মাদক-অনৈতিককাণ্ডে বিনোদন পাড়ায় র্যাব-পুলিশের হানা
ঢাকার সাভারের বোটক্লাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করে আলোচনায় আসেন চিত্রনায়িকা পরীমনি। সে ঘটনায় কয়েকজন গ্রেফতারও হয়েছিলেন, তারা আবার জামিনও পেয়ে গেছেন। এর মধ্যেই আবার একাধিক ক্লাবে পরীমনির ভাঙচুরের অভিযোগ ওঠে। ২০২১ সালের ৪ আগস্ট বিকেল ৪টায়। হঠাৎ নায়িকা পরীমনি তার ফেসবুক পেজে লাইভ শুরু করেন। লাইভে তাকে ভীতসন্ত্রস্ত দেখা যায়।
এরপর পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) পক্ষ থেকে জানানো হয় ‘সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগের’ ভিত্তিতে পরীমনির রাজধানীর বনানীর বাসায় অভিযানে চালাচ্ছেন র্যাবের গোয়েন্দা দলের সদস্যরা। টানা কয়েক ঘণ্টা অভিযানের পর বিপুল পরিমাণ মাদকসহ পরীমনিকে গ্রেফতার করা। অভিযানের পর র্যাব দাবি করে পরীমনির বাসায় ছিল মিনি বার।
পরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা এডিসি গোলাম সাকলায়েন শিথিলের সঙ্গে অভিনেত্রী পরীমনির ছবি-ভিডিও ভাইরাল হয়। তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ঘটনা তদন্তও হয়।
কেবল এই পরীমনিই নয়; মডেল, অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের মাদক ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে বিনোদন পাড়ায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান আলোচনায় ছিল বছরজুড়ে। একের পর এক মডেল ও অভিনেত্রীদের বাসায় অভিযানের ফলে আলোচনায় আসে অন্ধকার জগতের এসব মডেল ও অভিনেত্রী।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, গ্রেফতার হওয়া এসব মডেল ও অভিনেত্রী উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের পার্টির নামে বাসায় ডেকে আনতেন। বাসায় এলে মদ ও ইয়াবা খাইয়ে তারা তাদের সঙ্গে আপত্তিকর ছবি তুলতেন এবং ভিডিও করে রাখতেন। পরে সেসব ভিডিও এবং ছবি ভিকটিমদের পরিবারকে পাঠানোর হুমকি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতেন এবং মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতেন।
নায়িকা পরীমনির আগে ১ আগস্ট রাতে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ, ইয়াবা ও সিসাসহ মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌকে আটক করে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা (ডিবি) বিভাগ।
রাজধানীর তারকা হোটেল ও পার্টি হাউজে এসব মডেল, অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। এছাড়া স্পা সেন্টারসহ নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আড়ালে গুলশান-বনানীসহ বিভিন্ন স্থানে অনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা হতো।
পরীমনির বাসায় ছিল মিনি বার
পরীমনির বনানীর বাসায় অভিযানের পর র্যাব জানায়, অভিযানে নতুন মাদক এলএসডি, মদ ও আইস উদ্ধার করা হয়। তার ড্রয়িংরুমের কাভার্ড, শোকেস, ডাইনিংরুম, বেডরুমের সাইড টেবিল ও টয়লেট থেকে বিপুল পরিমাণ মদের বোতল উদ্ধার করা হয়। তার পরদিন ৫ আগস্ট র্যাব বাদী হয়ে রাজধানীর বনানী থানায় পরীমনি ও তার সহযোগী বিপুর বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলায় করে৷ এ মামলায় পরীমনিকে তিন দফায় মোট সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।
র্যাবের তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, পরীমনি ২০১৬ সাল থেকে মাদক সেবন করতেন। এমনকি ভয়ঙ্কর মাদক এলএসডি ও আইসও সেবন করতেন তিনি। তার বাসায় একটি মিনি বারও রয়েছে। তিনি বাসায় নিয়মিত মদের পার্টি করতেন। চলচ্চিত্র প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ পরীমনির বাসায় এসব মাদক সাপ্লাই (সরবরাহ) করতেন। কোনো বাসায় মিনি বার থাকবে তা আইনসিদ্ধ নয়।
পরীমনির সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে বদলি হন ডিবির গোলাম সাকলায়েন শিথিল
