ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

রাজধানী সরিয়ে নেয়াই হবে বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত

সায়েম সাবু | প্রকাশিত: ০৮:৫৫ পিএম, ১৫ নভেম্বর ২০১৭

ড. সামছুল হক। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবহন বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রিধারী ড. সামছুল ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিডেটের পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। পরিবহন, যানজট, উন্নয়ন ও পরিকল্পনা নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। আলাপকালে তিনি ঢাকা থেকে রাজধানী স্থানান্তর সময়ের দাবি বলে মন্তব্য করেন। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের প্রথমটি আজ প্রকাশিত হলো।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজ’র জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ : রাজধানীর যানজট অসহনীয় পর্যায়ে। পরিবহন বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিষয়টি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?

সামছুল হক : ঢাকা এখন মৃতপ্রায় নগরী। পরিবহনে গন্তব্যে পৌঁছার কোনো নিশ্চয়তা নেই। নগরের সমস্যা অনেক, প্রতিটি সমস্যা একটি অপরটির সঙ্গে সম্পর্কিত। গাড়ি চলার যেমন চাহিদা থাকে তেমনি থামানোর চাহিদাও থাকে। আমি গণপরিবহনের বিষয়টি অধিক গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করবো।

ঢাকা যেহেতু অপরিকল্পিত নগরী সেহেতু রাস্তাঘাটগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে, প্রধান সড়কের বাইরে শুধু রিকশা চলবে। আপনি কলাবাগানের ভেতরের রাস্তাগুলোর কথা চিন্তা করেন। অথচ পরিকল্পিতভাবে হলে সেই রাস্তায় অন্তত মিনিবাস চলাচল করতে পারত। জাপানে এর চেয়ে সরু রাস্তায় বাস চলাচল করে। সেখানে ১০ ফুটের চেয়ে কম প্রশস্ত রাস্তায় গাড়ি চলাচল করছে।

জাগো নিউজ : সেটা কীভাবে সম্ভব?

সামছুল হক : সেখানকার রাস্তা সোজা। সোজা রাস্তায় একমুখী গাড়ি চলাটা খুবই সহজ। শহরের মধ্য দিয়ে দুইশ’থেকে তিনশ’ ফুট দূরত্বে দুটি রাস্তায় গাড়ি দুই দিকে চলাচল করছে। মানুষ একেবারে দোরগোড়ায় গাড়ি পেয়ে যাচ্ছে। যারা এসবের পরিকল্পনা করছে তাদের পেশাই পরিকল্পনা প্রণয়ন। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ালে যানজট হতে পারে, এ কারণে রাস্তার পাশে যাত্রী ওঠা-নামার জায়গা নির্ধারণ করা আছে। থামানো গাড়িতে যাত্রী ওঠা-নামা করছে, কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি ছাড়াই।

জাগো নিউজ : এসব রাস্তা ঢাকাতেও আছে?

সামছুল হক : না, পরিকল্পনা করে কোনো রাস্তা তৈরি করা হয়নি। স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে যাচ্ছেতাই রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। ঢাকায় অনেক রাস্তা আছে ২০ ফুট চওড়া অথচ সেখানে বাস চলাচল করতে পারছে না। কারণ রাস্তার কিছু দূর যেতে না যেতেই দেখা যাবে ৯০ ডিগ্রি কোণের একটি মোড়। ওই রাস্তায় ফায়ার সার্ভিস বা অ্যাম্বুলেন্সও প্রবেশ করতে পারে না। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে কাউকে উদ্ধার করা যাবে না। একটি ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এবং একটি অ্যাম্বুলেন্স পাশাপাশি চলতে পারলে তাকে আমরা সড়ক বলে জানি। কিন্তু ঢাকার ৯২ শতাংশ সড়ক রয়েছে যেখানে বড় গাড়ি চলতে পারে না। সুতরাং আমাদের অবকাঠামোই বলে দিচ্ছে রিকশা থাকবে।

ঢাকা শহরটি অভিভাবকহীন অর্থাৎ পরিকল্পনার বাইরে থেকে এসে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে (ডিকটেটেড) দেয়া হয়েছে। পরিকল্পিত এবং চাপানো আলাদা বিষয়। চাপিয়ে দেয়া হতে পারে কিন্তু সেখানে যদি পরিকল্পনা থাকে তাহলে এক সময় ভালো কিছু হবেই।

জাগো নিউজ : পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন তো সরকারগুলোর পরম্পরায়?

সামছুল হক : পরিকল্পহীনতা শুধু স্বাধীনতার পরবর্তী সরকারগুলোর ক্ষেত্রেই নয়। ব্রিটিশ আমল এবং পাকিস্তান আমল থেকেই ঢাকা অপরিকল্পিত নগরী। উন্নয়নে কলকাতাকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ঢাকাকে সেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। একইভাবে পাকিস্তান আমলেও করাচিকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ঢাকাকে সেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এ কারণে স্বাধীনতার পর উন্নয়ন প্রশ্নে ওপর থেকে নিচের দিকে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া নীতি অবলম্বন করতে হয়। যে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা ছিল নিচ থেকে ওপরে। যখন যেখানে, যা দরকার সেটা করতে গিয়ে ঠেক দেয়ার মতো কাজ হয়েছে মাত্র। উন্নয়নে কোনো পরিকল্পনা ছিল না।

এ কারণে ঢাকায় মাত্র তিনটি সড়ক রয়েছে, যেখানে বাস চলাচল করতে পারে। সংখ্যায় তিনটি হলেও সড়কগুলোর গুণগত মান কিন্তু অনেক দুর্বল। এরশাদ সাহেব প্রগতি সরণী সড়ক করলেন। উত্তরা থেকে এসে সড়কটি একদিকে জনপদ সড়ক এবং আরেকটি মৌচাকের সড়কের সঙ্গে মিলে গেল। উত্তরা-পূর্বাচলের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে মেট্রোরেল কুড়িল হয়ে মৌচাকে আসতে ৯০ ডিগ্রি একটি মোড় মিলবে। কাকরাইলের দিকে যেতে আরেকটি একইরকম মোড় পাচ্ছি। বিজয়নগরের কাছে আরেকটি মোড়। রেলপথ তো এভাবে মোড় নিতে পারে না।

জাগো নিউজ : মেট্রোরেল ছাড়া তো উপায় নেই?

সামছুল হক : মুমূর্ষু রোগী মরে যাওয়ার আগে যেমন অতি শক্তিশালী ইনজেকশন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়, তেমনি মৃতপ্রায় ঢাকাকে বাঁচানোর চেষ্টায় মেট্রোরেলের মতো প্রজেক্ট করা হচ্ছে। ঢাকা নগর এখন নিবিড় পর্যবেক্ষণে (আইসিইউ) রয়েছে বলে আমি মনে করি। দুর্ভাগ্য যে নিবিড় পর্যবেক্ষণ থেকে ঢাকা শহরকে ফেরাতে আমরাও সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।

জাগো নিউজ : আইসিইউতে রাখা অধিকাংশ রোগীকে আর ফেরানো যায় না। তাহলে মেট্রোরেলের মতো প্রজেক্টে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে লাভ কী?

সামছুল হক : কোনো মা কি চায় তার সন্তান চিকিৎসার অভাবে মারা যাক? ঢাকার অবস্থা এখন তাই। মেট্রোরেলের মতো প্রজেক্ট দিয়ে শেষ মুহূর্তের চেষ্টা করা হচ্ছে। যদি কোনো সত্যিকার নগরপিতা থাকতেন, তাহলে ৫০ বছর আগেই নগরের জন্য গণমুখী সিদ্ধান্ত নিতেন। দিল্লি থেকে নয়াদিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তর করা হয়েছে। করাচি থেকে রাজধানী ইসলামাবাদে চলে গেছে। মাহাথির বললেন, কুয়ালালামপুর ভালো কিন্তু রাজধানীর জন্য চলবে না। চলে গেলেন পুত্রাজায়ায়। মিয়ানমারের রাজধানীও সরানো হয়েছে। শ্রীলঙ্কাও তাই করছে। এর কারণ হচ্ছে ওই শহরগুলোতেও ঢাকার মতো সমস্যা তৈরি হচ্ছিল। চিকিৎসা দিয়ে বাঁচানোর আর উপায় ছিল না। এ কারণে তারা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

শুধু সড়ক দিয়ে তো আর নগর চলে না। বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার দরকার হয়। এখানে রেল আছে সড়কের সঙ্গে জট লাগিয়ে। নৌ-পথ আছে সড়কের সঙ্গে জট লাগিয়ে। এই জট লাগানো যোগাযোগ ব্যবস্থা অধিক মানুষের পরিবহন চাহিদা কোনোদিনই পূরণ করা যাবে না।

জাগো নিউজ : এখন কী করার আছে?

সামছুল হক : প্রশ্ন হচ্ছে, এমন অবস্থায় ঢাকায় বিনিয়োগ করবো না কি এখানে স্বল্প মেয়াদে বিনিয়োগ করে রাজধানীকে ধীরে ধীরে স্থানান্তরের চেষ্টা করবো। রাজধানী এখন সরিয়ে নেয়াই হবে যুগোপযোগী ও বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত। ভারত এমন সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল বলেই নয়াদিল্লি পরিকল্পিতভাবে সাজাতে পেরেছে। ইসলামাবাদ অনেক সুন্দর ও পরিকল্পিত নগরী। কারণ তারা কোনো না কোনোভাবে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পেরেছিল। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, আমরা আজও সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারিনি। কুয়ালালামপুর চমৎকার একটি শহর। এরপরও তারা মনে করছে বাইরের বিনিয়োগ বাড়াতে হলে রাজধানী স্থানান্তর করতে হবে। মিয়ানমার চায়নাকে দিয়ে তাদের রাজধানীর পরিকল্পনা করছে। এ দৃষ্টান্তগুলো আমাদের সামনে আছে। আর আমাদের ঢাকার ভবিষ্যৎ কী হবে তা এখনই বলে দেয়া যায়।

জাগো নিউজ : কী হবে?

সামছুল হক : ইতোমধ্যে ঢাকা শহর কলাপ্স (ধস) করেছে। একটি শহর সুন্দর কি না, তা বোঝার জন্য দুটি পিক (ছবি) দেখার দরকার পড়ে। একটি সকাল বেলা, আরেকটি বিকেলের। এটিকে বলে একটি নগরীর রিদম। শহরের সবাই জানে সকাল ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত অফিস যাওয়ার সময় গাড়ির চাহিদা থাকবে, অধিক যাত্রী থাকবে, যানজট থাকবে। একই চিত্র থাকবে বিকেল ৪টা থেকে ৫টা পর্যন্ত। ট্রাফিক চাপ ধরে কথা বললে, দেখা যাবে সকাল বেলা দুই ঘণ্টা যানজট এবং বিকেলে দুই ঘণ্টা যানজট নগরবাসীর অভ্যস্ত হওয়ার কথা। কিন্তু সকালে যে চাপ বাড়ছে তা বিকেল পর্যন্ত গড়িয়ে যাচ্ছে। নগরকে যদি একটি শরীরের সঙ্গে তুলনা করি এবং সেই শরীরে যদি রিদম না থাকে তাহলে তো দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকার কথা নয়।

সারাবিশ্বের উন্নত শহরগুলোতে এ দুই সময়ের পিক থাকে। এটি মানুষ মেনে নেয়। বাকি সময় কোনো যানজট নেই। অথচ ঢাকায় রাত ১০টা পর্যন্ত তীব্র যানজট চোখে পড়ে। ঢাকা মরে যাচ্ছে, এর লক্ষণ এটি। শরীরে রক্তের চাপ বেড়ে যদি আর না কমে তাহলে বেঁচে থাকা যায় না।

শহরে প্রতিনিয়ত মানুষ বাড়ছে, পরিবহনের সংখ্যাও বাড়ছে। যার ওপর ভিত্তি করে শহরের বেঁচে থাকা, সেই রাস্তা আর বাড়ছে না।

আমি যদি কয়েক বছর পেছনে গিয়ে ফার্মগেট-শাহবাগের রাস্তার দিকে তাকাই, দেখত পাবো অনেক সুন্দর একটি সড়ক ছিল। কারণ এ সড়কের আশেপাশের ভূমির ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল। এখন দু’পাশের রাস্তায় বহুতল ভবনের প্রতিযোগিতা চলছে। শপিং মল হচ্ছে। বাংলামোটরে চারকোণায় চারটি বিশাল ভবন উঠেছে। মানে, রাস্তা প্রশস্ত না করে আরো কীভাবে সংকীর্ণ করা যায়, সেই চেষ্টা চলছে। এসব ভবনে হাজার হাজার মানুষ চাকরি করবে বা বসবাস করবে। তারা মূল সড়ক ব্যবহার করবে, পরিবহনও ব্যবহার করবে। ধমনীতে কোলেস্টরলের পরিমাণ বাড়ালে রক্তচাপ তো এমনিতেই বেড়ে যাবে। অথচ ধমনী সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে।

আমাদের চাহিদা বাড়ছে, কিন্তু যোগানটা কমছে। এ শহর কখনোই বাঁচার কথা নয়। জনস্রোত ঠেকাতে পারছে না, গাড়ি ঠেকাতে পারছে না, রাস্তা চওড়া করতে পারছে না। অন্যদিকে ভূমি উন্নয়নের নামে এমন ভবন তৈরি করা হচ্ছে; যাতে রাস্তাটি আরো সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে।

এএসএস/এমএআর/বিএ

আরও পড়ুন