ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ধর্ম

সুতরাহ রেখে নামাজ পড়ার নির্দেশ ও প্রয়োজনীয়তা

ধর্ম ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৬:৫১ পিএম, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১

নামাজের সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া নিষিদ্ধ ও গুনাহের কাজ। নামাজের সামনে দিয়ে হাঁটার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার উপায় হচ্ছে সুতরাহ ব্যবহার করা। নামাজে অংশগ্রহণকারী ইমাম-মুক্তাদির জন্য সুতরাহ রেখে নামাজ পড়া জরুরি। কেননা সুতরাহ ছাড়া নামাজের সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া, চলাফেরা করাকে ইসলাম নিষিদ্ধ ও গুনাহের কাজ বলে ঘোষণা করেছে। নামাজে সুতরাহ ব্যবহার সম্পর্কে ইসলামের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। সুতরাং সম্পর্কে মানুষের রয়েছে অনেক জিজ্ঞাসা। সেগুলো কী?

সুতরাহ কী?

সুতরাহ শব্দটি আরবি। এর অর্থ হলো আড়াল। অর্থাৎ নামাজের সময় ব্যবহৃত একটি বস্তু। নামাজ পড়াকালীন সময়ে ইমাম কিংবা একা একা নামাজ পড়া ব্যক্তির সামনে রাখা হয়। যাতে তাদের সামনে দিয়ে হাঁটা চলায় নামাজি ব্যক্তি আড়াল করা হয়।

সুতরাহ রেখে নামাজ পড়ার নির্দেশ

নামাজির সামনে দিয়ে কেউ চলাফেরা করতে পারে, এমন সম্ভাবনা থাকলে সামনে সুতরাহ রেখে নামাজ পড়া ওয়াজিব। তা হতে পারে সফরে, বাড়িতে, মসজিদে একাকি কিংবা ইমামের সঙ্গে নামাজ আদায়ে। সর্বাবস্থায় সুতরাহ ব্যবহার করা জরুরি। হাদিসে এসেছে-

১. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সুতরাহ ছাড়া নামাজ পড়ো না।’ (ইবনে খুজাইমাহ)

২. অন্য হাদিসে এসেছে- ‘যে ব্যক্তি সক্ষম হয় যে, তার ও কেবলার মাঝে কেউ যেন না আসে; তাহলে সে যেন তা করে (সুতরাহ রেখে নামাজ পড়ে)।’ (মুসনাদে আহমাদ, দারাকুতনি, তাবারানি)

৩. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ নামাজ পড়বে, তখন সে যেন সামনে সুতরাহ রেখে নামাজ পড়ে।’ (মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে হিব্বান, মুসতাদরাকে হাকেম)

হাদিসের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী সুতরাহ রেখে নামাজ না পড়া গুনাহের কাজ। ইবনে হাজার আসকালানি ফাতহুল বারিতে উল্লেখ করেন, সুতরাহ না থাকা অবস্থায় কোনো নামাজির সামনে দিয়ে কেউ পার হয়ে গেলে তার নামাজের সাওয়াব কম হয়ে যায়।’

সুতরাহ ধরন কেমন হবে?

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বিভিন্ন ধরনের সুতরাহ প্রমাণিত। যেমন-

১. কখনো তিনি মসজিদের থাম সামনে করে নামাজ পড়তেন।

২.  ফাঁকা ময়দানে নামাজ পড়লে এবং আড়াল করার জন্য কিছু না পেলে সামনে বর্শা গেড়ে নিতেন। আর লোকেরা তাঁর পেছনে বিনা সুতরায় নামাজ পড়তো।’ (বুখারি)

৩. কখনো বা নিজের বাহন উট আড়াআড়ি দাঁড় করিয়ে তাকে সুতরাহ বানিয়ে নামাজ পড়তেন। (বুখারি, মুসনাদে আহমাদ)

৪. কখনো জিনপোশ (উটের পিঠে বসবার আসন) কে সামনে রেখে তার কাষ্ঠাংশের সোজাসুজি নামাজ পড়তেন। (বুখারি, মুসলিম, ইবনে খুজাইমাহ, মুসনাদে আহামদ)

৫. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলতেন, ‘তোমাদের কেউ যখন তার সামনে জিনপোশের শেষে সংযুক্ত কাঠখণ্ডের মতো কিছু রেখে নেয়, তখন তার উচিত, (তার পশ্চাতে) নামাজ পড়া এবং এরপর তার সামনে দিয়ে কেউ পার হলে কোনো পরোয়া না করা।’ (মুসলিম, আবু দাউদ)

৬. একবার তিনি একটি গাছকে সুতরাহ বানিয়ে নামাজ পড়েছেন।’ (নাসাঈ, মুসনাদে আহমাদ)

৭. কখনো তিনি হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার খাটকে সামনে রেখে নামাজ পড়েছেন। ওই সময় আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তার উপর চাদর ঢাকা দিয়ে শুয়ে থাকতেন। (বুখারি, মুসলিম)

সুতরাহ কত দূরে রাখতে হবে?

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যখন নামাজ পড়বে, তখন সে যেন সামনে সুতরাহ রেখে নামাজ পড়ে এবং তার নিকটবর্তী হয়। যাতে শয়তান যেন তার নামাজকে নষ্ট করে না দিতে পারে।’ (মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে হিব্বান, মুস্তাদরাকে হাকেম)

কিন্তু এ সুতরাহ কতটুকু দূরত্বে দিতে হবে?

সুতরাহ কমপক্ষে তিন হাত বা এর কম দূরত্বে সামনে রেখে নামাজ পড়তে হবে। এর উচ্চতা কমপক্ষে এক হাত হতে হবে। আর পাশে যে কোনো পরিমাণ হতে পারে। হাদিসে পাকে এসেছে-

১. একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবা শরিফের ভেতরে নামাজ পড়লে তাঁর ও দেয়ালের মাঝে ৩ হাত ব্যবধান ছিল।’ (বুখারি, মুসনাদে আহমাদ, নাসাঈ)

২. তাঁর মুসাল্লা (সেজদার জায়গা) ও দেয়ালের (সুতরাহর) মাঝে একটি ছাগল (অথবা ভেঁড়া) পার হয়ে যাওয়ার মতো (প্রায় আধাহাত) ফাঁক বা দূরত্ব থাকতো।’ (বুখারি, মুসলিম)

ইমামের সুতরাহই কি মুক্তাদির জন্য যথেষ্ট?

ইমামের সামনে সুতরাহ থাকলে মুক্তাদির জন্য আলাদা সুতরার দরকার হয় না। ইমামের সুতরাহ মুক্তাদির জন্য যথেষ্ট। হাদিসে এসেছে-

১. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের দিন নামাজ পড়তে বের হলে তাঁর সামনে বর্শা গাড়া হতো। তিনি তা সুতরাহ বানিয়ে নামাজ পড়তেন এবং লোকেরা তাঁর পেছনে (বিনা সুতরায়) নামাজ পড়তো।’ (বুখারি, মুসলিম)

২. একবার তিনি বাত্বহায় নামাজ পড়লেন। তাঁর সামনে (সুতরাহ) ছিল ছোট একটি বর্শা। তাঁর সামনে দিয়ে নারী ও গাধা পার হয়ে যাচ্ছিল।’ (বুখারি, মুসলিম)

৩. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজের সময় মিনায় নামাজ পড়ছিলেন। তখন হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু একটি গাধীর পিঠে চড়ে কিছু কাতারের সামনে দিয়ে অতিক্রম করে সামনে এসে নামলেন। এরপর গাধীটি চরতে ছেড়ে দিয়ে কাতারে শামিল হলেন। তা দেখে কেউ তাঁর প্রতিবাদ করেনি।’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)

সুতরাহ ছাড়া নামাজির সামনে দিয়ে যাওয়া হারাম

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে নামাজির সামনে বেয়ে পার হয়, সে যদি জানত যে, এতে তার কত পাপ হবে; তাহলে সে ৪০ (বছর বা মাস বা দিন নামাজির সালাম ফেরার) অপেক্ষা করাকে ভালো মনে করতো, তবুও নামাজির সামনে বেয়ে অতিক্রম করতো না।’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)

তবে মাজমূ ফাতাওয়া ইবনে বায রাহিমাহুল্রাহ বলেন, নামাজির সামনে সুতরা থাকলে পার হওয়া হারাম বা গুনাহের কাজ নয়। সুতরাহ না থাকলেও যদি বরাবর নামাজির প্রায় ৩ হাত দূর থেকে পার হয়, তাহলেও গুনাহ হবে না।’

কেউ সামনে দিয়ে গেলে নামাজির কর্তব্য

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ সামনে সুতরাহ রেখে নামাজ পড়লে এবং কেউ তার সেই সুতরার ভেতর দিয়ে পার হতে চাইলে সে যেন তার বুকে ঠেলে পার হতে বাধা দেয় এবং যথাসম্ভব রুখতে চেষ্টা করে।’

অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘তাকে যেন দুই দুই বার বাধা দেয়া হয়। এরপরও যদি সে মানতে না চায় (এবং সেই দিকে পার হতেই চায়) তবে সে যেন তার সঙ্গে লড়াই করে। কারণ, (বাধাদান সত্ত্বেও যে বাধা মানে না) সে তো শয়তান।’ (বুখারি, মুসলিম, ইবনে খুজাইমাহ, মিশকাত)

অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সুতরাহ ছাড়া নামাজ পড়ো না। কাউকে তোমার সামনে বেয়ে পার হতেও দিও না। (সুতরার ভেতর বেয়ে যেতে) সে যদি বাধা না মানে, তবে তার সঙ্গে লড়াই কর। কারণ, তার সঙ্গে শয়তান আছে।’ (ইবনে খুজাইমাহ)

প্রসঙ্গে একটি ঘটনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ

হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু জুমআর দিন একটি থামকে (পিলার) সুতরাহ করে নামাজ পড়ছিলেন। এমন সময় বনি উমাইয়া গোত্রের এক ব্যক্তি তাঁর ও থামের মাঝ দিয়ে বেয়ে পার হতে গেলে তিনি তাকে বাধা দেন। কিন্তু লোকটি পুনরায় পার হওয়ার চেষ্টা করে। তিনি তার বুকে এক থাপ্পড় দেন। লোকটি মদিনার গভর্নর মারওয়ানের কাছে তাঁর (আবু সাঈদ খুদরির) বিরুদ্ধে নালিশ জানায়।

মারওয়ান হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন, ‘আপনি আপনার ভাইয়ের ছেলেকে মেরেছেন কী কারণে?’

হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যখন কিছুকে সুতরাহ বানিয়ে নামাজ পড়ে, এরপর কেউ যদি তার সেই সুতরার ভেতর দিয়ে পার হতে চায়, তবে সে যেন তাকে বাধা দেয়। এতেও যদি সে না মানে, তাহলে সে যেন তার সঙ্গে লড়াই করে। কারণ, সে তো শয়তান।’ সুতরাং আমি তো শয়তানকেই মেরেছি!’ (ইবনে খুজাইমাহ)

পশু পার হতে চাইলে

শুধু মানুষই নয়, যদি সুতরাহ ও নামাজির মধ্যে দিয়ে কোনো পশুও বেয়ে পার হতে উদ্যত হয় তবে পশুকেও বাধা দেওয়া উচিত। হাদিসে এসেছে-

হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজ পড়ছিলেন। এমন সময় একটি ছাগল (বা ভেঁড়া) তাঁর সামনে দিয়ে ছুটে পার হতে উদ্যত হয়। কিন্তু তিনি তার আগেই তাকে ধরে ফেললেন। এমনকি তার পেটকে দেয়ালের সঙ্গে লাগিয়ে দিলেন। এরপর ছাগলটি (বা ভেঁড়া) তাঁর পেছন দিক থেকে পার হয়ে গেল।’ (আবু দাউদ, ইবনে খুজাইমা, মুস্তাদরাকে হাকেম)

বিনা সুতরায় কি নামাজ বাতিল হবে?

সুতরাহ রেখে নামাজ পড়া আবশ্যক। তাই সুতরাহ রেখে নামাজ পড়লে এবং তার পেছন দিয়ে কেউ কেউ পার হয়ে গেলে নামাজির নামাজে কোনো ক্ষতি হয় না। (বুখারি, মুসলিম)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘‘(সুতরাহ না থাকলে) প্রাপ্তবয়স্কা মেয়ে, গাধা ও কালো কুকুর নামাজ নষ্ট করে ফেলে।’ হজরত আবু যার রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! হলুদ ও লাল না হয়ে কালো কুকুরেই নামাজ নষ্ট করে; তার কারণ কি?’ তিনি বললেন, ‘কারণ, কালো কুকুর শয়তান।’ (মুসলিম, আবু দাউদ, ইবনে খুজাইমাহ)

নাবালিকা মেয়ে অতিক্রম করলে নামাজ নষ্ট হয় না। এক দিন বনি আব্দুল মুত্তালিবের দুটি ছোট্ট মেয়ে মারামারি করতে করতে তাঁর সামনে এসে তাঁর হাঁটু ধরে ফেলল। তিনি উভয়কে দু’দিকে সরিয়ে দিলেন। আর এতে তিনি নামাজ ভাঙলেন না।’ (আবু দাউদ, নাসাঈ)

সুতরার ভেতর দিয়েও কোনো পুরুষ, শিশু বা পশু পার হয়ে গেলে নামাজির মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে ঠিকই, তবে নামাজ একেবারে নষ্ট হয়ে যায় না। কিন্তু বিনা সুতরায় নামাজ পড়লে এবং সামনে দিয়ে প্রাপ্তবয়স্কা মেয়ে, গাধা বা মিশমিশে কালো কুকুর পার হয়ে গেলে নামাজ বাতিল হয়ে যায়।

সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, ঘরে, সফরে, মসজিদে যেখানেই নামাজ পড়বে; সেখানে সুতরাহ রেখে নামাজ পড়বে। কেননা সুতরাহ রেখে নামাজ পড়া ওয়াজিব। তাই নামাজের ক্ষেত্রে সুতরাহ রেখে নামাজের প্রতি যত্নবান হওয়াও আবশ্যক। আবার নামাজের সামনে দিয়ে যেতে হলে সুতরাহ আছে কিনা তা দেখে যাওয়া। সুতরাহ না থাকলে প্রয়োজনে সুতরাহ দিয়ে তারপর অতিক্রম করা।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে নামাজ শুরু করার আগে সুতরাহ ব্যবহার করার তাওফিক দান করুন। হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএমএস/জিকেএস

আরও পড়ুন