‘হাঁকডাকেই’ বছর গেলো বিএনপির
ক্ষমতার বলয়ের বাইরে আরও একটি বছর শেষ করলো দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। রাজনৈতিক কর্মসূচি বলতে বছরজুড়ে মিডিয়া ব্রিফিং, মানববন্ধন, বিবৃতি আর কিছু সভা-সমাবেশেই ঘুরপাক খেয়েছে দলটি। এসব কর্মসূচির লক্ষ্যবিন্দুতে ছিল দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তার সুচিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানোর ইস্যু। তবে এর ভেতরেই মৃদুস্রোতে বয়ে চলেছে সরকার পতনের কথিত আন্দোলনও। আর নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সংলাপে শেষ পর্যন্ত বিএনপি যাবে কি যাবে না, এ নিয়ে ধোঁয়াশায় বছর শেষ করেছে দলটি।
দলীয় প্রধানের মুক্তি ও সুচিকিৎসার দাবি এবং সরকার পতনের আন্দোলনে বছরজুড়ে সরব থাকা বিএনপির কর্মসূচিতে শৈথিল্য নিয়ে বছরের শুরু থেকে দলের অভ্যন্তরে প্রশ্ন ছিল। দলের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত জ্যেষ্ঠ নেতাদের উপেক্ষা করার বিষয়গুলো বড় প্রশ্ন হয়ে সামনে আসে। এমনকি দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকেও বিভিন্ন সময়ে হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে।
এসব বিষয়ে দলের সাংগঠনিক পর্যায় থেকে নেওয়া হয়নি কোনো সুদৃঢ় ব্যবস্থা। এছাড়া বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপির বড়সড় আন্দোলন গড়ে তোলার সামর্থ্য নিয়েও জনমনে ও রাজনৈতিক মহলে ছিল কানাঘুষা। সব মিলিয়ে আগের ক’বছরের মতো ২০২১ সালও রাজনৈতিকভাবে অনেকটা মন্থর গতিতেই কেটেছে বিএনপির।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া/ফাইল ছবি
উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদাকে বিদেশ পাঠানো ও তার মুক্তির দাবি
দুর্নীতি মামলার দণ্ডিত হয়ে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে কারাবাস করছিলেন বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া। এর মধ্যে বিএনপি তাকে কারামুক্ত করার জন্য বারবার হুংকার ছেড়েও কোনো ফল পায়নি। ২০২০ সালে দেশে করোনা প্রাদুর্ভাব দেখা গিলে মানবিক বিবেচনায় সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদার সাজা স্থগিত করে তাকে মুক্তি দেয়। কিন্তু খালেদা জিয়ার স্থায়ী মুক্তি ও বিদেশে সুচিকিৎসার দাবি জানিয়ে আসছিল বিএনপি। সেজন্য রাজপথে নামার ঘোষণা দিলেও কার্যকর কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি তারা। গত বছরের মতো এ বছরও আন্দোলনে অনেকাংশেই ব্যর্থ দল বিএনপি।
এ ইস্যুতে দলটি আন্দোলনের চেয়ে সরকারের ‘অনুকম্পার’ প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে একাধিকবার তার সুচিকিৎসায় বিদেশে পাঠানোর আবেদন করা হলেও দল সীমাবদ্ধ ছিল সংবাদ সম্মেলন ও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে অনুনয়-বিনয়ের আহ্বানেই। তাতে ফলও আসেনি। যদিও বছরের শেষ দিকে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে শুরু হওয়া কর্মসূচিতে নেতাকর্মীরা আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন।
সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে প্রশ্নবিদ্ধ সংগঠন পুনর্গঠন
দলের ৮১টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে অন্তত ৩০টিতে নতুন কমিটি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটিও গঠন হয়েছে। এছাড়া সারাদেশে তিন শতাধিক পৌর, উপজেলা ও থানা ইউনিটের কমিটি হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল ঢাকা মহানগর উত্তরে আমানউল্লাহ আমান ও দক্ষিণে আবদুস সালামকে আহ্বায়ক করা এবং বরিশালে মজিবর রহমান সরোয়ার, খুলনায় নজরুল ইসলাম মঞ্জু ও রাজশাহীতে মিজানুর রহমান মিনুকে বাদ দেওয়া। এছাড়া নাটোরে মৃতব্যক্তির নাম কমিটিতে অন্তর্ভুক্তি, নবগঠিত কমিটি এবং বিদ্রোহী জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা-জাসাসের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিও ছিল আলোচনায়।
