আল্লামা নেছারুদ্দীন রহমাতুল্লাহি আলাইহির জীবন ও কর্ম
১৭৫৭ খৃষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজুদ্দৌলার পতনের পর থেকে এদেশের ইসলামী তাহজিব, তমাদ্দুন ও আদর্শের অধঃপতন শুরু হয়। বিশেষ করে উপমহাদেশের মুসলমানগণ বর্ণনাতীত লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার শিকার হন। ক্রমেই অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে মুসলমানগণ তাদের স্বকীয় কৃষ্টি ও সভ্যতা ভুলে অধঃপতনের গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার উপক্রম। মুসলমানদের ক্রান্তিলগ্নের এমনি এক সময়ে আগমন ঘটে যুগ শ্রেষ্ঠ আলেমে দ্বীন শাহ ছুফি নেছারুদ্দীন আহমদ রহমাতুল্লাহি আলাইহির।
জন্মকাল ও স্থান
সামাজিক এই অবক্ষয়ের সময় জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে অবিভক্ত বাংলার অন্তর্গত তৎকালীন বরিশাল (বাখেরগঞ্জ) জেলাধীন (বর্তমানে পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ থানা) ছারছীনা গ্রামে জন্ম নিলেন যুগশ্রেষ্ঠ ওলিয়ে কামিল, হযরত আল্লামা মাওলানা নেছারুদ্দীন আহমদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি।
তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ছারছীনা দরবার উপমহাদেশের শরিয়ত ও মারেফতের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র। তিনি ইলমে শরিয়তের একজন অতিউঁচু স্তরের মুহাক্কিক আলেম এবং ইলমে মারেফতেরও একজন অতি উচ্চ মকামের বুজুর্গ ব্যক্তি।
শৈশব কাল
শৈশব কাল হইতে নেছারুদ্দীন আহমদ ছিলেন ব্যতিক্রমী। খেলাধুলা হাসি-তামাসা আনন্দ ফুর্তি-করে সময় কাটানো তিনি আদৌ পছন্দ করতেন না। নিজ গ্রামের পাঠশালায়ই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার হাতে খড়ি। অল্প বয়সেই তিনি সরল, সুবোধ ও দারুন ধর্মভীরু বলিয়া পরিচিত হয়ে উঠেন। লেখাপড়ায় মনোযোগী ধীর-স্থির ও অধ্যাবসায় এবং ধর্মানুরাগী ছিলেন। শিশুসুলভ যে সকল অভ্যাস সাধারণত: শিশুদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় বালক নেছারুদ্দীন আহমদ এর জীবনে সেইগুলো প্রায়ই অনুপস্থিত ছিল।
বাল্য বয়সেই বিবাহ ও পিতৃবিয়োগ
নেছারুদ্দীন আহমদ এর বয়স যখন বার (১২) বৎসরে উপনীত হন। তখন তাঁর পিতা হাজী সদরুদ্দীন সাহেব হজে যাওয়ার মনস্থ করেন। একমাত্র ছেলেকে রেখে হজে যাওয়ার প্রাক্কালে তাঁকে বিবাহ দিয়ে যাওয়ার মনস্থ করেন। সে মতে প্রতিবেশী এক বিশিষ্ট পরিবারের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব দলীলুদ্দীন সিকদারের কন্যা ছাহেরা খাতুনকে পুত্রবধু করে ঘরে আনেন। পুত্রের বিবাহ কার্য সমাধা করে ছদরুদ্দীন সাহেব হজে চলে যান। হজ পরবর্তী সময়ে সদরুদ্দীন সাহেব আর দেশে ফেরেননি। পবিত্র মক্কা শরীফে তিনি ইন্তেকাল করেন ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’। তখনও তাঁর দাদা জহির উদ্দিন রহমাতুল্লাহি আলাইহি জীবিত ছিলেন।
মায়ের প্রেরণায় শিক্ষা জীবনের শুরু
স্বামীর মৃত্যুর পর বালক নেছারউদ্দীনের মহিয়সী জননী জোহরা খাতুন সাহসিকতার সঙ্গে পুত্রের শিক্ষার জন্য উদ্যোগী হন। আজ হতে প্রায় দেড়শত বৎসর পূর্বে বাংলার নিভৃত পল্লী গ্রামের একটি সাধারণ পরিবারের মহিলা তাহার পিতৃহীন একমাত্র পুত্রকে উৎসাহ দিয়ে ইলম শিক্ষার জন্য বাড়ির বাহিরে প্রেরণ করা এক মহাকঠিন কাজই ছিল বটে।
শিক্ষা জীবন
ইসলামি জ্ঞানার্জনের তাগিতে তিনি প্রথম মাদারীপুর গমণ করেন। বর্তমানে মাদারীপুর একটি জেলা হলেও তখনকার দিনে মাদারীপুর ছিল একটি মহকুমা মাত্র। গোটা বরিশাল জেলায় একটি মাদরাসাও ছিল না। মাদারীপুরের সন্নিকটে ইসলামিয়া মাদরাসায় তিনি প্রাথমিক পড়া শেষ করেন।
মাদারীপুর হতে ঢাকায় গমন
মাদারীপুর থেকে দাখিল (এস.এস.সি) পাশ করে নেছারউদ্দীন আহমদ ঢাকায় হাম্মাদিয়া মাদরাসায় আলিম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই মাদরাসায় কতদিন ছিলেন এবং কোন পর্যন্ত পড়াশুনা করে ছিলেন, তাহা নিশ্চিতরূপে জানা যায় নাই।
ঢাকা হইতে কলকাতায় গমন
