আরবি নতুন বছর হোক কল্যাণময়
শুরু হলো আরবি নতুন বছর ১৪৪৩ হিজরি। নতুন বছরের ফজিলতপূর্ণ ও কল্যাণময় মাস মহররমের প্রথম দিন আজ। মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় সব আচার–অনুষ্ঠান, উৎসবের তারিখ নির্ধারণ ও ইবাদত-বন্দেগি পালন তথা তাহজিব-তমদ্দুন লালন হিজরি বছরের চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল। এ কারণেই মুমিন মুসলমানের জীবনে হিজরি সনের গুরুত্ব অপরিসীম।
৩৫৪ কিংবা ৩৫৫ দিন-রাতে চাঁদের আবর্তনে সীমাবদ্ধ হিজরি সন। সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর আবর্তনের সময়কালকে সৌরবর্ষ এবং পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের আবর্তনের সময়কালকে চন্দ্রবর্ষ বলা হয়। আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে চন্দ্র-সূর্যের এ আবর্তনের কথাও তুলে ধরেছেন এভাবে-
الشَّمْسُ وَالْقَمَرُ بِحُسْبَانٍ
‘সূর্য ও চন্দ্র হিসাবমত চলে।’ (সুরা আর-রহমান : আয়াত ৫)
হিজরি বছরের প্রতিটি দিনক্ষণ ও মাস যেন কল্যাণময় হয়; সে জন্য প্রত্যেক মাসের নতুন চাঁদ দেখলেই বিশ্বনবি নিজে এ দোয়া পড়তেন এবং উম্মতে মোহাম্মাদিকে কল্যাণের এ দোয়া পড়তে বলেছেন। তাহলো-
اَللَّهُمَّ أَهِلَّهُ عَلَيْنَا بِالْأَمْنِ وَ الْاِيْمَانِ وَالسَّلَامَةِ وَ الْاِسْلَامِ وَ التَّوْفِيْقِ لِمَا تُحِبُّ وَ تَرْضَى رَبُّنَا وَ رَبُّكَ الله
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমানি ওয়াল ঈমানি, ওয়াস সালামাতি ওয়াল ইসলামি- রাব্বি ওয়া রাব্বুকাল্লাহ।’
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাদের জন্য এই চাঁদকে নিরাপত্তা, ঈমান, শান্তি এবং ইসলামের সঙ্গে উদিত করুন। (হে চাঁদ) আল্লাহই আমার ও তোমার রব।’ (তিরমিজি)
ইসলামি শরিয়তের ফিকহি বিধানগুলোতে বছর বলতে এ চন্দ্রবর্ষকেই বোঝানো হয়। হিজরি বছরের হিসাব রাখার গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা হিজরি বছরজুড়ে নির্ধারিত তারিখে আত্মশুদ্ধি, ইবাদত-বন্দেগি ও দোয়া কবুলের অনেক মুহূর্ত, দিন-রাত ও মাসের হিসাবের বিষয় রয়েছে। নির্ধারিত এসব তারিখে মুসলিম উম্মাহ নফল ও ফরজ রোজা-নামাজ, ঈদ, কুরবানি, ওমরাহ-হজ পালন ও জাকাতসহ গুরুত্বপূর্ণ বিধান পালন করে থাকে।
হিজরি বছরের এসব গুরুত্ব উপলব্দি করেই হজরত আবু মুসা আশআরি রাদিয়াল্লাহু আনহু তাগিদে খলিফাতুল মুসলিমিন হজরত ওমরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হিজরি সন গণনা ব্যবস্থা করেন। তাঁকে এ কাজে সহযোগিতা করেন হজরত আলি ও হজরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু। হিজরি বছরের হিসাব রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের সময় থেকে গণনার পরামর্শ দেন হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু। আর সম্মানিত মাস মহররমকে হিজরি বছরের প্রথম রাখার প্রস্তাব দেন হজরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু। সে মোতাবেক ১৬ হিজরির ১০ শাবান মাস মোতাবেক ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে দাপ্তরিকভাবে হিজরি সন গণনার ব্যবস্থা করেন হজরত ওমরা রাদিয়াল্লাহু আনহু।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরি বছরের গণনায় প্রত্যেক মাসেই কিছু দিন ও সময়ের ইবাদত-বন্দেগিকে ফজিলতপূর্ণ ও কল্যাণময় বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কল্যাণময় দিনগুলোর মধ্যে অন্যতম-
১.মহররম
> এ মাসের ৯-১০ তারিখ রোজা পালন করা ফজিলতপূর্ণ।
> মহররমের ১৩-১৫ তারিখ আইয়্যামে বিজের রোজা পালন।
২. সফর
> এ মাসের ১৩-১৫ তারিখ আইয়্যামে বিজের রোজা পালন।
> সফর মাসেই মুসলিম উম্মাহ উদযাপন করেন আকেরি চাহর সোম্বা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সফর মাসের শেষ দিকে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে যান। সফর মাসের শেষ বুধবার তিনি অনেকটাই সুস্থতা লাভ করেন। এ খুশিতে অনেক সাহাবি বিভিন্নভাবে দান-সাদকা করেছেন। এ দান-সাদকা নিঃসন্দেহে উত্তম কাজ। এ উপলক্ষ্যে সফর মাসের শেষ বুধবার উদযাপিত হয় আখেরি চাহর সোম্বা।
৩. রবিউল আউয়াল
> বিশ্বনবির সীরাত তা আদর্শে উজ্জীবিত হওয়ার মাস। ১২ রবিউল আউয়াল রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশব্যাপী পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি উদযাপিত হয়।
> রবিউল আউয়ালের ১৩-১৫ তারিখে রয়েছে আইয়ামে বিজের রোজা।
৪. রবিউস সানি
> এ মাসের ১৩-১৫ তারিখে রয়েছে আইয়ামে বিজের রোজা।
> রবিউস সানি মাসেও ফাতেহা-ই ইয়াজদহম উপলক্ষে রাষ্ট্রীয়ভোবে ঐচ্ছিক ছুটি থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের অনেকেই এ দিনটি গুরুত্বসহকারে উদযাপন করে থাকেন। ‘ইয়াজদাহম’ অর্থ এগারো, আর ‘ফাতিহা’ অর্থ দোয়া করা। মহান আল্লাহ তায়ালার ওলি বড় পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানী (র.)-এর মৃত্যু দিবস উপলক্ষে মুসলিমদের দোয়া অনুষ্ঠানই হচ্ছে ‘ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম’।
৫. জমাদিউল উলা
> এ মাসেরও ১৩-১৫ তারিখ আইয়ামের বিজের রোজা রাখা বিশ্বনবির অন্যতম আমল।
৬. জমাদিউস সানি
> ইবাদত-বন্দেগির প্রস্তুতি নেওয়ার মাস। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রজব থেকে ইবাদত-বন্দেগিতে আত্মনিয়োগ করতেন। রজবের বরকত লাভের জন্য দোয়াও করতেন।
> এ মাসের ১৩-১৫ তারিখ আইয়ামে বিজের রোজাও বিশ্বনবির গুরুত্বপূর্ণ আমল।
৭. রজব
মর্যাদাপূর্ণ ও সম্মানিত ৪ মাসের একটি হলো রজব মাস। ইবাদত-বন্দেগি ও বরকত লাভের মাস রজব। এ মাসে আল্লাহ তাআলা যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রক্তপাতকে নিষিদ্ধ করেছেন। এ মাসে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর কাছে এভাবে বরকতময় দোয়া করতেন-
اَللهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِىْ رَجَبَ وَ شَعْبَانَ وَ بَلِّغْنَا رَمَضَانَ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা বারাকলানা ফি রাজাবা ওয়া শা’বান ওয়া বাল্লিগনা রামাদান।’