নয়াপল্টনে সভা-সমাবেশ ছাড়া তেমন কোনো বড় কর্মসূচি করতে পারেনি বিএনপি/ ফাইল ছবি
অপরদিকে দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় পর ২০২১ সালে জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের গঠিত নতুন কমিটিতে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত অনেক নেতাকে বাদ দেওয়ার বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে। এই এক বছরে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের তৃণমূলের সব পর্যায়ের কমিটি গঠনও প্রায় শেষ পর্যায়ে। মহিলা দলও অধিকাংশ সাংগঠনিক জেলায় শাখা কমিটি দিয়েছে। সংগঠন পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় জ্যেষ্ঠ নেতাদের বাদ দিয়ে তরুণদের নেতৃত্বে নিয়ে আসার বিষয়টি অনেকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে দেখছেন। তবে দলের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব নির্বাচনে কথিত সেই সিন্ডিকেটের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিএনপির অভ্যন্তরেই রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, সিন্ডিকেটে সক্রিয়রা হাওয়া ভবনের ‘পঞ্চপাণ্ডব’ বলে খ্যাত। আট-দশ বছর আগেও এই পঞ্চপাণ্ডবের কেউ পলাতক ছিলেন, কেউবা গ্রেফতার হন র্যাবের হাতে। তবে সম্প্রতি দলের নানা কর্মকাণ্ড, এমনকি অন্দরমহলেও তাদের হাত পড়ছে। যে কারণে বিভিন্ন সময় বিএনপির মহাসচিবকেও অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হচ্ছে। অথচ এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টিকারীদের ব্যাপারে দলের পক্ষ থেকে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। যা ভবিষ্যতের জন্য শুভ কোনো দৃষ্টান্ত হবে না।
দলীয় কর্মসূচিতে এমপিদের অনুপস্থিতি
বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে নেতাকর্মীদের খুব একটা যোগাযোগ নেই বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ বছর দলের কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতেও তাদের তেমন একটা দেখা যায়নি। সংসদে সরকারি সুবিধা নিয়ে সরকারবিরোধী বক্তব্যে সরব থাকাতেই তাদের রাজনৈতিক চর্চা সীমাবদ্ধ বলে অভিযোগ তুলেছেন অনেক নেতাকর্মী।
অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে ফখরুল
গত ৬ ডিসেম্বর রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেন, সরকারের সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান একসময় ‘ছাত্রদল করতেন’। তার এ মন্তব্যের সঙ্গে সঙ্গেই অনুষ্ঠানে তর্কে জড়ান মিলনায়তনের দ্বিতীয় তলায় থাকা যুবদলের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক গোলাম মাওলা শাহীন। তিনি দাঁড়িয়ে ফখরুলের বক্তব্যে দ্বিমত জানিয়ে বলেন, ‘মুরাদ ছাত্রদল করেনি’। শাহীন এই তর্কে জড়িয়ে পড়লে মির্জা ফখরুল ধমকের সুরে বলেন, ‘ইউ ডোন্ট নো। তুমি বাজে কথা বলবে না। তুমি জানো না।’
বিএনপির কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থেকেছে কার্যালয়-মিলনায়তনে/ফাইল ছবি
এরপরও শাহীন তর্ক চালিয়ে গেলে মিলনায়তনে থাকা বিএনপিকর্মীরাও ক্ষুব্ধ হন। ফখরুল তখন শাহীনকে নিচে নেমে মঞ্চে আসার জন্য বারবার বলতে থাকেন। মঞ্চে থাকা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ঢাকার মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান, দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম তখন শাহীনকে চুপ থাকতে বলেন।
