আলোচিত ছিল রিজার্ভ চুরি ও তদন্ত রিপোর্ট
বিভিন্ন সময়ে একাধিক নেতিবাচক ঘটনায় বিশ্ব মিডিয়ার শিরোনাম হয়েছে বাংলাদেশ। তবে ২০১৬ সাল জুড়েই বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রভাবশালী মিডিয়ার অন্যতম শিরোনাম ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেম হ্যাক করে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে হ্যাকারদের ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি।
এ ঘটনার পরই চুরির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়।
বিশ্বের অন্যতম বড় সাইবার চুরির ১০ মাস পার হয়েছে। আর চুরির বিষয়ে সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে ছয় মাস আগে। তবে বারবার তারিখ নির্ধারণ করেও শেষ পর্যন্ত তা প্রকাশ করেনি সরকার। তাই তদন্ত প্রতিবেদন নিয়েও শিরোনাম হয় বারবার।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই), বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ও ইন্টারপোল যৌথভাবে তদন্ত করছে। ওই ঘটনার পর সাইবার হামলা প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী ব্যাংকিং খাতের নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর কথাও উঠছে।
এসব তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে যেসব সংবাদ গণমাধ্যমে এসেছে সেগুলোও বিদেশি পত্রপত্রিকার উদ্ধৃতি দিয়ে। ফলে এ ঘটনার জন্য প্রকৃত দোষী কারা তা যেমন জানা যাচ্ছে না, তেমনি তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থাও নেয়া যাচ্ছে না।
অন্যদিকে ঘটনা কি ঘটছে সে বিষয়ে সাধারণ মানুষ অন্ধকারে। ঘটনার দীর্ঘ সময় পার হলেও এখনো কেউই নিশ্চিত নয় কবে নাগাদ চুরি হয়ে যাওয়া অর্থ ফেরত পাওয়া যাবে।
গত ফেব্রুয়ারিতে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে সুইফট সিস্টেমে ভুয়া পরিশোধ অর্ডার পাঠিয়ে নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের রিজার্ভের চুরি করা প্রায় ১০ কোটি ডলারের মধ্যেি ৮ কোটি ১০ লাখ ফিলিপিন্সের ব্যাং ক রিজল কমার্শিয়াল ব্যাং কের (আরসিবিসি) একটি শাখা হয়ে জুয়ার বাজারে চলে যায়। তার মধ্যো এক ক্যা সিনো মালিকের ফেরত দেয়া দেড় কোটি ডলার বাংলাদেশকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।
এ ঘটনায় রিজল ব্যাংককে ২০ কোটি ডলার জরিমানা করেছে ফিলিপিন্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই জরিমানার অর্থ পরিশোধ করলেও বাংলাদেশকে বাকি অর্থ প্রদানে কোনো দায় নিতে নারাজ ব্যাংকটি।
এসবের পরিপ্রেক্ষিতে গত নভেম্বরে চুরির অর্থ উদ্ধারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নেতৃত্বে ফিলিপাইন যায় একটি প্রতিনিধি দল। তাদের কাছে বাংলাদেশ সরকারের করা প্রতিবেদনের কপি চায় আরসিবিসি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রতিবেদনটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তাই তাদের প্রতিবেদন দেয়া হবে না।
ফিলিপাইনে অবস্থানকালে তারা দেশটির একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে প্রতিনিধি দলটি। পরে দেশে ফিরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, ফিলিপাইন সরকারের মাধ্যামে হ্যাকিংয়ের অর্থ ফেরত দিতে আরসিবিসিকে বাধ্য্ করা যাবে।
একপর্যায়ে অর্থ উদ্ধারে প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের মামলা করার হুমকিও দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
এরই মধ্যেও সম্প্রতি রিজার্ভ চুরির ঘটনা তদন্তে সরকার গঠিত কমিটির প্রধান মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন জানান, এতে বাংলাদেশ ব্যাং কের কর্মকর্তাদের গাফিলতি ছিল বলে তারা প্রমাণ পেয়েছেন।
আর বাংলাদেশের সিআইডির অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ শাহ আলমের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে রয়টার্স জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তাও জড়িত বলে তারা মনে করছেন।
শাহ আলম বলেন, ওই কর্মকর্তারা জেনেশুনেই ব্যাংকের কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ঝুঁকির মধ্যে রেখেছিলেন, যাতে হ্যাকাররা নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে অর্থ চুরি করতে পারে।
সন্দেহভাজন ওই কর্মকর্তাদের নাম না বললেও তাদের শিগগিরই গ্রেফতার করা হবে বলে জানিয়েছেন সিআইডির এই কর্মকর্তা।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের রিজার্ভের চুরি হওয়া ৮১ মিলিয়ন ডলার ফিলিপাইনের যে ব্যাং ক থেকে জালিয়াতদের হাতে গেছে সেই রিজল কমার্শিয়াল ব্যাং ক বলছে, এ ঘটনায় তাদের কোনো দায় নেই, বাংলাদেশ ব্যাং কই দায়ী। তারা অন্যাায় কিছু করেনি।
ব্যাংকটির আইনজীবী থিয়ে দায়েপ সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েক কর্মকর্তার ইচ্ছাকৃত অবহেলার যে কথা বাংলাদেশি তদন্তকারী বলেছেন, তা আরসিবিসি এতদিন যা বলে আসছে তাকেই প্রমাণ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকাণ্ডই তাদের অর্থ হারানোর কারণ। ‘তারা (বাংলাদেশ) এর দায়ভার আরসিবিসির ওপর চাপাতে পারে না।’
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলায় বাংলাদেশ ব্যাং কের বিরুদ্ধে মামলা করা যায় কি না-আরসিবিসি তা খুঁজে দেখবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে রিজার্ভ চুরির বিষয়ে সরকারি তদন্ত কমিটির প্রধান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন গত মে মাসে প্রতিবেদন জমা দিলেও তা এখনও প্রকাশ করেনি সরকার। সম্প্রতি বিদেশি একটি গণমাধ্যম খবর দিয়েছে, তদন্তে রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকেরই পাঁচ কর্মকর্তার অবহেলা ও অসতর্কতাকে দায়ী করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে দায়ী কর্মকর্তাদের নাম উল্লেখ না করে শুধু বলা হয়েছে, তারা নিম্ন থেকে মধ্যম সারির কর্মকর্তা। সংগঠিত অপরাধের সঙ্গে সরাসরি কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও তারা অমনোযোগী, অসতর্ক ও পরোক্ষ সহযোগী ছিলেন।
তবে আলোচিত রিজার্ভ চুরির ঘটনায় এখনও ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এমইউএইচ/এমএমজেড/আরআইপি