গত জুনে ঢাকার সাভারের বোটক্লাবে তিনি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অভিযোগ করার পর যে মামলা হয়েছিল, সেটির তদারককালে পরীমনির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যান ডিবির কর্মকর্তা গোলাম সাকলায়েন শিথিল। বিষয়টি ফাঁস হওয়ার পর পুলিশে তোলপাড় শুরু হয়। মামলা তদন্তের অংশ হিসেবে পরীমনিকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়। তখনই ডিবির গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) গোলাম সাকলায়েন শিথিলের সঙ্গে পরিচয় হয় পরীমনির। এরপর দুজনের মধ্যে শুরু হয় যোগাযোগ। নিয়মিত পরীমনির বাসায় যাতায়াত শুরু করেন গোলাম সাকলায়েন শিথিল। মাঝে-মধ্যেই গাড়ি নিয়ে বের হতেন দু’জন।
৭ আগস্ট গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) গোলাম সাকলায়েন শিথিলকে ডিবির সব দায়িত্ব থেকে নিবৃত করা হয়। পরে তাকে পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিওএম) পশ্চিমে পদায়ন করা হয়। এরপর গোলাম সাকলায়েন শিথিলকে এবং নায়িকা পরীমনির সম্পর্ক তদন্তে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে পুলিশ সদরদফতর।
এর রেশ কাটতে না কাটতেই তিনদিনের মধ্যে পরীমনি ও গোলাম সাকলায়েন শিথিলের একটি নতুন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ১০ আগস্ট সন্ধ্যার দিকে ইলিয়াস হোসাইন নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল থেকে আপলোড করা ওই ভিডিওতে দেখা যায়, জন্মদিনের পার্টিতে পরীমনি ও সাকলায়েন কেক কাটছেন।
অভিনেতা নজরুল ইসলাম রাজের বাসায় চলত পর্নোগ্রাফি, ছিল সরঞ্জাম
পরীমনির বনানীর বাসায় অভিযান শেষ করেই আলোচিত চলচ্চিত্র প্রযোজক ও অভিনেতা নজরুল ইসলাম রাজের বনানীর বাসায় অভিযান শুরু করে র্যাব। সে সময় অভিযানে থাকা র্যাবের একাধিক কর্মকর্তা জানান, রাজের বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ মাদকের পাশাপাশি বিকৃত যৌনাচার সরঞ্জাম জব্দ করেছে র্যাব। সূত্র জানায়, রাজের বাসায় একটি রুম পাওয়া যায়। যেখানে একাধিক নারী-পুরুষ একসঙ্গে বিকৃত যৌনাচারে ব্যবহার্য সরঞ্জামাদি সজ্জিত ছিল। এটি নজরুল ইসলাম রাজের ‘রাজ মাল্টিমিডিয়া প্রোডাকশন হাউস’র একটি কক্ষ বা বিশেষ বিছানা। এই বাসাতে পর্নো ভিডিও বানানো হতো বলেও জানা যায়।
পরীমনিকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে পাওয়া তথ্যে এই অভিযান চালায় র্যাব। অভিযান শেষে রাজকে আটক করে নিয়ে যান র্যাব সদস্যরা। রাজের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও পর্নোগ্রাফি আইনে পৃথক দুটি মামলা করে র্যাব। বর্তমানে রাজ কারাগারে রয়েছেন।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, আলোচিত চলচ্চিত্র প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ সিনেমা ও মডেলিংয়ে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে তরুণীদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়াতেন। প্রথমে ফাঁদ পেতে তার নিজের বাসায় ‘রাজ মাল্টিমিডিয়া’য় নিয়ে অনৈতিক কাজে বাধ্য করাতেন। এভাবে প্রায় দুই শতাধিক তরুণীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়েন তিনি। এসব তরুণীর বেশিরভাগের বয়স ছিল ১৮ থেকে ২০ এর মধ্যে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে এ নিয়ে স্বীকারোক্তিও দিয়েছেন রাজ। তার বনানীর বাড়িতে অভিযানেও কম্পিউটার ও মোবাইলে মিলেছে অনেক অনৈতিক গোপন ভিডিও-ছবি। এছাড়া জব্দ করা হয় তিনটি মেমোরি কার্ড।
ইয়াবা-বিদেশি মদসহ গ্রেফতার হন মডেল মৌ
১ আগস্ট রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাবর রোড থেকে বিপুল পরিমাণ মদ ও বাসায় মদের বার রাখার অভিযোগে মডেল মরিয়ম আক্তার মৌকে আটক করে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা (ডিবি) বিভাগ। এ সময় তার ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে ৭৫০টি ইয়াবা জব্দ করা হয়। জব্দ হয় ১২ বোতল বিদেশি মদও।
এ ঘটনায় মৌয়ের বিরুদ্ধে রাজধানীর দুই থানায় পৃথক দুইটি মামলা হয়। এ দুই মামলায় রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। পরে এ দুই মামলায় তিনি জামিনে মুক্তি পান। তবে তদন্ত শেষে এ দুই মামলায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।
