এক লাখ লোকের কর্মসংস্থান করবে কাজী আইটি
মাইক কাজী। প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কাজী আইটি সেন্টার লিমিটেড। ১৯৮৭ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াবস্থায় পরিবারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। কয়েক বছর সেখানে অবস্থানের পর পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশে ফিরে আসেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে থেকে যান মাইক কাজী।
যুক্তরাষ্ট্রে এমবিএম (মাস্টার্স অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট) সম্পন্নের পাশাপাশি জড়িয়ে পড়েন ব্যবসায়। নিজ প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট তৈরি করতে গিয়ে আইটি ব্যবসার প্রতি ঝুঁকে পড়েন তিনি। সেই থেকে শুরু। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে তার প্রতিষ্ঠানে ৭০০ মার্কিন নাগরিক কাজ করছেন। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয় বাংলাদেশে মেধাবী তরুণদের জন্য ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন কাজী আইটি সেন্টার লিমিটেড।
এখন পর্যন্ত কয়েক হাজার তরুণ-তরুণীকে চাকরি দিয়ে স্বাবলম্বী করেছেন মাইক কাজী। রয়েছে নানা চিন্তা-ভাবনাও। সম্প্রতি জাগো নিউজ’র কাছে বাংলাদেশের তরুণদের নিয়ে স্বপ্ন ও নানা পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মামুন আব্দুল্লাহ।
জাগো নিউজ : আইটি ব্যবসায় বাংলাদেশের সম্ভাবনা সম্পর্কে বলুন...
মাইক কাজী : বাংলাদেশ খুবই সম্ভাবনাময় অর্থনীতির একটি দেশ। এ দেশের মোট জনসংখ্যার বড় একটি অংশ যুবক। যারা অত্যন্ত মেধাবী ও বুদ্ধিমান। তাদের পক্ষে দেশকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব। শুধু প্রয়োজন একটি প্লাটফর্ম তৈরি করা। সেটি করতে পারে তথ্যপ্রযুক্তি খাত, যুবকদের স্বপ্ন পূরণের সিঁড়ি। বুদ্ধিদীপ্ত তরুণদের পাশে দাঁড়াতেই বাংলাদেশে ব্যবসা আরো প্রসারের চিন্তা।
জাগো নিউজ : দেশের আইটি খাত নিয়ে আপনার কী পরিকল্পনা?
মাইক কাজী : আমরা কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই কর্মী নিয়োগ দিচ্ছি। তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে তৈরির উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। যত ভালো কর্মী পাবো ততই আমরা ব্যবসার প্রসার ঘটাবো। প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন কোম্পানি দাঁড় করাবো।
আগামী ২০ বছরে এক লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
জাগো নিউজ : বাংলাদেশে আপনাদের কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু বলুন।
মাইক কাজী : অনেক ভালো প্রত্যয় নিয়ে ২০১০ সালে বাংলাদেশে আমাদের যাত্রা। কাজী আইটির শুরু যুক্তরাষ্ট্রে হলেও বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের চিন্তাটা বেশ বড়। এখানে আমাদের তিনটি কার্যালয় (অফিস) রয়েছে। নিকুঞ্জ ১২ নম্বর রোডের প্রধান কার্যালয়ের পাশাপাশি রাজধানীর ধানমন্ডিতে একটি এবং ঢাকার বাইরে রাজশাহীতে আরো একটি অফিস রয়েছে। আমরাই প্রথম ঢাকার বাইরে কোনো বিভাগীয় শহরে বড় পরিসরে কাজ শুরু করেছি।
আমরা নতুনত্বে বিশ্বাসী, তাই অভিনব উপায়ে নিয়োগ দিতেও কার্পণ্য করি না। নিজেকে যোগ্য প্রমাণিত করতে পারলে কোনো রেফারেন্সের প্রয়োজন নেই। শুধু ইচ্ছাটা পোষণ করলেই তাকে আমরা নিয়োগ দিচ্ছি।
জাগো নিউজ : কোন ধরনের প্রার্থীকে আপনারা প্রধান্য দিচ্ছেন?
মাইক কাজী : বিদেশি ক্লায়েন্টদের সঙ্গে আমাদের কাজ। সে জন্য আমরা ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। যারা ভালো ইংরেজি বলতে, লিখতে ও পড়তে পারেন তাদের প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। তিনি কোন বিভাগে পড়াশোনা করেছেন, রেজাল্ট কেমন- এসব বিষয় মুখ্য নয়।
জাগো নিউজ : কাজী আইটির কর্মীদের বেতন কাঠামো সম্পর্কে কিছু বলুন...
