নিষ্প্রাণ সংসদে একতরফা বিষোদগার
কার্যকর বিরোধীদল না থাকায় বিগত কয়েক বছরের মতো ২০১৬ সালের সংসদও একতরফাভাবে চলেছে। নিষ্প্রাণ সংসদে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে একতরফা বিষাদগার করা হয়েছে। অন্যদিকে সংসদের অধিবেশনে মন্ত্রীদের অনুপস্থিতি নিয়ে বছরজুড়েই বিতর্ক ছিল।
এই বছরে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী-এমপি এবং বিচারপতিদের বেতন-ভাতা দ্বিগুণ বৃদ্ধির মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিল পাস হয়। লুই আই কানের তৈরি বিশ্বের অনন্য স্থাপত্য নিদর্শন জাতীয় সংসদের মূল নকশা এ বছরে আনা হয়েছে। সেই নকশার আলোকে অবৈধ স্থাপনা ভেঙে ফেলার পদক্ষেপও নেয়া হচ্ছে।
এছাড়া যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত, এরশাদ-জিয়া ও মোশতাকের পেনশন সুবিধা বাতিলের মতো সাহসী সিদ্ধান্তও গৃহীত হয় ২০১৬ সালে।
৮৩ কার্যদিবসে ৫০ আইন পাস
গত ২০ জানুয়ারি শুরু হওয়া চলতি দশম সংসদের নবম অধিবেশন থেকে শুরু করে সর্বশেষ ৮ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ অধিবেশন পর্যন্ত মোট ৫টি অধিবেশনে পাস হয় অর্ধশত বিল। আর কার্যদিবস ছিল ৮৩টি। অধিবেশন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০ জানুয়ারি শুরু হওয়া বিদায়ী বছরের প্রথম অধিবেশনটি ২৭ কার্যদিবস চলে। এ অধিবেশনে মোট ৯টি বিল পাস হয়।
২৪ এপ্রিল শুরু হওয়া বছরের দ্বিতীয় অধিবেশনটি চলে ৯ কার্যদিবস। এই অধিবেশনে ১৪টি বিল পাস হয়েছে। ১ জুন শুরু হওয়া বাজেট অধিবেশন চলে ২৭ জুলাই পর্যন্ত। বছরের এই তৃতীয় অধিবেশনে পাস হয় দেশের বৃহত্তর বাজেট। অধিবেশনের ৩২ কার্যদিবসের ২৩ দিনই ছিল বাজেট সংক্রান্ত আলোচনা। এই অধিবেশনে ১৬টি বিল পাস হয়।
২৫ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া বছরের চতুর্থ অধিবেশনে ১০ কার্যদিবস চলে। ৬ অক্টোবর পর্যন্ত এই অধিবেশনে ৬টি বিল পাস হয়। ৪ ডিসেম্বর শুরু হওয়া সংসদের বছরের পঞ্চম অধিবেশন চলে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত। মাত্র ৫ কার্যদিবসের এই এ অধিবেশনে ৫টি বিল পাস হয়।
অন্যদিকে ২০১৫ সালে বসেছে চারটি অধিবেশন। ওইবছর ৮৫ কার্যদিবস সংসদ চলেছে। পাস হয়েছে ২৯টি আইন। চলতি বছর আইন বেশি পাস হলেও সংসদের কার্যদিবস ছিল দুইদিন কম।
নিষ্প্রাণ সংসদে একতরফা বিষোদগার
প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকার ও বিরোধীদলের সংসদ সদস্যরা বলেছেন, খালেদা জিয়া জনবিচ্ছিন্ন, হতাশ ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। এ কারণে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র-চক্রান্তে লিপ্ত। তারা ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবেলায় দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। এ সময় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এমনকি বিরোধীদলীয় নেতারাও বিএনপি নেতাদের তীব্র সমালোচনা করেন। এছাড়াও জিয়াউর রহমান প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নয় বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমসহ একাধিক এমপি।
কার্যকর ও প্রাণবন্ত হয়নি সংসদ
সরকার ও বিরোধীদল কার্যকর ও প্রাণবন্ত রাখার ঘোষণা দিলেও গত বছরের অধিবেশনগুলোতে কোরাম সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। দশম সংসদের একদশতম এই অধিবেশনের প্রায় প্রতিটি দিনেই নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে অধিবেশনের কার্যক্রম শুরু করতে হয়েছে। বিশেষ করে মাগরিবের নামাজের বিরতির পর আরো সংকটাপূর্ণ অবস্থায় পড়তে হয়েছে সংসদকে। সাধারণত সিনিয়র এমপি এবং মন্ত্রীদের হাজিরা কমে সংসদে। কিন্তু এবার হলো পুরো ব্যতিক্রম। অধিবেশনে পুরনোদের দেখা মিললেও নতুনদের প্রায়ই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মন্ত্রীদের উপস্থিতি নিয়ে বিতর্ক
মন্ত্রীদের অনুপস্থিতি নিয়ে বিদায়ী বছরের প্রায় সবকটি অধিবেশনে সরকারি দলের এমপিরা নিজেদের মধ্যেই বিতর্কে জড়িয়েছেন। তারা নিজদল ও জোটের এমপিদের সমালোচনায় অযাচিত ভাষা প্রয়োগ করেছেন, যা তাৎক্ষণিকভাবেই একপাঞ্জ করার দাবি ওঠে। আলোচনায় অংশ নিয়ে সংসদ কক্ষে সরকারি দলের প্রথম সারিতে কোনো মন্ত্রী উপস্থিত না থাকার বিষয়টি তুলে ধরেন এমপিরা।
সংসদের বাজেট অধিবেশনে প্রস্তাবিত বাজেটের উপর আলোচনার সময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ উপস্থিত না থাকায় সমালোচনা করেন জাতীয় পার্টির এমপিরা। এছাড়া বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেননকে ‘ভেজাইল্ল্যা’ মন্ত্রী হিসেবে অখ্যায়িত করেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
দুর্লভ স্থাপত্যকর্মের ঐতিহাসিক নকশা
গত বছরই সরকার ও জাতীয় সংসদ সংশ্লিষ্টদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রস্তাবিত আইয়ুব নগর প্রকল্পসহ সংসদ ভবনের দুর্লভ স্থাপত্যকর্মের ঐতিহাসিক নকশাগুলো দেশে আনতে সক্ষম হয়েছে জাতীয় সংসদ। এই নকশা বাংলাদেশের হাতে ছিল না। আর লুই আই কানের এই মূল নকশা না পাওয়ার কারণে সংসদ ভবন এলাকার উন্নয়ন কার্যক্রম আটকে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া ইউনিভার্সিটির আর্কাইভে এই নকশার সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর তার উত্তরসূরিদের নিকট থেকে ওই নকশা সংগ্রহ করতে গত ২৯ মে জাতীয় সংসদের অতিরিক্ত সচিব (আপিএ) আ ই ম গোলাম কিবরিয়ার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দলটি যুক্তরাষ্ট্রে যান। এ প্রতিনিধি দলে ছিলেন- স্থাপত্য অধিদফতরের প্রধান স্থপতি কাজী গোলাম নাসির, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (উন্নয়ন শাখা-৯) অধিশাখা মো. মনিরুজ্জামান, গণপূর্ত অধিদফতরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব ও স্থাপত্য অধিদফতরের সহকারী স্থপতি সাইকা বিনতে আলম। তারা সেখানে নকশাগুলো দেশে আনার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করেন। সম্পাদিত ওই চুক্তি অনুযায়ী মাত্র ক’দিন আগেই নকশাগুলো বাংলাদেশের হাতে আসে।
এরশাদ-জিয়া ও মোশতাকের পেনশন সুবিধা বাতিল
রাষ্ট্রপতির দায়িত্বপালনকারী মোশতাক আহমেদ, জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কোনো পেনশন সুবিধা পাবেন না এমন বিধান করে ‘রাষ্ট্রপতির অবসর ভাতা, আনুতোষিক ও অন্যান্য সুবিধা আইন-২০১৬’ বিল পাস করা হয় গত বছরের তৃতীয় অধিবেশনে। আইন অনুযায়ী, এই তিনজন বাদে ছয় মাস রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন এমন সবাই পেনশন সুবিধার অধিকারী হবেন। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী গত ৪ অক্টোবর যুগান্তকারী এই বিলটি সংসদে উত্থাপন করলে বিরোধীদল জাতীয় পার্টির এমপিদের বাঁধার মুখেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়।
যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত
গত বছরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারী এবং দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত দিয়েছে জাতীয় সংসদ। আওয়ামী লীগের এমপি ফজিলাতুন নেসা বাপ্পী সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি সংসদে উত্থাপন করেন। উত্থাপিত সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি সমর্থন করে বক্তব্য দেন নূরজাহান বেগম, মনিরুল ইসলাম, আবদুল মতিন, বেগম সানজিদা খানম ও ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়া। সবার বক্তব্য শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যাকারী যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধীদের কোনো সম্পত্তি এই স্বাধীন দেশে থাকতে পারে না, রাখার কোনো অধিকার নেই। অতিদ্রুতই বঙ্গবন্ধুর খুনি এবং দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের নামে-বেনামে থাকা সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। এই কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। পরে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার জাগো নিউজকে পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, জাতীয় সংসদে বিরোধীদল কোথায় দেখেন? আমি তো দেখি না। বিরোধীদল তো সংসদে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এরা (জাতীয় পার্টি) বিরোধীদল না সরকারি দল, না কোনো দল, বিষয়টি নিরুপণ করা দুরুহ। তারা সরকারের অংশ হিসেবে সুযোগ-সুবিধা নেয়াতেই ব্যস্ত। এছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সংসদের এমপিদের কোনো উদ্যোগ সারাবছর চোখে পড়েনি।
এইচএস/বিএ