বছরজুড়ে বিমান বিধ্বস্তে আতঙ্কিত যাত্রীরা
বিশ্ব রাজনীতিতে অস্থিরতা, যুদ্ধের ধ্বংসলীলা থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা, সন্ত্রাস-জঙ্গি হানা ও নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার সাক্ষী বিদায়ী বছর। তবে সব কিছু ছাপিয়ে গেছে বছরজুড়ে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা। অন্যান্য বছরের মতো ২০১৬ সালও আতঙ্কে কেটেছে আকাশপথের যাত্রীদের। চলতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিমান দুর্ঘটনা কিংবা জঙ্গিদের গুলিতে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছে অন্তত তিন শতাধিক মানুষের। গত বছর বিমান দুর্ঘটনায় পাঁচ শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটলেও চলতি বছরের ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩১৫ জন নিহত হয়েছে।
এ বছরের প্রথম বিমান দুর্ঘটনা ঘটে ১০ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে। দেশটির একটি সামরিক বিমান বিধ্বস্ত হয়ে কমপক্ষে চারজন নিহত হন। রাজধানী নেপিদো থেকে উড্ডয়নের পরপরই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। দেশটির সংবাদমাধ্যম ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমার এক প্রতিবেদনে জানায়, বিচক্রাফট যাত্রীবাহী বিমানটি বিমানবন্দরের কাছেই একটি কৃষিজমিতে বিধ্বস্ত হলে বিমানের পাঁচ ক্রুর চারজন নিহত হন।
২৪ ফেব্রুয়ারি দুই প্রবাসীসহ ২৩ যাত্রী নিয়ে তারা এয়ারলাইন্সের একটি বিমান নেপালের মায়াগদি জেলার রুপসি চাহারির ডানা ভিডিসিতে বিধ্বস্ত হয়। বিমানের তিনজন ক্রুসহ ২৩ আরোহীর প্রাণহানি ঘটে। কাঠমান্ডু থেকে দুইশ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমের পোখারা বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের ১৫ মিনিট পর সকাল ৮টা ১০ মিনিটে বিমানটির সঙ্গে রাডারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে বিধ্বস্ত বিমানের সব আরোহীর মরদেহ উদ্ধার করা হয় ভিডিসি থেকে।
এ দুর্ঘটনার মাত্র দুদিন পর নেপালে আবারো ১১ আরোহীবাহী একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়। দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় পাহাড়ি এলাকায় একটি ছোট বিমান বিধ্বস্ত হলে এর দুজন ক্রু নিহত ও ৯ আরোহী মারাত্মক আহত হন।
বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা চলতি বছরের প্রত্যেক মাসেই ঘটেছে। বিশ্বজুড়ে শত শত মানুষের মাঝে নেমে আসে শোকের ছায়া। বছরের তৃতীয় মাসে ঘটেছে বছরের সবচেয়ে বেশি বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা। ১৪ মার্চ বলিভিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় বেনি এলাকার বাজারে একটি ছোট বিমান বিধ্বস্ত হয়ে সাতজনের প্রাণহানি ঘটে। আহত হন ১৫ জন। এর দুদিন পর ইকুয়েডরের এমাজোন এলাকায় একটি সেনা বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ২২ জন নিহত হন। ১৯ সেনা, দুই পাইলট এবং একজন মেকানিক নিয়ে বিমানটি উড্ডয়ন করেছিল। সেনারা প্যারাসুটে সামরিক মহড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু উড্ডয়নের পর পূর্বাঞ্চলীয় পাস্তাযা প্রদেশে স্থানীয় সময় আড়াইটার দিকে বিধ্বস্ত হয় বিমানটি।
১৯ মার্চ রাশিয়ায় একটি যাত্রীবাহী বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ৫৫ জন নিহত হন। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় শহরের রোসতোভ-অন-দোন বিমানবন্দরে ৫৫ আরোহী নিয়ে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। পরদিন ব্রাজিলে একটি ছোট বিমান বিধ্বস্ত হয়ে সাতজনের প্রাণহানি ঘটে।
২৭ মার্চ জাপানে একটি ছোট বিমান বিধ্বস্তে চার আরোহী নিহত হন। এ দুর্ঘটনার মাত্র দুদিন পর ৩০ মার্চ কানাডার কুইবেক দ্বীপে একটি প্রাইভেট বিমান বিধ্বস্ত হয়ে সাতজনের প্রাণহানি ঘটে। মনট্রিলের সেন্ট হিউবার্ট বিমানবন্দর থেকে সকাল সাড়ে ৯টায় উড্ডয়ন করে কিউবেকের উদ্দেশে রওনা দেয় দুই ইঞ্জিনবিশিষ্ট টারবোপ্রোপ বিমানটি। পরে ইল দ্য লা মাদলিন বিমানবন্দরে পৌঁছালে ভারি বাতাস ও তুষারপাতের কারণে বিধ্বস্ত হয়। পাপুয়া নিউগিনির পশ্চিমাঞ্চলে ১৪ এপ্রিল বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ১২ জন নিহত হন।
যুক্তরাষ্ট্রের গুয়াম ঘাঁটির কাছে ১৯ মে উড্ডয়নের পরপরই একটি বি-৫২ বোমারু বিমান বিধ্বস্ত হয়। তবে এ ঘটনায় কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। পরের দিন ফ্রান্সে একটি ছোট বিমান বিধ্বস্ত হয়ে তিনজনের প্রাণহানি ঘটে। বিমানটি কেন্দ্রীয় পর্তুগালের কোয়িমব্রে থেকে দক্ষিণাঞ্চলীয় দাক্সের দিকে যাত্রা করেছিল। পাখির সঙ্গে লেগে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছিল।
২১ মে ফ্রান্সে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে চার পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। ২৮ মে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত একটি ছোট বিমান যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরের হাডসন নদীতে বিধ্বস্ত হলে একজনের প্রাণহানি ঘটে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি খুদে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে তিনজনের মৃত্যু হয় ১৭ জুন। রাশিয়ার দমকল বাহিনীর একটি বিমান ১ জুলাই সাইবেরিয়ায় নিখোঁজ হয়। দেশটির জরুরি মন্ত্রণালয় জানায়, ১০ ক্রুবাহী একটি দল নিয়ে বিমানটি নিখোঁজ হয়।
২২ জুলাই ২৯ আরোহী নিয়ে ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের (আইএএফ) একটি বিমান বঙ্গোপসাগরে নিখোঁজ হয়। আইএএফের এএন-৩২ বিমানটি চেন্নাইয়ের তামবারাম থেকে ব্লেইর বন্দরের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল।
সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের ইদলিব প্রদেশে ১ আগস্ট রাশিয়ার একটি হেলিকপ্টারে গুলি চালিয়ে বিধ্বস্ত করে বিদ্রোহীরা। এতে বিমানের তিন ক্রুসহ অন্তত পাঁচজন নিহত হন বলে মস্কো নিশ্চিত করে। মস্কোর প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বার্তাসংস্থা ইন্টারফ্যাক্স জানায়, মানবিক সহায়তা কার্যক্রম শেষে এমআই-৮ হেলিকপ্টারটি আলেপ্পোর দিকে ফেরার পথে বিদ্রোহীদের হামলার শিকার হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যে একটি ছোট বিমান বিধ্বস্ত হয়ে কমপক্ষে ছয়জন নিহত হন ১৪ আগস্ট। শানোন ফ্রেডরিকবার্গ বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণের সময় বিমানটি দুর্ঘটনার শিকার হয়। বিমানটিতে রেড ইন্ডিয়ান পরিবারের তিন সদস্য ও এক জার্মান ছাত্র ছিলেন।
১৫ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রে একটি ছোট বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ছয়জনের মৃত্যু হয়। বিমানটি ফ্লোরিডা থেকে মিসিসিপির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল। ইঞ্জিনে ত্রুটির কারণে আলাবামার বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণের সময় এটি বিধ্বস্ত হয়।
ভারতের রাজস্থান প্রদেশে দেশটির বিমানবাহিনীর একটি মিগ-২১ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয় ১০ সেপ্টেম্বর। বিমানের দুই পাইলট নিরাপদে বেরিয়ে আসায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ২১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে একটি ছোট বিমান বিধ্বস্ত হয়ে দুজনের মৃত্যু হয়। ২৪ অক্টোবর মালটায় একটি বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় পাঁচজন নিহত হন। ১৯ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নেভাদা অঙ্গরাজ্যে একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে চারজন নিহত হন।
তবে বছরের সবচেয়ে বড় বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৯ নভেম্বর। ওই দিন ব্রাজিলের ফুটবল ক্লাব শ্যাপেকোয়েন্সের ফুটবলারসহ ৮১ যাত্রীবাহী বিমানের ৭৬ জন নিহত হন। বলিভিয়া থেকে বিমানটি কলম্বিয়ার মেডিলিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে বিধ্বস্ত হয়। কলম্বিয়ার আঞ্চলিক পুলিশ কমান্ডার জোস গ্যারারদো অ্যাসেভেদো জানান, বিধ্বস্ত বিমানের ছয় যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও পরে দুর্ভাগ্যবশত এদের একজন মারা যান।
চলতি মাসের শুরুতে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের (পিআইএ) ৪৭ যাত্রীবাহী একটি বিমান চিত্রাল থেকে ইসলামাবাদে যাওয়ার পথে বিধ্বস্ত হয়। পিআইর ফ্লাইট পিকে-৬৬১ এর যাত্রীবাহী বিমানটি ৭ ডিসেম্বর স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে ৩টায় চিত্রাল বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পর রাডারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন পড়ে। বিমানের সব আরোহীর মরদেহ উদ্ধার করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
১৮ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ায় বিমানবাহিনীর একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ১৩ জন নিহত হন। পরদিন রাশিয়ার একটি সামরিক বিমান সাইবেরিয়ার সাখা রিপাবলিক এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। বিমানটিতে ৩৯ জন আরোহী ছিলেন। ভয়াবহ ওই বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণে বেঁচে গেছেন বিমানের সব আরোহী।
এসঅাইএস/আরআইপি