নির্বাচনী বছরে অস্থিরতায় ব্যাংক খাত
>> লাগামহীনভাবে বেড়েছে খেলাপি ঋণ
>> ‘ছয়-নয়’ সুদহার নিয়ে ‘নয়-ছয়’
>> আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে অগ্রগতি
অর্থনীতির ধারক-বাহক ব্যাংক খাত। ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপসহ পরিচালনা পর্ষদের স্বেচ্ছাচারিতায় গুরুত্বপূর্ণ এ খাতে চলছে চরম অস্থিরতা। লাগামহীনভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। নানা জালিয়াতি ও ঋণ কেলেঙ্কারিতে নাজুক অবস্থায় মূলধনও খেয়ে ফেলছে কোনো কোনো ব্যাংক। এসব ঘটনায় অনেকটাই নীরব ছিল নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ব্যাংক। নেয়া হয়নি দৃশ্যমান কোনো অবস্থা। তবে এসব অনিয়মের মধ্যেও আর্থিক অন্তর্ভুক্তি-অগ্রগতিতে সক্রিয় ছিল ব্যাংক খাত।
মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং, কৃষিকদের ব্যাংকমুখী করাসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে ব্যাংক খাত।
বছরের শুরুতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি সামান্য বাড়িয়ে চলতি অর্থবছরের (২০১৭-১৮) দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন, ২০১৮) জন্য সতর্কতামূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নির্বাচনী বছর হওয়ায় চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য (জুলাই-ডিসেম্বর) বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ধরে সংযত ধরনের মুদ্রানীতি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সে সময় গভর্নর ফজলে কবির বলেন, নির্বাচনী বছরে টাকার সরবরাহ বাড়বে। এজন্য আগের ধারাবাহিকতায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি সংযত ধরনের হবে।
এরপরই আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় আগ্রাসী ঋণে লাগাম টানতে ব্যাংকগুলোর ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) কমিয়ে নতুন সীমা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন সীমায় প্রচলিত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে দেড় শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোতে এক শতাংশ কমানো হয়। কিন্তু হয়নি সমাধান। বেড়েছে ঋণ বিতরণ। নানা অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনায় বিতরণ ঋণ সঠিক সময় আদায় না হওয়ায় লাগামহীন বেড়েছে খেলাপি ঋণ।
বেড়েছে খেলাপি ঋণ : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আট লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল সাত লাখ ৯৮ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ নয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে, বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল ব্যাংকের নানা অনিয়মের খবর। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংক, এনআরবিসি ও রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের ক্রিসেন্ট ও এননটেক্স গ্রুপের ঋণ অন্যতম।
অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ডুবতে বসা ফারমার্স ব্যাংক জাগাতে মূলধন জোগানসহ নেয়া হয় নানা উদ্যোগ। ব্যাংকটির নামও পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়। নতুন প্রজন্মের এ ব্যাংককে বাঁচাতে এক হাজার ২১৫ কোটি টাকা মূলধন সহায়তা দিতে এগিয়ে আসে সরকারি চার ব্যাংক ও একটি বিনিয়োগ সংস্থা। এর মধ্যে ৮১৫ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে, আরও ৪০০ কোটি টাকা দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়া শুরু থেকে ব্যাংকটিতে এসব প্রতিষ্ঠানের ৫৫০ কোটি টাকা ধার রয়েছে। মূলধন সহায়তা দিয়ে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক এবং ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হয়েছে।
ঋণ কেলেঙ্কারি : বছরজুড়ে আলোচিত ছিল জনতা ব্যাংকের এননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপকে দেয়া ঋণ কেলেঙ্কারি। এননটেক্স গ্রুপের ২২টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকটির ঋণ রয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অনিয়মের কারণে দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা ঋণ খেলাপির নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটি ব্যাংক খাতের একক ঋণের বৃহত্তম কেলেঙ্কারি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এছাড়া ক্রিসেন্ট গ্রুপের পাঁচ প্রতিষ্ঠানের কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। এর প্রায় পুরোটাই খেলাপি করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছে ক্রিসেন্ট লেদারের ৬৩৭ কোটি টাকা, রূপালী কম্পোজিটের ৬৫০ কোটি টাকা, লেক্সকো লিমিটেডের ৪১০ কোটি টাকা, ক্রিসেন্ট ট্যানারির ১৫৮ কোটি টাকা ও রিমেক্স ফুটওয়্যারের ৮৭২ কোটি টাকা। তবে সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার সুবিধা পেয়েছে ক্রিসেন্ট গ্রুপ। সম্প্রতি এসব খেলাপি ঋণ উদ্ধারে বন্ধকি সম্পদ নিলামেও তুলেছে জনতা ব্যাংক।
