মোদির ফের ক্ষমতায় আসা হবে কলঙ্কজনক অধ্যায়
ড. আলী রীয়াজ, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক। ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা শেষ করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যোগাযোগ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৩ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি নেন।
ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেয়ার আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রিটেনের লিংকন বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্ল্যাফলিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এছাড়া তিনি লন্ডনে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট হিসেবে কাজ করেন ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত। তিনি ‘স্ট্যাডিজ অন এশিয়া’ জার্নালের সম্পাদকও।
আরও পড়ুন > মোদিকে কেন আবার ক্ষমতায় চান না মানুষ?
আন্তর্জাতিক রাজনীতি পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করছেন। নির্মোহ গবেষণা রয়েছে পলিটিক্যাল ইসলাম ও জঙ্গিবাদ নিয়েও। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে মার্কিন রাজনীতি, চীন-মার্কিন পণ্যযুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি, শ্রীলঙ্কা-আফগানিস্তান, তালেবান-আইএস এবং সর্বশেষ মার্কিন- ইরান উত্তেজনার সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোকপাত করেন। বাংলাদেশের রাজনীতির পাশাপাশি রোহিঙ্গা ইস্যুতেও নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেন। পাঁচ পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে তৃতীয়টি।
জাগো নিউজ : সম্প্রতি চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ দেখতে পাচ্ছি। এর ফলাফল কী হতে পারে?
আলী রীয়াজ : চীন আরেকটু সময় নিয়ে দেখতে চায়। বাণিজ্যযুদ্ধ তো আসলে বাণিজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। পুরো এশিয়ায় চীনের বাণিজ্য বিস্তারের কাউন্টার অবস্থান নিতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প প্রশাসন চীনের ওপর বিশেষ চাপ তৈরি করতে ট্যারিফের (শুল্ক) বিষয়টি সামনে আনছে। কিন্তু সেটা সঠিক পদ্ধতি কি-না, তা নিয়ে আমার মনে গভীর সংশয় রয়েছে।
এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের যেভাবে চীনের প্রভাব মোকাবেলা করার কথা ছিল, তা পারেনি। ট্রান্সপ্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তির মাধ্যমে চীনকে মোকাবেলার সুযোগ তৈরি করেছিলেন ওবামা প্রশাসন। ট্রাম্প এসে তা বাতিল করলেন। আমি মনে করি, যেদিন ট্রাম্প টিপিপি বাতিলে স্বাক্ষর করেন, সেদিনই গোটা এশিয়াকে যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছে তুলে দিয়েছিল।
আরও পড়ুন > কখন জানা যাবে ভারতের নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল?
এখন বাণিজ্যযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেটি সামাল দেয়া সম্ভব নয়। ওবামা প্রশাসনের চুক্তি করা ছিল বলেই ট্রাম্প প্রশাসন তা বাতিল করে অদূরদর্শী পররাষ্ট্রনীতির প্রমাণ রেখেছে। কারণ ট্রান্সপ্যাসেফিক পার্টনারশিপে এ অঞ্চলে শুধু অর্থনৈতিক স্বার্থ নয়, রাজনৈতিক স্বার্থও নিহিত ছিল। সেই চুক্তি বাতিল করে এখন যে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে, তা শুধু উত্তেজনা ছড়াবে এবং তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভালো হবে বলে মনে হয় না।
শুল্ক বাড়ালে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ সাধারণ মানুষ কম দামের পণ্য কিনতে অভ্যস্ত। চীন কম দামের পণ্যই তৈরি করে বাজার সৃষ্টি করেছে। আমার মনে হয় না এ নীতি অবলম্বন করে চীনের প্রভাব কমাতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র।
জাগো নিউজ : চীনের আলোচনার মধ্যেই ভারত প্রসঙ্গে আসি। টাইম ম্যাগাজিন নরেন্দ্র মোদিকে চিফ ডিভাইডার ( বিভক্তির গুরু) হিসেবে আখ্যায়িত করলো। ভারতের নির্বাচন কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?
আলী রীয়াজ : যুক্তরাষ্ট্রের সমাজব্যবস্থার নানা প্রবণতার কথা বলেছিলাম, ভারতের ক্ষেত্রেও ঠিক তা-ই। সংখ্যার বিবেচনায় ভারতকে সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ বলা হয়। যদিও দেশটির সমাজ, রাজনীতির মধ্যে অগণতান্ত্রিক আচরণ বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
এ নির্বাচনে যদি নরেন্দ্র মোদির সরকার ফের ক্ষমতায় আসে, তাহলে সেটি ভারতের ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। এ শঙ্কা শুধু ভারতের মধ্যে নয়, এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর জন্যও।
নরেন্দ্র মোদির সরকার যেভাবে অসহিষ্ণুভাবে সংখ্যালঘুদের কথা বলার পথ বন্ধ করে দিয়ে শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছে, তা কোনো আদর্শ সমাজের চিত্র হতে পারে না। এ কারণেই বলছি, নরেন্দ্র মোদির ফের ক্ষমতায় আসা হবে কলঙ্কজনক অধ্যায়।
আমার এ মন্তব্য আপনার কাছে অগণতান্ত্রিক শোনাতে পারে। আপনি বলতে পারেন, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভোট দিলে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসতেই পারে। আমি ফলাফল মেনে নেব।
কিন্তু ভারতে নরেন্দ্র মোদির সময়ে যে উল্টো যাত্রা শুরু হয়েছে, তা শুধু দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, ভারত যদি এমন উগ্রশক্তি সঞ্চয় করতে থাকে, তবে তার প্রভাব বাইরে পড়বেই। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান বা পাশের দেশগুলোতে প্রভাব পড়বেই। ভারত যদি রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক বিবেচনায় সহিষ্ণুতাকে প্রধান মনে করতো, তাহলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এমন স্পষ্ট করে মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিতো না।
জাগো নিউজ : রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ তুললেন। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর কথা থাকলেও বাংলাদেশ তা পেরে উঠছে না। রোহিঙ্গা ইস্যুর ভবিষ্যৎ আসলে কী?
আলী রীয়াজ : রোহিঙ্গা ইস্যুতে শুরু থেকেই বাংলাদেশের নেয়া পদক্ষেপগুলো ভুল হয়েছে বলে মনে করি। এ কারণে রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে।
আরও পড়ুন > সামরিক ঐতিহ্য ইরানের সংস্কৃতির অংশ
রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে গিয়ে কতগুলো প্রস্তাব দিলেন। তখন অনুকূল পরিবেশ ছিল। বিশ্বমহলকে প্রস্তাবের পক্ষে চাপ দেয়ার সুযোগ ছিল। তা না করে বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মধ্যে চলে গেলো। সম্ভবত চীনের কারণেই বাংলাদেশকে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় যেতে হলো।
চীন যে তিন দফা সমাধানের কথা বলেছে, তার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার কথা রয়েছে। ভারত কতটুকু হস্তক্ষেপ করেছে, তা আমরা জানি না। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের নীতিই বাংলাদেশ ধারণ করেছে বলে স্পষ্ট।
ফলে আন্তর্জাতিকভাবে যেসব চাপ তৈরি করা যেতো, তা থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে এলো।
জাগো নিউজ : রোহিঙ্গা উপস্থিতি নিয়ে নানা আলোচনা আছে। আন্তর্জাতিক কোনো মহল রোহিঙ্গাদের ব্যবহারের সুযোগ পেতে পারে কি-না, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য…
আলী রীয়াজ : যে কোনো শরণার্থী সমস্যা নিরাপত্তার ইস্যুতে দেখতে অভ্যস্ত অনেকে। আমি এ ধারণার বিরুদ্ধে। পৃথিবীর অনেক জায়গায় শরণার্থী আছে। সব জায়গায়ই কিন্তু উগ্রবাদের জন্ম হয়নি।
রোহিঙ্গা সমস্যা শুরু হওয়ার পর অনেকে মিয়ানমারের আরসাকে আইএস-এর সঙ্গে মিলিয়ে আলোচনা করতে থাকলেন। আমি কিন্তু প্রথম থেকেই বলেছি, আরসার মতো ক্ষুদ্র সংগঠনকে কোনোভাবেই আন্তর্জাতিক সংগঠনের অংশ বিবেচনা করা যায় না। দুই বছর পার হয়ে গেছে। কই আরসার অবস্থান? কী তাদের আন্তর্জাতিক সংযোগ?
