ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সোশ্যাল মিডিয়া

দুজন ভয়ংকর মেডিকেল শিক্ষার্থীর গল্প

জাগো নিউজ ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৬:০৬ পিএম, ২৬ জুন ২০২৪

আবদুল্লাহ আল ইমরান

কানাডায় কাজের শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও গত বছর পূর্বের কর্মস্থল চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের জন্য টেলিগ্রাম চক্র মার্ক সাকারবার্গ ও তার পমপম গ্রুপ নিয়ে একটি অনুসন্ধান করেছিলাম। আলোচিত রিপোর্টটি হয়তো আপনারা অনেকেই দেখেছেন। কাজটি করতে গিয়ে আলোচ্য এই দুই শিক্ষার্থীর খোঁজ পাই আমি। এদের একজনের নাম এরশাদ শিকদার, অন্যজন আখতার। বলা বাহুল্য দুটোই ছদ্মনাম।

এদের কয়েকটি বিকাশ নাম্বার এবং ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে পাওয়া ভাসা ভাসা কিছু তথ্যের বাইরে আমার হাতে আর তেমন কিছুই ছিল না। নাম্বারগুলোর সবই আবার ভূয়া রেজিস্ট্রেশন। আমার পনেরো বছরের পেশাগত জীবনে এমন ধূর্ত এবং কলা-কৌশল জানা চতুর অপরাধী খুব কমই দেখেছি। কারো কাছে এদের একটা ছবি পর্যন্ত নেই, সঠিক পরিচয় নেই, অথচ শত শত তরুণীর রাতের ঘুম হারাম করেছে, কৌশলে তাদের বিপথেও নিয়ে গেছে।

শেষ পর্যন্ত এদের কিভাবে খুঁজে পেলাম, সেই গল্পে যাওয়ার আগে এরা কী করেছে সেই গল্প খানিকটা বলে নিই। চাকরি দেওয়া, মডেল বানানো এবং মেধা-অন্বেষণের নামে প্রথমে বিজ্ঞাপন দেয় এরা। এসব বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে অল্প বয়সী তরুণীরা যোগাযোগ করে। তাদের যু্ক্ত করা হয় সিক্রেট টেলিগ্রাম গ্রুপে। ধীরে ধীরে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। তারপর বিদেশি বায়ারদের কাছে পাঠানোর কথা বলে। কখনোবা প্রেমের দোহাই দিয়ে অন্তর্বাস পরিহিত বা নগ্ন ছবি হাতিয়ে নেয় চক্রটি।

এরপর শুরু হয় আসল খেলা। সেসব ছবি ভাইরাল করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মেয়েদের বাধ্য করা হতো নগ্ন হয়ে ভিডিও কলে ‘ক্যাম সার্ভিস’ এ যুক্ত হতে। এসব সার্ভিস নিতো দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা চক্রটির হাজার হাজার সাবস্ক্রাইবার, যারা একটি নির্দিষ্ট অর্থ দিয়ে ওই গ্রুপগুলোতে যুক্ত থাকতো।

চক্রটি ওই ভিডিও কলের সবকিছু গোপনে ধারণ করে রাখে। তারপর মেয়েদের বাধ্য করে তাদের গ্রাহকদের সঙ্গে ‘রিয়েল সার্ভিস’ বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক যৌন-সম্পর্ক স্থাপনে। সেসবও একই কায়দায় ধারণ করে রাখা হয়। এভাবে দিনে দিনে চক্রটির হাতে আধুনিক যৌনদাসীতে পরিণত হয়েছে শত শত ভুক্তভোগী তরুণী।

দেশ-বিদেশে চক্রটির রয়েছে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। নানা নামে তাদের শতাধিক চ্যানেলে গ্রাহক সংখ্যাও কয়েক লাখ। প্রাথমিক অনুসন্ধানে জেনেছি, নারীদের ভিডিও কল ও দেহ ব্যবসায় বাধ্য করে এবং গোপনে ধারণকৃত সেসব ভিডিও বিক্রি করে চক্রটি প্রায় ৩০ কোটি টাকা আয় করেছে। এসব অর্থে তারা যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা এবং ঢাকায় বিপুল জমি ক্রয় করেছে। নির্মাণ করেছে আলিশান বাড়ি। তাদের আত্মীয়-স্বজনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টেও বিপুল অর্থের খোঁজ মিলেছে।