ঋণের নামে ব্যাংক থেকে রীতিমতো অর্থ লুটের অভিযোগ ওঠে এসএ গ্রুপের কর্ণধার মো. শাহাবুদ্দিন আলমের নামে। বলা হয় তিনি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। অর্থ কেলেঙ্কারি মামলায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তাকে গ্রেফতার করে। আদালত তাকে কারাগারেও পাঠায়। আলোচিত এ ব্যবসায়ী বিভিন্ন সময় ভুয়া কাগজ তৈরি করে বিভিন্ন ব্যাংকে এলসি খোলেন। যা উঠে আসে সিআইডির তদন্তে। এলসির বিপরীতে যেসব কাঁচামাল আমদানির কথা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা আসেনি। যেসব এলসির বিপরীতে বন্ড সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করা হয়, সেগুলোও নিয়ম ভেঙে খোলাবাজারে বিক্রি করা হয়। আবার এলসির বিপরীতে নেয়া ঋণ ব্যাংককে পরিশোধ করেননি তিনি।
এদিকে, বছরের শেষ সময়ে ব্যাংক লুটের তথ্য প্রকাশ করে বোমা ফাটায় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। বড় কয়েকটি ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় গত প্রায় ১০ বছরে ব্যাংক খাতে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। এসব অনিয়মের বেশির ভাগই রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলোতে হয়েছে। এতে নড়েচড়ে ওঠে সরকারসহ ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা। পাল্টাপাল্টি বক্তব্য আসে বিভিন্ন মহল থেকে। ব্যাংকের পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, আট লাখ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ হয়েছে। ঋণ দিলে কিছু খেলাপি হবে, এটাই স্বাভাবিক।
ছয়-নয় সুদহার : সুদহার সিঙেল ডিজিটে নামানোর দাবি ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের। সুদহার কমাতে সরকারের উচ্চ মহল থেকেও চাপ দেয়া হয়। ফলে বছরের মাঝামাঝিতে ব্যাংক আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার ৬ শতাংশ ও ঋণে ৯ শতাংশ নামিয়ে আনার ঘোষণা দেন বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালক ও ব্যবস্থাপকরা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী এমন প্রতিশ্রুতি দেন তারা। বিগত জুলাই মাস থেকে বাস্তবায়নের কথা বলে ব্যাংকগুলো সরকারের কাছ থেকে কর্পোরেট করহার কমানোসহ নানা সুযোগ-সুবিধাও পায়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এখনও ১০ শতাংশের ওপরে ঋণের সুদ আদায় করছে বেশির ভাগ ব্যাংক। ছয়-নয় সুদহারকে নয়-ছয় বুঝিয়ে নানা টালবাহানা করছেন ব্যাংকাররা। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ডাবল ডিজিটে (১০ শতাংশের বেশি) ঋণের সুদ আদায় করছে দেশি-বিদেশি ২৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংক।
এদিকে, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক খাতের করহার ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৩৭ করা হয়। ঋণের সুদহার কমানোর শর্তেই ব্যাংক করহার কমানোর কথা বললেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
ভল্টের স্বর্ণ হেরফের : শেষ হতে যাওয়া বছরের অন্যতম ঘটনা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টের স্বর্ণ হেরফের। চলতি বছরের ১৭ জুলাই ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে ভুতুড়ে কাণ্ড’ শিরোনামে একটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের সোনার চাকতি ও আংটি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমা রাখার পর, তা মিশ্র বা শংকর ধাতু হয়ে যায়। এছাড়া, ২২ ক্যারেটের সোনা ১৮ ক্যারেট হয়ে যায় বলেও ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের প্রতিবেদন নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের মধ্যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। ওই সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। ওই ঘটনায় জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দাবি করে, ‘বাংলাদেশে ব্যাংকের ভল্টে রাখা সোনার কোনোপ্রকার হেরফের হয়নি। একটি ক্লারিক্যাল মিসটেকের (করণিক ভুল) কারণে স্বর্ণের মানের পার্থক্য দেখা দিয়েছে।’ কিন্তু স্বর্ণের হেরফেরের বিষয়টি নিয়ে এখনও জনমনে বিভ্রান্ত কাটেনি।
রিজার্ভ চুরি : গত দুই বছরের মতো এবারও আলোচনায় ছিল রিজার্ভ চুরির ঘটনা। চুরি হওয়া অর্থ উদ্ধারে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে রিজার্ভ থেকে চুরি হয় আট কোটি ১০ লাখ ডলার। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ফেরত এসেছে ১৪ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন বা এক কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার। এখনও অনাদায়ী রয়েছে ৬৬.৪ মিলিয়ন বা ছয় কোটি ৬৪ লাখ ডলার।
এমডির পদত্যাগ : বছরজুড়ে বেশ আলোচিত ছিল বিভিন্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) পদত্যাগ। পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ‘অযাচিত হস্তক্ষেপে’ বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করছেন অনেক এমডি। ১৪ আগস্ট বেসিক ব্যাংকের এমডি মুহাম্মদ আউয়াল খান পদত্যাগপত্র জমা দেন। ডুবতে থাকা এ ব্যাংকটির চাপ নিতে না পারায় পদত্যাগ করেন তিনি। এছাড়া পর্ষদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় গত ২৯ আগস্ট পদত্যাগ করেন বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের (ইউসিবি) এমডি এ ই আব্দুল মুহাইমেন। ১১ অক্টোবর পদত্যাগ করেন এবি ব্যাংকের এমডি মশিউর রহমান চৌধুরী। ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা দিনদিন খারাপের দিকে যাওয়ায় পদত্যাগের জন্য তার ওপর বিভিন্ন পক্ষের চাপ ছিল বলে জানা যায়।