মাইক কাজী : নতুন অবস্থায় আমাদের বেতন স্কেল হলো ৩৫ হাজার টাকা। সঙ্গে থাকছে সেলস কমিশন ও বাড়তি আয়ের নানা সুযোগ। সবমিলে অনেকে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা উপার্জন করছেন।
বাংলাদেশিরা অনেক মেধাবী। তবে তারা ইংরেজিতে দুর্বল। ইংরেজিতে পরীক্ষা নিলে তারা একটু খারাপ করে। ৩০ শতাংশ পাস করে। যদি বাংলায় প্রশ্ন করা হয় তাহলে ৯০ শতাংশ পাস করে। অর্থাৎ ইংরেজি প্রশ্ন বুঝতে তাদের সমস্যা হয়। তবে শুধু ইংরেজি জানা ছেলে-মেয়েকে শুধু নেই, সেটা নয়। যোগ্যতাসম্পন্নদের আমরা বেশি গুরুত্ব দেই। তবে যোগ্যতা আছে এমন অনেকেই এ সেক্টরে আসতে চান না।
জাগো নিউজ : নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছু বলুন...
মাইক কাজী : এখানে নিয়োগের বিষয়টা একটু ব্যতিক্রম। আগে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে আসলে তাকে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হতো। ম্যানেজমেন্ট দেখতো তার ধৈর্য কেমন। কিন্তু আমাদের এখানে সিস্টেমটা একটু ভিন্ন, আমরাই আবেদনকারীর কাছে যাই। কীভাবে, এমন প্রশ্ন মনে আসতে পারে।
কাজী আইটির পক্ষ থেকে আমি নিজে আবেদনকারীকে ফোন করি। প্রার্থীকে ফোনে কিছু প্রশ্ন করা হয়। আবার ফেসবুক লাইভেও ইন্টারভিউ নেয়া হয়। এরপর সর্টলিস্ট তৈরি করে অফিসে কল করা হয়। অফিসে আসা প্রার্থীকে ১০ মিনিটের বেশি অপেক্ষা করতে হয় না।
জাগো নিউজ : ফেসবুক লাইভে সাক্ষাৎকারের বিষয়টি যদি বলতেন...
মাইক কাজী : কাজী আইটির সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো ফেসবুক লাইভে সরাসরি ইন্টারভিউ নেয়া। কাজী আইটির প্রধান নির্বাহী হিসেবে আমি প্রতি শনিবার সকাল ১১টায় ফেসবুক লাইভে এসে আগ্রহীদের নানা প্রশ্নের জবাব দেই। সেখান থেকে প্রাথমিক সিলেকশন সম্পন্ন করি। এরপর আমাদের এইচআর টিম তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে চাকরির পরের ধাপগুলো সম্পন্ন করেন।
আপনাদের মাধ্যমে (জাগো নিউজ) চাকরিপ্রার্থীদের জানাতে চাই, তারা চাইলে সরাসরি আমাদের নিকুঞ্জ অফিসে এসে সিভি জমা দিতে পারেন। অথবা কাজী আইটির ফেসবুক ফ্যানপেজ গিয়ে যোগাযোগ করতে পারেন।
যারা সরাসরি ইন্টারভিউ দিতে চান তারা প্রতি শনিবার সকাল ১১টায় কাজী আইটির ফেসবুক পেজে লাইভে আমার সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন।
জাগো নিউজ : এ সেক্টরে কীভাবে আপনারা দক্ষ জনশক্তি তৈরি করছেন?
মাইক কাজী : আমরা বনানীতে অফিস নিচ্ছি আইটি ট্রেনিংসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণের জন্য। আমাদের যে টার্গেট তাতে প্রচুর দক্ষ জনবল প্রয়োজন। শিগগিরই আমাদের ইনস্টিটিউটের যাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে।
জাগো নিউজ : ট্রেনিংয়ের ধরন ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে কিছু বলুন...
মাইক কাজী : কাজী আইটিতে যারা প্রবেশ করেন তাদের পড়াশোনা করতে হয়। ১২ মাস তাদের বিভিন্ন বই সরবরাহ করা হয়। পাশাপাশি হাতে-কলমে শিক্ষা দেয়া হয়। পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট তত্ত্বাবধায়কদের কাছে সেগুলো উপস্থাপনা করা হয়। অর্থাৎ আপনি কী শিখছেন, কতটুকু নিতে পারলেন, সেগুলো যথাযথভাবে মনিটরিং করা হয়।
কাজী আইটি হলো শেখার জন্য। এখানে সবাইকে ফ্রি ট্রেনিং করানো হয়। আমাদের রিকোয়ারমেন্ট ফুলফিল করতে পারলে গ্রাজুয়েশনের প্রয়োজন নেই, এমনি-ই তাকে নিয়োগ দেই।
জাগো নিউজ : আপনাদের কাজের ধরন সম্পর্কে যদি বলতেন...