ঢাকা হইতে তিনি কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হয়েছিলেন। কলকাতার এই আলিয়া মাদ্রাসায় নেছারুদ্দীন আহমদ কতদিন অধ্যয়ন করেছেন তাহাও সঠিকরূপে জানা যায় নাই। তবে এই মাদরাসায়ও তিনি দীর্ঘদিন লেখাপড়া করেন নাই। এর পর হুগলী মাদরাসায় ভর্তি হয়ে নেছারুদ্দীন আহমদ লেখাপড়া শেষ করেন।
তরিকায় ছবক গ্রহণ ও খিলাফাত লাভ
তৎকালীন সময়ের অন্যতম ইসলামি চিন্তাবিদ আধ্যাত্মিক রাহবার হযরত মাওলানা শাহ্ ছুফী আব্দুল্লাহ ওরফে মোহাম্মদ আবু বকর ছিদ্দিকী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি হুগলি পাশে পাশ্ববর্তী অঞ্চলে একটি জলসায় আসেন। সেখানে নেছারুদ্দীন আহমদ বিশেষ আগ্রহ নিয়ে ওয়াজ শুনিতে গেলেন। মাগরিবের নামাজবাদ নেছারুদ্দীন আহমদ মাহফিলের সামনে বসলে হজরত আবু বকর ছিদ্দিকী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁকে দেখতে পান এবং অনেক ঘটনার পর তিনি হজরত আবু বকর ছিদ্দিকী রহমাতুল্লাহি আলাইহির নিকট বায়াত গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তাঁর নিকট থেকেই খিলাফাত লাভ করেন।
মক্কা শরীফ হিজরত
তিনি খিলাফাত লাভের পর নিজ মাতৃগৃহে ফিরে আসেন। দেশে আসার পর তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। রোগোক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই তিনি মক্কা শরীফ যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। রোগ মুক্তির পর তিনি মক্কা শরীফে হিজরত করিবার দৃঢ় সংকল্প করেন। মাতা, স্ত্রী ও জেষ্ঠ্য পুত্র এবং ছোট ভগ্নিপতিসহ জাহাজ যোগে হজব্রত পালনে পবিত্র মক্কা শরীফ গমন করেন। মক্কা শরীফ অবস্থানকালে তাঁর স্ত্রী ছাহেরা খাতুন ও বড় পুত্র শাহ মোহাম্মদ মুজাহার ইন্তেকাল করেন। এই ঘটনার পর মায়ের পরামর্শে হজপর্ব শেষ করে মাকে নিয়া দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। নেছারুদ্দীন আহমদ পবিত্র মক্কা শরীফ হতে দেশে ফিরে নিজ মোরশেদের সহচর্যে চলে যান। তাঁর অনুমতি নিয়ে তিনি দ্বীন-ইসলামের খেদমতে ব্রতী হন।
ইসলামের খেদমতে আত্ম-নিয়োগ
এই মহান মুর্শিদ তালিম ও তরবিয়াত দিয়ে যেমন একদল খলীফা তথা দ্বীনের কামেল সেবক তৈরি করে গেছেন তেমনি দেশের বিভিন্ন স্থানে ইলমে দ্বীনের মাদ্রাসা ও ইলমে তাসাউফের অগণিত খানকা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। মোট কথা, দেশের সর্বত্র বিশেষ করে দক্ষিণ বাংলায় তিনি দ্বীনের পুনর্জাগরণ সৃষ্টি করে গেছেন। যার আলো ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বাংলাদেশের অলিতে-গলিতে। নিজের জীবনে এবং তাঁর অনুগামী ও অনুসারীদের পরিপূর্ন রূপে সুন্নাতে নববির ইত্তেবায় গঠন করতে আজীবন মহা সাধনা করে গেছেন।
লেবাস, পোষাক, চাল-চলন, খাওয়া-দাওয়া, আমল-আখলাক, লেনদেন, মোয়ামালাত-মোয়াশারাত-এক কথায় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি কাজে সুন্নাতের পাবন্দিতে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর ও আপোসহীন। ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাতে মুআক্কাদাতো বটেই, এমনকি নফল, মোস্তাহাব ও মোস্তাহসানও তরক করা থেকে বিরত থাকতেন তিনি এবং তাঁর অনুসারীদেরকেও এ বিষয়গুলোর ব্যাপারে কঠোর তাগিদ দিতেন। তিনি ছিলেন শিরক-বিদাআত ও কুসংস্কার নির্মূলের এক সংগ্রামী মর্দে মুজাহিদ, কঠোর সাধক, আবেদ, জাহেদ, মহান সুফী দরবেশ।
মানুষের মাঝে ইলমে দ্বীনের প্রচারের পাশাপাশি লেখালেখির কাজও করেন। তাঁর রচিত মাসআলা-মাসাইলের প্রসিদ্ধ কিতাব হলো- তরিকুল ইসলাম। এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা হলো ‘পাক্ষিক তাবলীগ’।
ইন্তেকাল
১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি (ইফা), আবার কেউ কেউ বলেন ১৯৫২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার মোতাবেক মাঘ মাসের ১৬ তারিখ রাত ৯-৪৫ মিনিটে ৮৭ বৎসর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আল্লাহ তাআলা তাঁকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন। আমাদেরকেও তাঁর জীবনের উত্তম ও হক কথা ও আমলগুলো আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমএস