চলতি বছরে ঝরে যাওয়া নক্ষত্রেরা
নতুন বছর আসতে আর মাত্র দুদিন বাকি। গোটা বছরের হিসাব মেলাতে গিয়ে উঠে আসে হারিয়ে যাওয়া কিছু মানুষের নাম। গত বছরও এই দিনে অনেকেই জানতেন না তারা আজ না ফেরার দেশের বাসিন্দা হবেন। ২০১৬ সালে শোবিজের অনেক পরিচিত এবং জনপ্রিয় শিল্পী মারা গেছেন। তাদের নিয়ে জাগো নিউজের এই প্রতিবেদন...
অভিনেত্রী দিতি (মৃত্যু : ২০ মার্চ)
চলতি বছরের ২০ মার্চ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরদিনের জন্য না ফেরার দেশে চলে গেছেন অভিনেত্রী পারভীন সুলতানা দিতি। গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ব্রেন টিউমারজনিত অসুস্থতার কারণে তার মৃত্যু হয়। তার অকাল প্রয়াণে শোকের ছায়া নেমে আসে চলচ্চিত্র তথা সংস্কৃতি অঙ্গনে।
পারভীন সুলতানা দিতি ১৯৬৫ সালের ৩১ মার্চ নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁওয়ে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই গান ও অভিনয়ের প্রতি দিতির ছিল দুনির্বার আকর্ষণ। সেই সূত্রেই ১৯৮৪ সালে নতুন মুখের সন্ধানের মাধ্যমে দেশীয় চলচ্চিত্রে দিতির সম্পৃক্ততা ঘটে। তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র উদয়ন চৌধুরী পরিচালিত ‘ডাক দিয়ে যাই’। কিন্তু ছবিটি শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়নি। দিতি অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম চলচ্চিত্র ছিল ‘আমিই ওস্তাদ’। ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন আজমল হুদা মিঠু। এরপর দিতি দুই শতাধিক ছবিতে কাজ করেছেন।
চিত্র পরিচালক খালিদ মাহমুদ মিঠু (মৃত্যু : ৭ মার্চ)
চলতি বছরে বেশ ক’জন গুণী মানুষকে হারিয়েছি আমরা। তার ভিড়ে একজন চলচ্চিত্র পরিচালক খালিদ মাহমুদ মিঠু। গত ৭ মার্চ নিজ বাসার সামনে একটি গাছের ডালের নিচে চাপা পড়ে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৫ বছর। চিত্রশিল্পী কনকচাঁপা চাকমার সঙ্গে সুখের দাম্পত্য জীবনে আর্য শ্রেষ্ঠ ও শিরোপা পূর্ণা নামে দুই সন্তানের জনক ছিলেন তিনি।
খালিদ মাহমুদ মিঠু দেশের স্বনামধন্য চলচ্চিত্রকার ও চিত্রশিল্পী। ১৯৬০ সালে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৮৬ সালে এমএফএ করেন। খালিদ মাহমুদ মিঠু পরিচালিত প্রথম ছবি ‘গহীনে শব্দ’। প্রথম ছবিই তাকে এনে দিয়েছিলো শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্তির সম্মান। ছবিটি শ্রেষ্ঠ পরিচারলকসহ চারটি ক্যাটাগরিতে ২০১০ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। এই অসামান্য সাফল্যের কারণে খালিদ মাহমুদ মিঠুকে আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা দিয়েছে বেঙ্গল শিল্পালয়।
২০০৭ সালে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত ১৬ তম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে ‘আরব বাংলাদেশ ব্যাংক পুরস্কার’ লাভ করেন। আর চলতি বছরে তার নির্মিত ‘জোনাকির আলো’ ছবিটি সেরা অভিনেত্রীর জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে। চলচ্চিত্র নির্মাণ ও ছবি আঁকার পাশাপাশি মিঠু পরিচিত ছিলেন একজন লেখক হিসেবেও। নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে বই লিখেছেন তিনি।
চলচ্চিত্র নির্মাতা শহিদুল ইসলাম খোকন (মৃত্যু : ৪ এপ্রিল)
ঢাকাই চলচ্চিত্রের স্বনামধন্য নির্মাতা শহিদুল ইসলাম খোকন মারা যান গেল ৪ এপ্রিল। রাজধানীর উত্তরার একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে মুখগহ্বরের ‘মটর নিউরো ডিজিস’ (এএলএস)-এ আক্রান্ত ছিলেন খোকন। গত বছর ১০ সেপ্টেম্বর উন্নত চিকিৎসার জন্য আমেরিকা গিয়েছিলেন। আমেরিকার ‘বেলভিউ হসপিটাল’-এর চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। অক্টোবরের শেষের দিকে তিনি দেশে ফিরে আসেন। শহিদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত উল্লেখ্যযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- ‘ঘাতক’, ‘পালাবি কোথায়’, ‘লাল সবুজ’, ‘ম্যাডাম ফুলি’, ‘ভণ্ড’ ইত্যাদি। তার প্রথম পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘রক্তের বন্দি’। এছাড়া তিনি ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির নেতা।
অভিনেতা ফরিদ আলী (মৃত্যু : ২২ আগস্ট)
দীর্ঘদিন অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২২ আগস্ট না ফেরার দেশে পাড়ি জমান বরেণ্য অভিনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা ফরিদ আলী। ফরিদ আলী ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম নাটকের শিল্পী এবং তৃতীয় নাটকের নাট্যকার। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। শেষ দিকে তার দুটি পা অবশ হয়ে গিয়েছিল। এছাড়াও ফুসফুসে পানি জমে হার্টের অবস্থাও ছিল নাজুক। অবশেষে সব কিছুর অবসান হলো। চিরতরে মুক্তির দেশে রওনা হয়েছেন প্রিয় এই অভিনেতা।
প্রয়াণের কয়েক মাস আগে এই অভিনেতার চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার নির্দেশেই হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে তার চিকিৎসা হয়েছিল। অভিনেতা ফরিদ আলী একাডেমিক শিক্ষায় তেমন অগ্রসর না হয়েও অভিনয় জগতে দেখিয়েছেন পারদর্শিতা। কৌতুক অভিনয়ে তিনি দর্শকদের মনে এখনও অনবদ্য। বিশেষ করে ‘টাকা দেন দুবাই যাব, বাংলাদেশে থাকবো না’ এই সংলাপটির সাথে যারা পরিচিত তারা এক বাক্যেই উচ্চারণ করবেন অভিনেতা ফরিদ আলীর নাম। শুধু অভিনয় নয়, নাটক লেখা ও নির্দেশনায়ও সিদ্ধহস্ত ছিলেন এই শিল্পী। শহীদুল আমীনের লেখা ‘কনে দেখা’ নাটকে একটি মাত্র নারী চরিত্রে অভিনয় করে ১৯৬২ সালে তিনি অভিনয়ে যাত্রা শুরু করেন। অসংখ্য মঞ্চ নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন।
শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর লেখা ‘একতলা দোতলা’ নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে ১৯৬৪ সালে তিনি প্রথম টিভিতে অভিনয় করেন। তার নিজের লেখা প্রথম টিভি নাটক ‘নবজন্ম’। ফরিদ আলীর চলচ্চিত্রে পদার্পণ ১৯৬৬ সালে আমজাদ হোসেনের ‘ধারাপাত’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে। তখন থেকে একাধারে বহু ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জীবন তৃষ্ণা, স্লোগান, চান্দা, দাগ, অধিকার ইত্যাদি।
সৈয়দ শামসুল হক ( মৃত্যু : ২৭ সেপ্টেম্বর)
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক চলতি বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর চিরবিদায় নেন পৃথিবী থেকে। বাংলা সাহিত্য জগতে এক কথায় সৈয়দ শামসুল হকের পরিচয় ‘সব্যসাচী লেখক’ হিসেবে। দীর্ঘ সাহিত্য জীবনে তিনি তার মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস এবং নাটকসহ শিল্প-সাহিত্যের নানা অঙ্গনে। চলচ্চিত্রেও তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাভাজন মানুষ। তার হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্র পেয়েছে ‘সুতরাং’, ‘মাটির ময়না’, ‘ময়নামতি’, ‘বড় ভাল লোক ছিল’, ‘তোমার আমার ঠিকানা’, ‘নতুন দিগন্ত’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘গেরিলা’র মতো বিখ্যাত সব চলচ্চিত্র। এই ছবিগুলোর চিত্রনাট্য লিখেছিলেন সৈয়দ হক। সম্ভবত ১৯৬৪ সালে মুক্তি পাওয়া সুভাষ দত্তের পরিচালনায় ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখার মধ্য দিয়েই চিত্রনাট্যকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি।
‘সুতরাং’ ছবিতে তার বেশ কিছু গান জনপ্রিয়তা পায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ‘এই যে আকাশ এই যে বাতাস’, ‘তুমি আসবে বলে, কাছে ডাকবে বলে, ভালোবাসবে বলে শুধু মোরে’ গান দুটি। এর বাইরেও বেশ কিছু কালজয়ী এবং জনপ্রিয় গান লিখে গেছেন কবি। তার মধ্যে চিরকাল সৈয়দ হককে মানুষের হৃদয়ে অমর করে রাখবে ‘বড় ভালো লোক ছিলো’ ছবির ‘হায়রে মানুষ রঙ্গীন ফানুস’ গানটি। মানবজীবনের অবধারিত পরিণতি নিয়ে লেখা এই গানটি এমন কোনো মানুষ নেই যার হৃদয়কে দোলা দেয় না। সৈয়দ হকের কথায় অবিস্মরণীয় এই গানটির সুর করেছিলেন আলম খান এবং গেয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর।
একসময় মানুষের মুখে মুখে ছিলো ‘এমন মজা হয় না, গায়ে সোনার গয়না, বুবু মনির বিয়ে হবে বাজবে কত বাজনা।’ দর্শক শ্রোতাদের হৃদয়ে গেঁথে থাকা আরো অনেক গানের মধ্যে আছে ‘একই অঙ্গে এত রূপ’ চলচ্চিত্রের ‘জানি না সে হৃদয়ে কখন এসেছে/ প্রাণের মাঝে দোলা দিয়েছে’, ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ ছবিতে ফেরদৌসী রহমানের কণ্ঠে ‘যার ছায়া পড়েছে, মনেরও আয়নাতে’, ‘ময়নামতি’ ছবির ‘অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায়’, ‘আশীর্বাদ’ চলচ্চিত্রের ‘চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা’। আরো বেশ কিছু গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘নদী বাঁকা জানি, চাঁদ বাঁকা জানি’, ‘তোরা দেখ দেখ দেখরে চাইয়া, রাস্তা দিয়া হাইটা চলে রাস্তা হারাইয়া’, ‘আমি চক্ষু দিয়া দেখতাছিলাম জগৎ রঙ্গিলা’, ‘চাম্বেলিরও তেল দিয়া কেশ বান্ধিয়া’, ‘পাগল পাগল মানুষগুলো পাগল সারা দুনিয়া, কেহ পাগল রূপ দেখিয়া, কেহ পাগল শুনিয়া’ ইত্যাদি
চিত্রনাট্যকার যোশেফ শতাব্দী ( মৃত্যু : ৮ সেপ্টেম্বর)
ঢাকাই চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় চিত্রনাট্যকার যোশেফ শতাব্দী চলতি বছরের ৮ সেপ্টেম্বর চলে গেছেন না ফেরার দেশে। ‘আসামি হাজির’ চলচ্চিত্র দিয়ে চিত্রনাট্যকার হিসেবে অভিষেক হয় যোশেফ শতাব্দীর। এরপর ‘ধর্ম আমার মা’, ‘আসমান জমিন’, ‘কোরবানি’, ‘মাটির দুর্গ’, ‘সুজন বন্ধু’সহ বেশকিছু ছবিতে চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন। সবশেষ শাহ আলম মণ্ডলের ‘সাদা কালো প্রেম’ ছবির চিত্রনাট্য লিখেন তিনি। অভিনেতা ও প্রযোজক মনোয়ার হোসেন ডিপজলের প্রায় সব ছবিতেই চিত্রনাট্যকার হিসেবে কাজ করেছেন যোশেফ শতাব্দী। ডিপজল অভিনীত ‘দাদি মা’, ‘চাচ্চু’, ‘মায়ের হাতে বেহেস্তের চাবি’, ‘পিতার আসন’সহ বেশ কয়েকটি ছবির কাহিনী লিখেছেন যোশেফ।
অভিনেতা মধু (মৃত্যু : ২৩ নভেম্বর)
হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২৩ নভেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন অভিনেতা গোলাম হাবিবুর রহমান মধু। গোলাম হাবিবুর রহমান মধুর জন্ম রাজশাহীতে। মাত্র ১৮ বছর বয়সে মঞ্চে তার অভিনয়ে হাতিখড়ি। ১৯৬২ সালে বেতারে এবং ১৯৬৯ সালে তিনি টেলিভিশনে অভিনয় শুরু করেন। সেই থেকে শেষদিন পর্যন্ত তিনি বেশকিছু জনপ্রিয় নাটক দর্শকদের উপহার দিয়েছেন। অভিনয় করেছেন চলচ্চিত্রেও।
রূপসজ্জাশিল্পী মোহাম্মদ ফারুক ( মৃত্যু: ২ অক্টোবর)
বাংলাদেশের নাটক ও চলচ্চিত্রজগতের গুণী রূপসজ্জাশিল্পী মোহাম্মদ ফারুক এ বছরের ২ অক্টোবর মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৬৫ সালে রূপসজ্জাশিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করেন মোহাম্মদ ফারুক। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি অসংখ্য নাটক ও চলচ্চিত্রের রূপসজ্জাশিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন।
বছরের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে স্মরণ করছি হারিয়ে ফেলা সেইসব মানুষদের। যাদের হাত ধরে এগিয়ে চলেছে আমাদের শিল্প ও সংস্কৃতি। বিশ্বজুড়ে নন্দিত হচ্ছে আমাদের সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্র ও শিল্পচর্চা। সকল প্রয়াত প্রাণের স্মরণে জাগোনিউজের পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
এনই/এলএ/পিআর