দুর্গাপূজার একাল-সেকাল
অলোক আচার্য
শুভ মহালয়ার সুরের সাথে সাথেই বেজে উঠেছে দেবীর আগমনী বার্তা। শরৎ বিদায় নিয়ে প্রকৃতিতে এসেছে হেমন্ত। তবুও দুর্গাপূজাকে শারদীয় পূজাই বলা হয়। কারণ দেবীর আগমন শুরু হয়েছে মহালয়ার মধ্য দিয়ে শরৎকালেই। শারদ প্রাতে দেবীর আগমন ঘটে। শিউলি ফুলের বিছানো পথ মারিয়ে দেবী আসেন। শুরু হয়েছে দেবীপক্ষ।
দুর্গাপূজা মানেই উৎস-আনন্দের মুহূর্ত। বহুকাল ধরেই বাঙালির আবেগের জায়গার একটি দুর্গাপূজা। আগেও সেটাই ছিল, এখনো আছে। দুর্গাপূজা মানেই মনের গভীরে অগাধ টুকরো টুকরো স্মৃতি। পূজার উৎসব-আনন্দ সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। আনন্দের রকমফের আর কি! পূজা মানেই আনন্দ করা। তবে ছেলেবেলার পূজা আর আজকের অর্থাৎ বড়বেলার পূজার অনুভূতির মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। বয়সের কারণেই হয়তো।
পূজা মানেই নতুন জামা-কাপড় কেনা, ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, নাড়ু, মোয়া, মুড়কি বানানো। হিন্দুদের বাড়িতে বাড়িতে গুড় জ্বাল দেওয়ার মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসে। পূজার কয়েকদিন ধরে চলে খাওয়া-দাওয়ার উৎসব। খাবারগুলো কিন্তু বছরের অন্য সময় তৈরি হয় না। বাড়িতে বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনদের ভিড় লেগে থাকে।
দুর্গাপূজা বলতে আমার স্মৃতিতে জেগে আছে বাবার দেওয়া নতুন কাপড়। আমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। বছরে সেই পূজা উপলক্ষ্যেই কাপড়-চোপড় পেতাম। আমাদের সময়ে হাফপ্যান্টকে বলা হতো ইংলিশ প্যান্ট। তো সেগুলোই পেতাম বাবার কাছ থেকে। তখন এত রেডিমেট কাপড় পাওয়া যেত না। ফলে পূজার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই ছুটতাম দর্জির কাছে। বিস্তর মাপজোক দিয়ে আসতাম। তারপর অপেক্ষায় থাকতাম কবে দর্জির কাছ থেকে সেসব পাবো। আজ সন্তানদের জন্য যা করছি; সেটাই আমরা পেতাম। তাছাড়া জামা-জুতোও পেতাম। তবে বছরে ওই একবারই। এখানেই আকর্ষণটা বেশি ছিল। কারণ বছরে ওই একবারই নতুন কাপড় পাওয়ার যে আনন্দ, সেটি যোগ হতো পূজার সাথে। ঠিক এ কারণেই আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে থাকতো দুর্গাপূজা।
মা একেক দিন একেক ধরনের খাবারের আইটেম বানাতেন। আজ হয়তো নাড়িকেলের নাড়ু, তো কাল মুড়ির মোয়া। পূজার কয়েকদিন আমরা সকালে সেসব খেয়েই কাটাতাম। আলাদা কিছু রান্নাবান্না হতো না বাড়িতে। পূজার কয়েকদিন আগে থেকেই তার প্রস্তুতি চলতো। মায়ের সাথে আমিও নাড়ু, মোয়া বানাতাম। নারিকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু ছিল কমন। আর মুড়ির মোয়া, চিড়ার মোয়াও ছিল কমন। এছাড়া মিষ্টিসামগ্রী তৈরি হতো। অনেকদিন ধরে খেতাম।
পূজার দিনগুলোতে ঘোরাঘুরি ছিল সবচেয়ে বেশি আনন্দের। তবে আমার মনে হয়, একালের পূজায় আড়ম্বরতা বাড়লেও সেই ঐতিহ্য আর নেই। তখন পূজায় ঢাকের বাইরে কোনো বাদ্য থাকতো না। এখন পূজা মানেই বড় বড় ডিজে বক্স। উচ্চস্বরে শব্দ। হই-হুল্লোড় করা। এসব পূজার মূল আবহকে আড়াল করছে। মাত্র কয়েকটা দিন দেবী দুর্গা আমাদের মাঝে থাকবেন। দেবী দুর্গা সপরিবারে মর্ত্যে তার পিতৃগৃহে বেড়াতে এসেছেন। বিজয়া দশমীতে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে পূজার সমাপ্তি ঘটবে। দেবীর মূর্তি বিসর্জনের মধ্য দিয়ে বিদায় নিলেও ভক্তদের মনের গভীরে ঠিকই থেকে যান তিনি।
এখানে আরেকটি বিষয় হলো, বিজয়া দশমীর মেলা। বিসর্জনের দিনে এ মেলার আয়োজন করা হয়। বাবার হাত ধরে মেলায় যাওয়ার যে কী আনন্দ তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। সেসময় এখনকার মতো এত সব আধুনিক খেলনা পাওয়া যেত না। তখন নিদেনপক্ষে একটি প্লাস্টিকের চশমা, ঘড়ি, ক্যামেরা, কাঠের গাড়ি, টমটম, জিলাপি, মিষ্টি সাজ, পাপড় বা ঝুড়ি এসব কিনে বাড়ি ফিরতাম। সকালে আবার বন্ধুদের সামনে সেসব গায়ে চড়িয়ে বের হতাম। সবাই মিলে হৈ-হৈ করতাম।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। পূজা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। সনাতন ধর্মের আদি শক্তি দেবী দুর্গা। হিমালয়সম সিংহ তার বাহন। প্রলয়ংকরী সেই যুদ্ধে সিংহ বাহিনীও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। দশ হাতে দশ অস্ত্র নিয়ে দেবী অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। দেবী দুর্গা সমগ্র নারী শক্তির প্রতীক।
আমাদের ছোটবেলার চেয়ে এখন দুর্গাপূজার সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু বাড়েনি আতিথেয়তা, আনন্দ, উৎসবের মাতামাতি। রং পরিবর্তন হয়েছে ভিন্নভাবে। সনাতনী রূপ থেকে তা আধুনিক ডিজেতে পরিণত হয়েছে। পূজা তো শুধু আনন্দে মাতামাতি করার জন্যই নয়। এটি ধর্মীয় আবহের রূপও বটে। পরিবারসহ দেবী দুর্গার আগমন একটি ঐতিহাসিক কাহিনির প্রচলিত রূপ। দেবীর সঙ্গে আসেন কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতীও। দেবীর বাপের বাড়ি বেড়াতে আসা এবং বিদায় নেওয়া যেন বাংলার কোনো ঘরের মেয়ের নাইওর আসা আর বিদায়েরই স্বরূপ।
দুর্গাপূজা এলেই আমি বাবাকে খুঁজি। বাবার হাত খুঁজি। যে হাত ধরে আমি একদিন মেলায় যেতাম। আজও মেলায় যাই। আমার সন্তান আমার হাত ধরে থাকে। ওদের আনন্দ দেখে আমার বড় আনন্দ হয়। ভাবি, পরিবর্তন যতই আসুক, আনন্দ তো ঠিকই আছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
এসইউ/এএসএম