এ ছাড়া চক্রটি যে কোনো গ্রাহকের ডিটেইলস কল রেকর্ড (সিডিআর), এসএমএস কন্টেন্ট, বসবাসের ঠিকানা, ন্যাশনাল আইডি কার্ডসহ স্পর্শকাতর প্রায় সকল ব্যক্তিগত তথ্য জোগাড় করে ফেলতে পারতো। তাদের কথামতো কাজ না করলে এসব তথ্য দিয়ে ভুক্তভোগীদের হুমকি দেওয়া হতো সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল করে দেওয়ার।

আগেই বলেছি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সকল কলা-কৌশলও এই চক্রের জানা। ফলে শত শত মোবাইল সিম ব্যবহার করলেও তাদের কোনোটিই প্রকৃত ন্যাশনাল আইডি দিয়ে রেজিস্ট্রার করা নয়। এ ক্ষেত্রে তারা নিম্ন আয়ের মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিতো। সামান্য অর্থ দিয়ে তোলা হতো সিম কার্ড।

তবে শেষ রক্ষা হয়নি। দুই ভাইয়ের পরিচয় আমরা জানতে পেরেছি। গত এক বছরে যখনই কিছুটা সময় পেয়েছি, একটু একটু করে চক্রটিকে খুঁজে বের করতে কাজ করেছি। মাঠে এবং এদের গ্রুপগুলোতে প্রচুর সোর্সও নিয়োগ করেছি। এরশাদ শিকদার যে মেহেদী হাসান এবং আখতার যে শেখ জাহিদ বিন সুজন, এই তথ্য জোগাড়ে আমরা সম্ভাব্য সকল চেষ্টা করেছি এবং সফল হয়েছি। আমার তথ্যে চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের সার্চলাইট টিমের সাবেক সহকর্মী তানভীর মাঠে নেমে আরও কিছু তথ্য যুক্ত করেছে। শেষ পর্যন্ত আমাদের তথ্যে যশোর থেকে এরশাদ ওরফে মেহেদী এবং সাতক্ষীরা থেকে আখতার ওরফে সুজনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডির সাইবার পুলিশ। গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের আরও ৬ সহযোগী।

মেহেদী টঙ্গীর ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের এবং সুজন ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। অল্প বয়সে ভয়ানক চতুর এই দুই মেডিকেল শিক্ষার্থীর ফোন এবং ল্যাপটপ থেকে গোপনে ধারণ করা কয়েক লাখ ছবি আর প্রায় ২০ হাজার আপত্তিকর ভিডিও উদ্ধার করা হয়েছে।

কিছু কাজ থাকে যাতে পরিশ্রম হয় ঠিকই কিন্তু সন্তুষ্টিও কাজ করে। এটি তেমনই একটি কাজ। এদের যখন খুঁজে পেলাম এবং শেষ পর্যন্ত এরা যখন আইনের আওতায় এলো, তখন বহু দূরে থেকেও আনন্দ কাজ করেছে। কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ সিআইডির সাইবার পুলিশের চৌকস দলটিকে।

এই অনুসন্ধানের বিস্তারিত দেখা যাবে সার্চলাইটে আর আজ প্রেস কনফারেন্স করে চক্রটিকে গ্রেপ্তারের খবর জানাবে সিআইডি। কাজটির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আমার হাতে থাকা পেন্ডিং কয়েকটি অনুসন্ধানী কাজের আরও একটি শেষ হলো। বাকি কাজগুলোও হয়তো সামনের দিনে দেখা যাবে আমার সাবেক কর্মস্থল চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের পর্দায়। (সম্পাদিত)

লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক।

এসইউ/জিকেএস

আরও পড়ুন