পেট্রোলবোমায় লন্ডভন্ড শিক্ষাসূচি
বছরের প্রথম দিন নতুন বই হাতে নিয়ে শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাবে এটাই ছিলো স্বাভাবিক। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলনের কারণে সেই সুন্দর শুরুটা করতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। বরং পেট্রোলবোমায় পোড়া শিক্ষার্থীর লাশের গন্ধে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে ৫ কোটি শিক্ষার্থী।
পেট্রোলবোমায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে অনেক শিক্ষার্থী। পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে প্রাণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। টানা ৯৩ দিনের অবরোধ-হরতালে একের পর এক সহিংস ঘটনায় অঘোষিতভাবে বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ফলে লন্ডভন্ড হয়ে পড়ে শিক্ষাসূচি। এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
চলতি বছরের প্রথম দিন হরতাল ডাকে জামায়াতে ইসলামী। ২, ৩ ও ৪ জানুয়ারি ছিল সাপ্তাহিক এবং সরকারি ছুটি। ৫ জানুয়ারি ছিল অঘোষিত ‘সরকারি অবরোধ’। ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের টানা ৯৩ দিনের অবরোধ কর্মসূচি। ফেব্রুয়ারি থেকে অবরোধের সঙ্গে যুক্ত হয় হরতাল। সপ্তাহের প্রায় পাঁচ দিন জুড়েই হরতাল অব্যাহত থাকে। এভাবেই কাটে বছরের প্রথম তিন মাস।
সূত্র জানায়, বিএনপি জোটের অবরোধের প্রথম দিন ৬ জানুয়ারি ফেনীতে প্রাইভেট পড়ে বাসায় ফেরার পথে ককটেল বোমায় আক্রান্ত হয় এসএসসি পরীক্ষার্থী শাহরিয়ার হৃদয় ও মিনহাজুল ইসলাম অনিক। গুরুতর জখম হওয়ায় দুইজনই পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি। অনিকের অবস্থা গুরুতর হলে তাকে সরকারি খরচে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা দেয়া হয়।
১৭ জানুয়ারি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুলতানা ক্লাসে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের পেট্রোলবোমায় পুড়ে গুরুতর জখম হয়। ১৮ জানুয়ারি ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী সাথী ইসলাম ও শারমিন আকতার যূথী ক্যাম্পাস থেকে ফেরার পথে বাসে ছোড়া পেট্রোলবোমার আঘাতে অগ্নিদগ্ধ হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি বাবার সঙ্গে কক্সবাজার বেড়াতে যাওয়ার পথে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে চলন্ত গাড়িতে ছোড়া পেট্রোলবোমায় পুড়ে মারা যায় মাইশা তাসনিম (১৪)। সে যশোর পুলিশ লাইন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী ছিলো।
এভাবেই অসংখ্য শিক্ষার্থী পেট্রোলবোমা সন্ত্রাসের শিকার হয়। লক্ষ্মীপুর ও মানিকগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি স্থানে আগুন দিয়ে স্কুল পুড়িয়ে দেয়া হয়। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আজিমপুর ক্যাম্পাস ও ধানমন্ডির কাকুলি স্কুলের ভিতর পেট্রোলবোমা ছুড়ে মারে। এসব ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।ফলে অনেকেই সন্তানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো বন্ধ করে দেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিন মাসের পুরো আন্দোলন জুড়ে চলে পেট্রোলবোমার সন্ত্রাস। ৫ কোটি শিক্ষার্থীর মনে ভর করে স্বাভাবিক চলাচলের অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এ পরিস্থিতি সরকারি নির্দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও সহিংসতা-নাশকতার মাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির সংখ্যা। অভিভাবকরা সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রাইভেট কোচিংয়েও পাঠানো বন্ধ করে দেন। শিক্ষার্থীরা এক ধরণের গৃহবন্ধী হয়ে পড়ে। তবে শিক্ষকদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই হাজির হতে হয়েছে কর্মস্থলে।