অস্থির ডলারের বাজার : বছরজুড়ে ডলারের দামে ছিল তেজিভাব। আমাদনির তুলনায় রফতানি আয় কম। রেমিট্যান্সও আসেনি আশানুরূপ। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ায় চাপ পড়ে ডলারের বাজারে। সে সুযোগে কিছু অসাধু ব্যাংক অতি মুনাফার লোভে বাড়িয়ে দেয় বৈদেশিক মুদ্রার দাম। আমদানিতে ডলারের দাম বেশি নেয়ায় বেসরকারি খাতের নয় ব্যাংককে শোকজও করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
২০১৮ সালের অক্টোবরে টাকার বিপরীতে নগদ মার্কিন ডলারের মূল্য সর্বোচ্চ ৮৬ টাকা ৫০ পয়সায় ওঠে। আমদানি পর্যায়ের ডলারের দর ওঠে ৮৩ টাকা ৯০ পয়সা।
এদিকে, বাজারে ডলারে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বহুমুখী পদক্ষেপ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বাড়ানো হয় ডলারের সরবরাহ। ব্যাংকগুলো যাতে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য বাড়ানো হয় নজরদারি। প্রতি সপ্তাহে এলসির দেনা শোধ ও বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জানানোর জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়।
আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে অগ্রগতি : আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অংশ হিসেবে সুবিধাবঞ্চিতদের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে কাজ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি বছরে বেশ অগ্রগতিও হয় এ খাতে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছাতে বাড়ে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের সংখ্যা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে গ্রাহক সংখ্যা ২০ লাখেরও বেশি। এক বছর আগেও যেখানে গ্রাহক ছিল ১০ লাখ ৩৮ হাজার। এছাড়া অক্টোবর শেষে দেশে মোবাইল ব্যাংক ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ছয় কোটি ৫০ লাখ। প্রতিদিন গড়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হয় এক হাজার কোটি টাকা।
কৃষি ও পল্লীঋণের চাহিদার কথা বিবেচনায় রেখে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লীঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরের তুলনায় ৬ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। বিগত বছরে ব্যাংকগুলোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
নতুন ব্যাংক অনুমোদন : অর্থনীতিবিদদের সমালোচনা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আপত্তি সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংক অনুমোদনের বিষয়টি বছরজুড়ে ছিল বেশ অলোচিত। নানা সমালোচনার মধ্যেও বাংলাদেশ পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের (বিপিডব্লিউটি) কমিউনিটি ব্যাংক চালুর চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শেষ মুহূর্তে এ নির্বাচনী মাসে রাজনৈতিক বিবেচনায় ‘বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক’কে নীতিগত অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটির চূড়ান্ত অনুমোদন (লেটার অব ইনট্যান্ট) আগামী বোর্ড সভায় দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া অপেক্ষায় রয়েছে প্রস্তাবিত ‘পিপলস ব্যাংক’ আর ‘সিটিজেন ব্যাংক’।
এদিকে, ব্যাংক খাত নিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, বিগত কয়েক বছরে দেশের উন্নতি হয়েছে। কিন্তু ব্যাংক খাতে উল্টো চিত্র। উন্নয়নের বদলে অবনতি ঘটেছে। নিয়ম-নীতি লঙ্ঘনের খাত হিসেবে এ খাত চিহ্নিত হয়েছে। অথচ অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড ব্যাংক খাত। পুরো অর্থনীতির প্রাণসঞ্চার হয় এখান থেকে। ব্যাংক খাত ছাড়া মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়া যাবে না।
তিনি বলেন, ‘অর্থনীতির প্রধান এ খাতকে ভালো অবস্থায় নিতে চাইলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার। কারণ ব্যাংক হলো আস্থার জায়গা। কিন্তু এখন সাধারণের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কোন ব্যাংকে টাকা রাখলে আমানত নিরাপদ থাকবে? আগে কখনও এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি।’
বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘ব্যাংক থেকে নিয়ম ভেঙে সব লুটপাট হয়েছে। ঋণখেলাপি ব্যক্তি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা কঠিনভাবে প্রয়োগ হলেও যারা প্রভাবশালী, তাদের ক্ষেত্রে এমন সুযোগ দেয়া হচ্ছে।’
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আগামীতে যারাই ক্ষমতায় আসবেন, ব্যাংক খাতকে লুটপাটের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ দেবেন না।’
অনিয়ম-দুর্নীতি, ঋণ কেলেঙ্কারি আর নানা জাল-জালিয়াতির কারণে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের দুই মেয়াদে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। তাই আগামীতে ক্ষমতায় আসলে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের উন্নয়ন, খেলাপি ঋণ কমানোসহ ঋণ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে বলে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশকালে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এসআই/এমএমজেড/এমএআর/আরএস/এমএস