গত ৬ নভেম্বর রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলামের স্মরণসভায়ও অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়েন মির্জা ফখরুল। মহাসচিব যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা রকিবুল ইসলাম বকুল অনুষ্ঠানস্থলে ঢুকলে মহাসচিবের বক্তব্য বাধাপ্রাপ্ত হয়।
সবশেষ গত ১৮ ডিসেম্বর বিএনপি মহাসচিবের উপস্থিতিতে সিলেটে দলের দুই গ্রুপের চেয়ার ছোড়াছুড়ি এবং হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এর আগে গত ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে নেতাকর্মীদের ধাক্কাধাক্কিতে মাটিতে পড়ে যান মির্জা ফখরুল।
দায়িত্বশীলদের বক্তব্য
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, বারবার আন্দোলনের হুমকি দিয়ে আসা বিএনপি ২০২১ সালকেও কাটিয়েছে একইভাবে। এমনকি দলের প্রধানের বিদেশে চিকিৎসার দরকার বললেও সেই অধিকারও আদায় করতে পারেনি তারা। বারবার কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিলেও তারা নমনীয় কর্মসূচির বেশি কিছু করতে পারেনি। সেজন্য বিদায়ী বছরও তাদের কেটেছে ‘নিষ্ফল’।
তবে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, আন্দোলন চলছে, আন্দোলন আরও বেগবান হবে। আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সব ধরনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হবে।
১৬ ডিসেম্বর জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান বিএনপির নেতাকর্মীরা/ফাইল ছবি
এ বিষয়ে বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক মুহাম্মদ মুনির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, জেল-জুলুম-নির্যাতনে বিএনপির নেতাকর্মীরা ভালো নেই। ম্যাডাম অসুস্থ, তাকে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না।
দলের বর্তমান হালচাল নিয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জাগো নিউজকে বলেন, এই স্বৈরাচারী সরকারের দুঃশাসনে শুধু বিএনপি নয়, দেশের মানুষ ভালো নেই।
বছরজুড়ে দলের চেয়ারপারসনের মুক্তি ও তার সুচিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর ইস্যুতে বিএনপি একদিকে আন্দোলন অন্যদিকে সংগঠন পুনর্গঠন প্রক্রিয়াও চালিয়েছে, এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে রিজভী বলেন, সংগঠন পুনর্গঠন দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। কেউ থাকবে কেউ চলে যাবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে। আর আমাদের আন্দোলন চলছে, আন্দোলন বেগবান হবে। আন্দোলনের মাধ্যমে সংগঠন আরও শক্তিশালী হবে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে হেনস্তাকারীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কোনো ব্যবস্থা আদৌ নেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা নীতিনির্ধারণী ফোরামের বিষয়। মহাসচিবকে অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে কেউ ফেলেছে বলে আমার জানা নেই। আমরা জানি, বিএনপি মহাসচিবকে সবাই সম্মান করে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ২০২১ সাল আমাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন সংকটময় ছিল। কারণ, এ বছর আমাদের দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পরিচালনায় দলের সাংগঠনিক তৎপরতা অনেক বেড়েছে। সেটা একটা পজিটিভ সাইড। সরকারের তরফ থেকে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা মানুষের জন্য ভালো ছিল না। কাজেই সেটা বিএনপির জন্যও ভালো ছিল না ।
বিভিন্ন সময়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া এবং এ নিয়ে সাংগঠনিক ব্যবস্থার প্রশ্নে মির্জা ফখরুল বলেন, আমি এতে বিব্রত হইনি। বড় বড় রাজনৈতিক দলে এসব সমস্যা থাকে।
কেএইচ/এমকেআর/এইচএ/এএসএম