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ৯৩ দিনের অবরোধ-হরতালে ৫ কোটির বেশি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন বিঘ্নিত হয়েছে। এরমধ্যে প্রাথমিক, ইবতেদায়ী, মাধ্যমিক, দাখিল ও কারিগরি পর্যায়ে ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৫২ হাজার ৩৭৪ জন। দশম শ্রেণির ১৮ লাখ, উচ্চ মাধ্যমিকে ২০ লাখ এবং উচ্চশিক্ষা স্তরে প্রায় ২৫ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখরের এক গবেষণায় দেখা যায়, একদিনের হরতালে নষ্ট হয় সাড়ে ১২ কোটি শিক্ষাঘণ্টা।আর একদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে গড়ে একজন শিক্ষার্থী চারটি শ্রেণিঘণ্টার পড়ালেখা থেকে বঞ্চিত হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অবরোধ শেষে তিন মাসের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি চাপ দেয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ। রাজধানীর অনেক প্রতিষ্ঠানে ছুটির দিনেও ক্লাস হয়। অভিভাবকরাও শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি চাপ দেন। এতে মানসিক চাপে পড়ে শিক্ষার্থীরা। এতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিএনপি জোটের অবরোধ-হরতালের কারণে সবচেয়ে বিপাকে পড়ে প্রায় ১৫ লাখ এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীরা। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও হরতালের কারণে ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়।পরীক্ষার্থীরা একটি বিষয়ের প্রস্তুতি নিতে না নিতেই হরতালের কারণে তা পিছিয়ে যায়। ফলে বার বার নতুন করে অন্য বিষয়ের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হয়। যার কারণে অনেক পরীক্ষার্থী পড়ার টেবিলে বসাই ছেড়ে দেন।
শিক্ষামন্ত্রীসহ সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি পরীক্ষার মধ্যে হরতাল না দেয়ার অনুরোধ করলেও আন্দোলনকারীরা তাতে কর্ণপাত করেনি। ফলে সরকার বাধ্য হয়ে শুক্র ও শনিবার পরীক্ষা নেয়।
তিন মাসের অবরোধে তছনছ হয়ে পড়ে উচ্চ শিক্ষাসূচিও। রাজনৈতিক অস্থিরতায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এসময় বন্ধ হয়ে যায়। আন্দোলনকারীদের পেট্রোলবোমা সন্ত্রাসে পুরো দেশ জুড়ে আতঙ্ক তৈরি হয়। রাজধানীসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরে ভীতিকর পরিস্থিতির কারণে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় খোলা ছিলো সেগুলোরও ক্লাস-পরীক্ষা নিয়মিত হয়নি। বুয়েটে শুক্রবার পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনানুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ ঘোষণা করে। ৩৫টি পাবলিক ও ৮০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ২৫ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটায়। তিন মাসের আন্দোলনের কারণে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এখনো ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
সরকারি হিসাব অনুযায়ি, বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি ৫২ দিন আর অন্যান্য ছুটি থাকে ৮৫ দিন। সেই হিসাবে ১৩৭ দিন এমনিতেই বন্ধ থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিবছরেই থাকে চারটি পাবলিক পরীক্ষা। ফলে বছরের বড় একটি অংশ ক্লাস ছাড়াই চলে শিক্ষার্থীদের। এর ওপর তিন মাসের টানা অবরোধ-হরতালে অনির্ধারিতভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। এ ক্ষতি আগামী ২৫ বছরেও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না বলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ দাবি করেন।
গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, মানুষের তৈরি দুর্যোগে বাচ্চাদের শিক্ষাজীবন ব্যাহত হওয়া মোটেই কাম্য নয়।এ ধরনের সহিংস অবরোধ-হরতালের ফলে নতুন প্রজন্ম রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হবে। তারা রাজনীতিতে আসবে না, মাস্তানরাই আসবে; যা একটি দেশের জন্য মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। রাজনীতিবিদদের উচিত হরতাল-অবরোধের মতো সহিংস কর্মসূচির বিকল্প ভাবা। যাতে করে শিক্ষাসূচি ব্যাহত না হয়।
এনএম/এসকেডি/জেডএইচ/পিআর