মাইক কাজী : আমরা ডে ও নাইট, দুই শিফটে লোক নিয়োগ দেই। আমাদের এখানে কাজ করতে হলে কাউকে জাভা প্রোগ্রাম বা অন্য কোনো প্রোগ্রাম জানতে হবে সেটা কিন্তু নয়। আমরা ইউএসের বিভিন্ন ব্যাংকের কাজ বাংলাদেশে বসে করে দেই।
ব্যাংকে বিভিন্ন আইটি সাপোর্টের প্রয়োজন হয়, মর্টগেজের কাজ, বাড়িঘরের লোন সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজ আমরা বাংলাদেশে বসে মেইনটেন্যান্স করি। অনলাইনে কাজগুলো করা হয়।
আমাদের প্রতিষ্ঠান ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। সেখানকার ব্যাংকের কাছে মর্টগেজ রাখা বাড়িগুলো মেইনটেন্যান্সের জন্য আমাদের লোক নিয়োগ দেয়া আছে। বাংলাদেশে বসে তাদের কাজগুলো মনিটরিং করা হয়। কখনো স্কাইপে, কখনো ফোনে অথবা অনলাইন বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হয়।
আমরা ব্যাংক, বীমা, লিগ্যাল সার্ভিসসহ বিভিন্ন সেক্টর নিয়ে কাজ করি। কনসালটিং, টেকনোলজি, আউটসোর্সিংসহ পরবর্তী প্রজন্মের বিভিন্ন সেবা আমাদের প্রতিষ্ঠান দিয়ে থাকে।
জাগো নিউজ : কাজী আইটির কাজের চাহিদা কেমন?
মাইক কাজী : যত কাজ আসে তার ১৫ শতাংশও আমরা শেষ করতে পারি না। আমাদের ৬০-৭০ শতাংশ কাজ বাকি আছে মার্কেট ম্যাচিউরিটির জন্য।
জাগো নিউজ : আইটি খাতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?
মাইক কাজী : বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি রফতানি আয় আসে পোশাক খাত থেকে। গত অর্থবছরে যা ছিল প্রায় ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পোশাক খাত থেকে বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ বেশি আয় করে চীন। তবে চীন এ খাত থেকে ধীরে ধীরে সরে আসছে। তারা পোশাকের চেয়ে বহুগুণ বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে মেশিনারিজ উৎপাদন ও আইটি খাতকে।
শুধু চীন নয়, সারাবিশ্ব বর্তমানে আইটি খাতকে ধরা হচ্ছে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় হিসেবে। সে ক্ষেত্রে, বাংলাদেশ সরকারও পিছিয়ে নেই। ২০২১ সালকে সামনে রেখে পাঁচ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছে, এটি অত্যন্ত ইতিবাচক। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আরো অনেক বেশি রফতানি আয় সম্ভব যদি সঠিক পথে চলা যায়।
জাগো নিউজ : এ খাতে সরকারের সহযোগিতা কি পর্যাপ্ত?
মাইক কাজী : বিশ্বখ্যাত গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বোস্টন কনসালটিং গ্রুপ (বিসিজি) এরই মধ্যে আমাদের সঙ্গে কাজ শুরু করেছে। এক্ষেত্রে সরকার আমাদের সহযোগিতা করছে। আমি মনে করি, এটা সরকারের খুবই ভালো উদ্যোগ। দেশের আইটি সেক্টর তাদের কাছ থেকে বহু কিছু পেতে পারে। তবে তাদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ পেতে আমাদেরও চেষ্টা থাকতে হবে।
জাগো নিউজ : তরুণদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কী হবে?
মাইক কাজী : তরুণরা আমাদের দেশের সম্পদ। আমরা তাদের খুঁজছি। যারা গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে, তাদের বিষয়টি আমরা সবসময়ই প্রাধান্য দেই। আমাদের এইচআর টিম সবসময় বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করে। আমরা শত শত চাকরিপ্রার্থীকে নিয়োগ দিতে পারতাম যদি তাদের ইংরেজির ওপর পর্যাপ্ত দক্ষতা থাকতো।
এমএ/এমএআর/এমএস