মাদকদ্রব্য আইনের মামলায় গ্রেফতার হন মডেল পিয়াসা
১ আগস্ট রাজধানীর বারিধারার বাসা থেকে বিদেশি মদ, ইয়াবাসহ আলোচিত-সমালোচিত মডেল ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা (ডিবি) বিভাগ। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে তিনটি মামলা হয়। অস্ত্র আইনের একটি এবং মুনিয়াকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে আরেক মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। মামলাগুলোতে একাধিকবার তাকে রিমান্ডেও নেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি কারাগারে আটক রয়েছে।
গ্রেফতারের পর মোহাম্মদপুরে মৌ-এর বাসার নিচে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা (উত্তর) শাখার যুগ্ম-কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ বলেন, মৌ ও পিয়াসা তারা দুইজন একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে আমরা অনেক ব্ল্যাকমেইলিংয়ের অভিযোগ পেয়েছি। সেসব ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে তাদের বাসায় অভিযান চালানো হয়। দুইজনের বাসায় বিদেশি মদ, ইয়াবা, সিসা পাওয়া যায়। মৌয়ের বাড়িতে মদের বারও ছিল।
ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, আটক দুই মডেল হচ্ছেন রাতের রানি। তারা দিনের বেলায় ঘুমাতেন এবং রাতে এসব কর্মকাণ্ড করতেন। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের পার্টির নামে বাসায় ডেকে আনতেন তারা। বাসায় এলে তারা তাদের সঙ্গে আপত্তিকর ছবি তুলতেন এবং ভিডিও করে রাখতেন। পরবর্তীতে সেসব ভিডিও এবং ছবি ভিকটিমদের পরিবারকে পাঠানোর হুমকি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতেন এবং মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতেন।
পিয়াসা-মৌর প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন মিশু-জিসান
আলোচিত মডেল মাহবুব পিয়াসা ও মৌ আক্তারের প্রধান সমন্বয়ক শরফুল হাসান ওরফে মিশু হাসান ও তার সহযোগী মাসুদুল ইসলাম ওরফে জিসান। গত ৩ আগস্ট রাতে মিশু ও তার সহযোগীকে একটি পিস্তল, ছয় রাউন্ড গুলি, মাদক, ভারতীয় জাল রুপি, বিলাসবহুল ফেরারি গাড়িসহ গ্রেফতার করে র্যাব।
মাদকসহ গ্রেফতার মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মৌসহ অর্ধশতাধিক মডেলকে অনৈতিক ও প্রতারণার কাজে ব্যবহার করতেন শরফুল হাসান ওরফে মিশু হাসান। তাদের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। কিনেছেন নামিদামি ব্র্যান্ডের বিলাসবহুল সব গাড়ি।
গ্রেফতারের পর র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেফতারকৃতরা একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। এই চক্রের সদস্য ১০ থেকে ১২ জন। তারা রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকা বিশেষ করে গুলশান, বারিধারা, বনানীসহ বিভিন্ন এলাকায় পার্টি বা ডিজে পার্টির নামে মাদক সেবনসহ নানাবিধ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থা করে থাকেন। পার্টিতে তারা অংশগ্রহণকারীদের নিকট হতে বিপুল পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকেন। অংশগ্রহণকারীরা সাধারণত উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্য।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কাউকে হয়রানি নয়: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে মডেল, অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের গ্রেফতারের পর ৯ আগস্ট রাতে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আশ্বস্ত করে বলেন, সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া বিভিন্ন মডেলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা অনেকের নামের তালিকা পাওয়ার খবর ছড়ালেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কাউকে হয়রানি করা হবে না।
টিটি/এসএইচএস/এইচএ/এএসএম