প্রশ্ন হচ্ছে, গোটা কমিউনিটি রেডিকালাইজড হয়ে যেতে পারে কি-না? আমি সেটা সঠিক মনে করি না। এমন প্রশ্ন তুলে একটি শরণার্থী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয় মাত্র। মানবিক সংকটে পড়ে একটি অসহায় গোষ্ঠী এসে আপনার কাছে আশ্রয় চাইছে, আর আপনি বলছেন, তারা সারা পৃথিবীতে বিপদ তৈরি করছে! মূলত তারাই তো প্রথমে বিপদ মোকাবেলা করছে।
এরপরও প্রশ্ন থেকে যায়? আসলেই এমন একটি জনগোষ্ঠী থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী জন্ম নিতে পারে কি-না, যা বিপদের কারণ। আমি বলছি, সম্ভব। কারণ তাদের দেশ নেই, আশা নেই। ভবিষ্যৎ বলতে কিছু নেই।
আমি রোহিঙ্গা শিবিরে গিয়ে দেখেছি, সেখানে ১৪ বছর বয়সী এবং তাদের ওপরে, যাদের শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। তারা কী করবে? তাদের মধ্যে কেউ কেউ হতাশা থেকে বিপদের কারণ হতেই পারে। তাই বলে আপনি গোটা কমিউনিটিকে দোষ দেবেন, তা মানবিক নয়। তারা যাতে উগ্রবাদে না জড়ায়, সে জন্য আশু পদক্ষেপ নেয়ার কথা। তা না করে বসে আছেন, কবে তারা চরমপন্থা অবলম্বন করে এবং সেই অনুপাতে ব্যবস্থা নেবেন!
আপনার হাতে সুযোগ এসেছিল আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির। মিস করেছেন। আবার চেষ্টা করেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিকবার বলছেন, এখন আমরা আন্তর্জাতিক সাহায্য চাই। ভালো কথা। তাহলে সেভাবে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিন।
জাগো নিউজ : রোহিঙ্গা ইস্যুর বড় দুটি পক্ষ ভারত ও চীন। ওই দুটি পক্ষের অবস্থান এখনও বদলায়নি। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের আসলে করণীয় কী?
আলী রীয়াজ : প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা অসম কি-না? চীনকে কেন বোঝানো যাচ্ছে না যে, অর্থনৈতিক বিবেচনাতেও বাংলাদেশ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে এখন চীনের বিনিয়োগই বেশি। মিয়ানমারেও তাই। কিন্তু বাংলাদেশে চীন তাদের স্বার্থকে তো অস্বীকার করতে পারবে না। তাহলে আমরা কেন সেই স্বার্থকে ব্যবহার করতে পারছি না?
আরও পড়ুন > ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ চায় না অধিকাংশ মার্কিনি
চীনকে অবশ্যই বোঝানো দরকার যে, এ অঞ্চলে যদি অস্থিরতা তৈরি হয় এবং তার উত্তাপ যদি বাংলাদেশকে বহন করতে হয়, তাহলে তার যে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক চাপ বাড়বে, তা চীনের বাণিজ্যিক স্বার্থের জন্যও অনুকূল নয়। অন্য স্বার্থ বাদ দিলাম। চীন যদি শুধু বাণিজ্যই বোঝে, আসুন তাহলে আমরা তাদের বাণিজ্যই বুঝাই।
জাগো নিউজ : এ প্রশ্নে ভারত প্রসঙ্গে কী বলবেন?
আলী রীয়াজ : ভারতের রাজনৈতিক স্বার্থ বোঝা উচিত। দক্ষিণ এশিয়ায় রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে বাংলাদেশ হচ্ছে ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দক্ষিণ এশিয়ায় তার আর কোনো বন্ধু আছে কি-না, তা নিয়েও আমার মনে সংশয় আছে।
সুতরাং বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভারত যদি বিশেষ আবেদন তৈরি করতে চায়, তাহলে রোহিঙ্গা ইস্যু হচ্ছে বড় সুযোগ। তবে আমি চীন প্রসঙ্গেই অধিক গুরুত্ব দেব। দুই বছর আগে বাংলাদেশ যখন দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় গেলো, তখন চীনকে গ্যারান্টার বানাতে পারতো। চীনকে নিয়েই মিয়ানমার ও অন্যদের ওপরে চাপ সৃষ্টির সুযোগ ছিল। বাংলাদেশ তা করতে পারেনি।
সম্প্রতি চীনের প্রতিনিধি ঢাকায় এসে বলে গেছেন, রাখাইনে উন্নয়নই একমাত্র সমাধান। অথচ রোহিঙ্গা ইস্যু যে মানবিক সংকট, তা চীনকে দুই বছরেও বোঝানো গেলো না।
এএসএস/এমএআর/জেআইএম