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আপনি রজব ও শা’বান মাসকে আমাদের জন্য বরকতময় করুন এবং আমাদেরকে রমজান মাস পর্যন্ত (হায়াত দিন) পৌঁছে দিন।’
> এ মাসেও ১৩-১৫ তারিখ আইয়ামে বিজের রোজা রাখা।
৮. শাবান
> এ মাস জুড়েও বিশ্বনবি আল্লাহর কাছে বরকত লাভের দোয়া করতেন-
اَللهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِىْ شَعْبَانَ وَ بَلِّغْنَا رَمَضَانَ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা বারাকলানা ফি শা’বান ওয়া বাল্লিগনা রামাদান।’
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আপনি শা’বান মাসকে আমাদের জন্য বরকতময় করুন এবং আমাদেরকে রমজান মাস পর্যন্ত (হায়াত দিন) পৌঁছে দিন।’
> শাবান মাসের ১৩-১৫ তারিখ তিন দিন আইয়ামে বিজের রোজা নির্ধারিত।
৯. রমজান
ইবাদতের বসন্তকাল রমজান। রহমত বরকত মাগফেরাত ও নাজাতের মাস এটি। পুরো মাসজুড়ে ফরজ রোজা পালন করার নির্দেশ দিয়েছেন মহান। যে ব্যক্তি এমাসটি পাবেন তিনিই রোজা পালন করবেন।
এ মাসের গুরুত্বপূর্ণ দশক হচ্ছে শেষ দশক। যে দশকে রয়েছে লাইলাতুল কদর। যে রাতটি হাজার মাসের চেয়েও বরকতময়।
১০. শাওয়াল
ঈদের মাস শাওয়াল। এ মাসের প্রথম রাতটি অনেক মর্যাদার। এ মাসের ঈদ উদযাপনের পরপরই ৬ রোজার রাখার গুরুত্ব ও ফজিলত অনেক বেশি। সঙ্গে নিয়মিত রোজা আইয়ামে বিজের তিনটি রোজাতো আছেই।
১১. জিলকদ
হজের প্রস্তুতির মাস জিলকদ। এ মাসটি সম্মানিত ৪ মাসের একটি। এ মাসের সম্মানে যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রক্তাপাতি নিষিদ্ধের মাস। এ মাসের প্রতিটি মুহূর্তই ফজিলতপূর্ণ।
১২. জিলহজ
ইয়াওমে আরাফা, হজ ও কুরবানির মাস জিলহজ। এ মাসের প্রথম ৯ দিন রোজা রাখার গুরুত্ব ও ফজিলত অনেক বেশি।
আজ থেকেই শুরু হলো হিজরি নতুন বছর। নতুন বছরে নতুন চাঁদে বছরটি কল্যাণময় হতে আল্লাহর সাহায্য কামনার বিকল্প নেই। মুসলিম উম্মাহ নিজেদের কল্যাণ লাভে বছরের শুরু থেকে পড়তে পারে এ দোয়া-
‘ইয়া মুকাল্লিবাল কুলুবি ওয়াল আবছার, ইয়া মুদাব্বিরাল্লাইলি ওয়ান্নাহার; ইয়া মুহাওয়িলাল হাওলি ওয়াল আহওয়াল, হাওয়িল হালানা ইলা আহ্ছানিল হাল।’
অর্থ : ‘হে অন্তরসমূহ ও দৃষ্টিসমূহ পরিবর্তনকারী! হে রাত ও দিনের আবর্তনকারী! হে সময় ও অবস্থা বিবর্তনকারী! আমাদের অবস্থা ভালোর দিকে উন্নীত করুন।’ (দিওয়ানে আলী, আন নাহজুল বালাগা)
সুতরাং তাওবাহ ও ইসতেগফারের মাধ্যমে পুরোনো বছরকে বিদায় দিয়ে ইবাদতের মাধ্যমে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোই কল্যাণকর। বছরজুড়ে কল্যাণ ও প্রশান্তি লাভে নির্ধারিত দিনক্ষণ ও মাসে ইবাদত-বন্দেগি করার চেষ্টাও হবে মুসলিম উম্মাহর জন্য কল্যাণময়।
মুসলিম উম্মাহর প্রত্যাশা- বিশ্বনবির হিজরতের ১৪৪৩তম নতুন বছরে বিশ্ববাসীর জন্য বয়ে আনুক অনাবিল শান্তি ও নিরাপত্তা। দূর হয়ে যাক চলমান মহামারি করোনাসহ যাবতীয় অশান্তি ও বিপদ। শান্তি নিরাপত্তায় জেগে ওঠুক বিশ্ব। শুভ ও কল্যাণময় হোক প্রতিটি দিন। আমিন।
এমএমএস/এমকেএইচ