত ছাত্র-তরুণদের পক্ষ থেকে। রাজনৈতিক দলগুলো সংগঠিতভাবে এমন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে না, যেখানে বিজেপি থামবে। অসংগঠিত আন্দোলন যত শক্তিশালীই হোক, তার ফলাফল দীর্ঘস্থায়ী হয় না।

delhi

গোটা বিশ্বে সবচেয়ে বড় সাম্প্রদায়িক একটি সংগঠন হচ্ছে আরএসএস। এমন একটি সংগঠনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে টিকে থাকা সহজ কথা নয়।

জাগো নিউজ : কাশ্মীর আলোচনা ক্রমশই আড়ালে পড়ে যাচ্ছে…

আলতাফ পারভেজ : কাশ্মীর আলোচনা আড়ালে পড়বে, তা স্বাভাবিক। কাশ্মীরে যখন ৩৭০ ধারা তুলে নেয়া হলো, তখন ভারতের অন্যান্য জায়গায় খুব জোরালোভাবে প্রতিবাদ হয়নি। এ প্রতিবাদ না হওয়া যে কত বড় ভুল, তা এখন বুঝতে পারছে ভারতের মানুষ। গত তিন বছরে আসামে যা ঘটেছে, তার প্রতিবাদ হয়নি। আসামে প্রতিবাদ হলে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল হতো না। কাশ্মীর রক্ষা পেলে বাবরি মসজিদ রক্ষা পেত, দিল্লিতে দাঙ্গা হতো না।

বিজেপি তার তৈরি প্রডাক্ট একটির পর একটি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে, আর অন্যরা বিজেপিরই সফট নীতি অনুসরণ করে যাচ্ছে। বিজেপিকে আটকানোর মতো আর কোনো শক্তি নেই।

আমার ধারণা, বিজেপি ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের পরিবর্তন আনবে।

জাগো নিউজ : আপনি ব্যবসায়িক প্রসঙ্গ টেনে ইউরোপ-আমেরিকার কথা বলছিলেন। মোদি সরকারের নীতি চীন-রাশিয়া কীভাবে দেখবে?

আলতাফ পারভেজ : ভারতে এসব শক্তি কাজ করবে না। বিশ্ব শক্তিগুলোর মূল লক্ষ্য হচ্ছে বাণিজ্য। ভারতে ১৩০ কোটি মানুষ। প্রচুর ব্যবসার জায়গা। এ জায়গা আমেরিকা, রাশিয়া, চীন কেউ-ই হারাতে চাইবে না।

জাগো নিউজ : ভারতের ভবিষ্যৎ কী?

আলতাফ পারভেজ : সহিংসতা আরও বাড়বে।

এএসএস/এমএআর/জেআইএম

আরও পড়ুন