হিজরি সন গণনা যেভাবে শুরু হয়েছিল
হিজরি সন। বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লামের হিজরতের সঙ্গে সম্পর্কিত। ঐতিহাসিক হিজরতের ঘটনা ও সময়কালকে ইসলামি সন গণনার প্রথম বছর ধরা হয়েছে বলে এটি হিজরি সন নামে পরিচিত। কিন্তু হিজরতের সঙ্গে মিল রাখা আবার এ সনের প্রথম মাস কোনটি হবে; এসব বিষয়ে কীভাবে সমাধান হয়েছিল? হিজরি সন প্রবর্তনে কাদের পরামর্শই বা গ্রহণ করা হয়েছিল?
ইসলামি শরিয়তের ফিকহি বিধানগুলোতেও বছর বলতে চন্দ্রবর্ষকেই বোঝানো হয়। আর চান্দ্রবর্ষ ৩৫৪ ও ৩৫৫ দিনে বছর হয়। কিন্তু কবে, কখন থেকে দাপ্তরিকভাবে এ হিজরি সন গণনা শুরু হয়? দাপ্তরিক কাজে হিজরি সন গণনা শুরু হওয়া সম্পর্কে ইতিহাসের পাতায় এবং হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ বুখারি ও আবু দাউদে কিছু তথ্য ওঠে এসেছে। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতের সময় পৃথিবীর বিশাল ভূখণ্ড ইসলামি খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ঐতিহাসিক আল-বেরুনির বর্ণনায় তাও ওঠে এসেছে।
রাষ্ট্রীয় কাজের সুবির্ধার্থে হজরত আবু মুসা আশআরি রাদিয়াল্লাহু আনহুর তাগিদে হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু হিজরি সন চালুর ব্যাপারে সচেষ্ট হন। হজরত আলি ও হজরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু হিজরি সনের বিভিন্ন বিষয়ে প্রস্তাবনা দিয়ে সহযোগিতা করেন।
হজরত আবু মুসা আশআরি রাদিয়াল্লাহু আনহু একবার এক চিঠিতে হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জানান, আপনি আমাদের কাছে (রাষ্ট্রীয় কাজের দিকনির্দেশনায়) যেসব চিঠি পাঠাচ্ছেন, সেগুলোতে সন-তারিখের উল্লেখ নেই; এতে আমাদের অসুবিধা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে খলিফা হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু একটি সন চালুর ব্যাপারে সচেষ্ট হন।
আল্লামা শিবলী নোমানি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘আল ফারূক’-এ উল্লেখ করেন, ‘হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলে ১৬ হিজরি সনের শাবান মাসে খলিফার কাছে একটি দাপ্তরিক পত্রের খসড়া পেশ করা হয়। সে সময় পত্রটিতে মাসের উল্লেখ ছিল; সনের উল্লেখ ছিল না। তখন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন খলিফা হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘পরবর্তী কোনো সময়ে তা কীভাবে বোঝা যাবে যে এটি কোন সনে পেশ করা হয়েছিল?
অতঃপর এ বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করে তিনি সাহাবায়েকেরাম ও অন্যান্য শীর্ষ পর্যায়ের জ্ঞানী-গুণীদের পরামর্শে হিজরতের ১৬ বছর পর ১০ জমাদিউল আউয়াল মোতাবেক ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে হিজরি সন প্রবর্তনের এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
তবে হিজরতের বছর থেকে (হিজরি) সন গণনার পরামর্শ দেন হজরত আলি রদিয়াল্লাহু আনহু। আর পবিত্র মাস মহররমকে ইসলামি সন গণনার প্রথম মাস হিসেবে রাখার পরামর্শ দেন হজরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু। (বুখারি ও আবুদাউদ)
হজরত আবু মুসা আশআরি রাদিয়াল্লাহু আনহুর তাগিদে হজরত আলি ও হজরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রস্তাবনায় হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু হিজরতের ১৬ বছর পর ১০ জমাদিউল আউয়াল তথা ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বনবির হিজরতের বছর থেকে মহররমকে প্রথম মাস হিসেবে সাব্যস্ত করে হিজরি সনের শুভ সূচনা করেন।
মুসলিমদের জন্য হিজরি সনের গুরুত্ব
মুমিন মুসলমানের জীবনে হিজরি সন বা চন্দ্রবর্ষের প্রভাব ব্যাপক। এ সনের গুরুত্বও অত্যধিক। বিশেষ করে মুসলমানের জন্য ঈমানের অন্যতম রোকন ও ইবাদত রোজা, ঈদ, হজ ও কুরবানি ও জাকাত- এ হিজরি তারিখের উপর নির্ভরশীল। চন্দ্র বছরের তারিখ ও ক্ষণ গণনা করেই এ ইবাদতের সময় নির্ধারণ করতে হয়।
শুধু তা-ই নয়
কোনো নারীর স্বামীর মৃত্যু হলে কিংবা কোনো নারী তালাকপ্রাপ্ত হলে চাঁদের সময়কাল হিসাব করেই তাদের ইদ্দত পালন করতে হয়। সন্তান-সন্তুতির জন্ম ও দুধ পান করানোর হিসাবও চন্দ্র মাসের হিসাব অনুযায়ী ধরতে হয়।
একটি বিষয় লক্ষণীয় যে
চন্দ্রবর্ষ ছাড়া অন্যান্য বর্ষের হিসাব-নিকাশ করলে দেখা যায়, শীত, গরম, বর্ষা ও ফলের মৌসুমগুলো বিভিন্ন বর্ষে একই সময়ে হয়ে থাকে। আর হিজরি বা চন্দ্র বর্ষে এসব একেক সময় অনুষ্ঠিত হয়। হিজরি সনের এ হিসাব মূলত দ্বীনুল ফিতরাহ বা স্বভাব অনুকূল ধর্ম। এ কারণেই সব জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ যার যার নিজ নিজ অনুকূল সময়ে ইবাদত-বন্দেগির সময় পান। যেমন-
‘কোনো কোনো বছর ছোট দিনে রোজা হয়, আবার কোনো সময় বড় দিনে রোজা হয়। কোনো কোনো সময় বর্ষায় হজ-কুরবানি ও ঈদ উদযাপিত হয় আবার কোনো কোনো সময় শীত কিংবা গরমে হজ-কুরবানি ও ঈদ অনুষ্ঠিত হয়। আর এতে সব জাতি-গোষ্ঠীর মানুষই উপকারিতা লাভ করতে সক্ষম হয়।’
সর্বোপরি মুসলমানদের জীবনে ইবাদতের ক্ষেত্রে হিজরি সনের গুরুত্ব বেশি হওয়ার কারণেই সব ঘটনা ও উপলক্ষ্যকে পাশ কাটিয়ে বিশ্বব্যাপী সব মানুষের সুবিধার্থে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরতকে উপলক্ষ্য করেই শুরু হয় হিজরি সন। এ হিজরি সন বা চন্দ্রবর্ষ অনুযায়ী তারিখ গণনা মুমিন মুসলমানর জন্য ফরজে কেফায়া। এ সনটি আরবদের সন বা বছর গণনা নয়, বরং এটি মুসলমানদের সন। ইসলামি সন।
মুমিন মুসলমানের উচিত হিজরি সন, মাস, তারিখ ব্যবহার ও চর্চা করা। হিসাব-নিকাশসহ যাবতীয় কাজে হিজরি সন মেনে চলা।
হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু সেই সময় থেকে আজ অবদি চালু আছে হিজরি সন। ইতিমধ্যে গত হয়েছে ১৪৪৩ হিজরি বছর। ইসলাম ও মুসলমানদের কাছে হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনা হিজরি সন গণনায় হৃদয়ে উজ্জ্বল হয়ে থাকেব।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জীবনের প্রতিটি কাজে হিজরি সনের ব্যবহার ও চর্চা করার এবং তা অব্যাহত রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমকেএইচ