মুমিনের বিশেষ আমলে কাটুক জুমআর দিন
বৈশ্বিক মহামারি করোনা আক্রান্ত পুরো বিশ্ব। কোভিড-১৯ এ বিপর্যস্ত মানুষ ঘরবন্দি। ঘরের অবসর সময় হয়ে ওঠুক আমল-ইবাদতের জন্য উপযুক্ত সময়। মুমিন মুসলমানের সপ্তাহিক ইবাদতের দিনটি কাটুক বিশেষ আমলে। যে আমলে রয়েছে গোনাহ মাফের হাতছানি।
জুমআর দিনের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে রয়েছে হাদিসের অনেক নির্দেশনা। সে কারণে জুমআর দিনে রয়েছে বিশেষ কিছু করণীয়। হাদিসে এসেছে-
রাসলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো পুরুষ যখন জুমআর দিন গোসল করে, সাধ্যমতো পবিত্রতা অর্জন করে, ঘরে যে সুগন্ধি আছে বা তেল আছে তা ব্যবহার করে, তারপর (জুমআ’র জন্য) বের হয় এবং (বসার জন্য) দুই জনকে আলাদা করে না, এরপর সাধ্যমত নামাজ পড়ে এবং ইমাম যখন কথা বলে তখন চুপ থাকে, তাহলে এক জুমআ থেকে অন্য জুমআ পর্যন্ত তার (গোনাহ) মাফ করা হয়।’ (বুখারি)
মহামারি করোনার কারণে দেশের সব মসজিদে জুমআ অনুষ্ঠিত হওয়ার ওপর রয়েছে সীমাবদ্ধতা। তা সত্ত্বেও যদি জুমআর দিন জোহরের প্রস্তুতিতেও উল্লেখিত আমলগুলো করা হয় তাতে পাওয়া যাবে এ সাওয়াব। এ ফজিলত ও সাওয়াবগুলো জুমআর দিনের জন্য নির্ধারিত।
জুমআ অনুষ্ঠিত না হলে এ সময়ে নামাজের অপেক্ষা এবং ধর্মীয় বিষয় নিয়ে পড়াশোনা, কুরআন তেলাওয়াত এবং অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগিতেও পাওয়া যাবে ফজিলত।
এ ছাড়াও জুমআর দিনে রয়েছে বিশেষ ৩টি আমল। এ আমলে আল্লাহ তাআলা বান্দার গোনাহ মাফ করে দেন। আর যার গোনাহ মাফ করা হয় তার জন্য থাকে না কোনো মহামারি কিংবা বিপদ।
জুমআর দিনের বিশেষ ৩ আমল
মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এ অবসর সময়ে মুসলিম উম্মাহর জন্য জুমআর দিনের বিশেষ আমলগুলো পালন করা সহজ ও সময়ের দাবি। আর তাহলো-
>> সুরা কাহফ তেলাওয়াত
কুরআনুল কারিমের ১৮তম সুরা এটি। মক্কায় অবতীর্ণ ১২ রুকুর ১১০ আয়াত বিশিষ্ট সুরা কাহফ। জুমআর দিন এ সুরাটি তেলাওয়াতে রয়েছে বিশেষ ফজিলত। হাদিসে এসেছে-
- হজরত সাহাল ইবনে মুআয রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সুরা কাহাফের প্রথম ও শেষ আয়াতগুলো পাঠ করবে; তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটি নূর হয়ে যায়। আর যে পূর্ণ সুরা তেলাওয়াত করে তার জন্য জমিন থেকে আসমান পর্যন্ত নূর হয়ে যায়। (মুসনাদে আহমদ)
- হজরত আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, যে সুরা কাহাফের প্রথম ১০ আয়াত মুখস্ত করবে; সে দাজ্জালের ফেতনা থেকে নিরাপদ থাকবে। অন্য রেওয়ায়েতে শেষ ১০ আয়াতের ব্যাপারে উল্লিখিত ফজিলতের বর্ণনা রয়েছে। (মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি, নাসাঈ ও মুসনাদে আহমদ)
- হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি জুমআর দিন সুরা কাহফ পাঠ করবে তার জন্য এক জুমআ থেকে অপর (পরবর্তী) জুমআ পর্যন্ত নূর হবে।
- হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি জুমআর দিন সুরা কাহাফ তেলাওয়াত করবে, সে আটদিন পর্যন্ত সর্বপ্রকার ফেতনা থেকে মুক্ত থাকবে। যদি দাজ্জাল বের হয় তবে সে দাজ্জালের ফেতনা থেকেও মুক্ত থাকবে।
- অন্য রেওয়ায়েতে আছে এক জুমআ থেকে অপর জুমআ পর্যন্ত তার সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। তবে উল্লিখিত গুনাহ মাফ হওয়ার দ্বারা সগিরা গুনাহ উদ্দেশ্য। কারণ ওলামায়ে কেরামের ঐকমত্য হচ্ছে যে, কবিরা গোনাহ তওবা করা ছাড়া ক্ষমা হয় না।
সুতরাং জুমআর দিন সুরা কাহফ তেলাওয়াত করে মহান আল্লাহর কাছে তাওবাহ করে ছোট-বড় সব গোনাহ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করে গোনাহমুক্ত জীবন লাভ করা যেতে পারে। এর মাধ্যম বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকার প্রার্থনাও আল্লাহ কবুল করে নিতে পারেন।
>> বিশ্বনবির প্রতি বেশি বেশি দরূদ পড়া
জুমআর দিনে বেশি বেশি দরূদ পাঠ করা উত্তম ও ফজিলতপূর্ণ। যদি কোনো ব্যক্তি একবার দরূদ পড়ে তবে তার প্রতি ১০টি রহমত নাজিল হয়। ৮০ বছরের গোনাহ মাফ হবে এবং ৮০ বছর ইবাদতের সওয়াব তার আমলনামায় লেখা হয়। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি জুমআর দিন আসরের নামাজের পর নিজ স্থান থেকে ওঠার আগে ৮০ বার এ দরূদ পাঠ করে-
اَللَّهُمَّ صَلِّى عَلَى مُحَمَّدٍ النَّبِيِّ الْاُمِّىِّ وَ ألَ ألِهِ وَ سَلِّم تَسْلِيْمًا
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আ’লা মুহাম্মাদিনিন নাবিয়্যিল উম্মিয়্যি ওয়া আ’লা আলিহি ওয়া সাল্লিম তাসলিমা।’
তার ৮০ বছরের পাপ ক্ষমা হয়ে যায় এবং ৮০ বছরের ইবাদতের সওয়াব তার আমলনামায় লেখা হয়।’ (আফজালুস সালাওয়াত)
>> দোয়া কবুলের বিশেষ সময়
জুমআর দিন দোয়া কবুলের জন্য রয়েছে বিশেষ সময় বা বিশেষ একটা মুহূর্ত। এ সময় আল্লাহর কাছে বান্দা যা চায় আল্লাহ বান্দাকে তাই দিয়ে দেন। অনেকে এ সময়টিকে বলেছেন আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত সময়। আবার কেউ কেউ খোতবার মুহূর্তকেও ইঙ্গিত করেছেন।
মহামারি করোনার কারণে ঘরে অবস্থানকালে অবসরের এ সময়ে ইবাদত-বন্দেগিতে ব্যয় করে মহামারি ও রোগ-ব্যধি থেকে মুক্ত থাকতে এ দোয়া করা যেতে পারে।
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমআর দিনের কথা আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন- ‘এদিনে একটা সময় আছে, মুসলিম বান্দা একাগ্র হয়ে নাছোড়বান্দার মতো, আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করতে থাকলে, তিনি তাকে (যা চান তাই) দিয়ে দেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথা বলার পর, হাত দিয়ে ইশারা দিয়ে বুঝিয়েছেন, দোয়া কবুলের সেই সময়টা খুব দীর্ঘ নয়। স্বল্পমেয়াদী।’ (বুখারি)
তাহলে সময়টা কখন?
এ সময়ে ব্যাপারে জানার জন্য সাহাবায়ে কেরামের মধ্যেও ছিল কৌতূহল ছিল। এ সময়টি নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন অনেক বড় বড় সাহাবি। হাদিসে কয়েকটা সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
- প্রথম সময়
হজরত ইবনে ওমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর সঙ্গে দেখা হলো হজরত আবু বুরদার। জানতে চাইলেন, আপনার বাবা (আবু মুসা আশআরি রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জুমআর দিনের বিশেষ সময় সম্পর্কে কিছু বলতে শুনেছেন?
(আবু দাদরা বললেন) জি, শুনেছি। বাবা বলেছেন, ‘আমি আল্লাহর রাসূলের কাছে শুনেছি, هِيَ مَا بَيْنَ أَنْ يَجْلِسَ الإِمَامُ إِلَى أَنْ تُقْضَى الصَّلاَةُ সে সময়টা হলো, ইমাম মিম্বরে বসার পর থেকে সালাত সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত।’ (মুসলিম)
- দ্বিতীয় সময়
জুমআর দিনের শেষ সময়। হজরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘জুমআর দিন বারো ঘণ্টা। (তার মধ্যে এমন বিশেষ এক ঘণ্টা বা মুহূর্ত আছে) তাতে কোনো মুসলিম বান্দা দোয়া করলে, আল্লাহ তায়ালা তা কবুল করেই নেন। তোমরা সে বিশেষ মুহূর্তকে, আসরের পরে (মাগরিবের আগে) শেষ সময়টাতে অনুসন্ধান কর।’ (আবু দাউদ)
- অন্য হাদিসে এসেছে, ‘সময়টা আসরের পর থেকে সূর্য ডুবে যাওয়া পর্যন্ত।’
- যাদুল মাআ`দ গ্রন্থে এসেছে, ‘এ মর্যাদাবান মুহূর্তটি হলো- জুমআ`র দিন আছরের নামাজ আদায়ের পর (থেকে মাগরিব পর্যন্ত)।’ এ মতে পক্ষে হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদিস রয়েছে আর তা হলো-
জুমআর দিন সূর্য উদয় হওয়ার পর (দুনিয়ায়) মানুষ এবং জিন ব্যতিত প্রত্যেক প্রাণীই কেয়ামতের ভয়ে আতংকিত থাকে। জুমআর দিনে এমন একটি বরকতময় সময় আছে, যাতে মুসলিম বান্দা নামাজরত অবস্থায় আল্লাহর কাছে যা প্রার্থনা করবে, আল্লাহ্ তাকে তা দান করবেন।
কা’ব বিন মালিক এ হাদিসের বর্ণনাকারী হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞেস করলেন, এটি কি প্রত্যেক বছরে হয়ে থাকে?
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, বরং তা (এ সময়টি) প্রত্যেক জুমআতেই রয়েছে। অতঃপর কা’ব বিন মালিক তাওরাত (কিতাব) খুলে পাঠ করলেন এবং বললেন, আল্লাহর রাসুল সত্য বলেছেন।
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন যে, অতঃপর আমি (তাওরাত কিতাবের পারদর্শী) হজরত আব্দুল্লাহ বিন সালামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। এবং তাঁকে কা’ব বিন মালিকের সঙ্গে আমার বৈঠকের কথা জানাই। তখন তিনি (হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম) বললেন, আমি সেই সময়টি সম্পর্কেও অবগত আছি।
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু তার কাছ থেকে সেই সময়টি সম্পর্কে জানতে চান। তিনি বলেন-
‘এটি (দোয়া কবুলের সেই সময়টি) হচ্ছে জুমআর দিনের শেষ মুহূর্ত।’
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, এটি কি করে সম্ভব? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো বলেছেন, ‘মুসলিম বান্দা তখন নামাজরত অবস্থায় আল্লাহর কাছে যা চাইবে আল্লাহ্ তাকে তা দান করবেন।’
আর (জুমআর) দিনের শেষ মুহূর্তের সময়টিতে নামাজ পড়া বৈধ নয় (আসর নামাযের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নামায পড়া নিষিদ্ধ)। সুতরাং উহা তো নামাজের সময় নয়।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম তখন বললেন-
‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি বলেন নি যে ব্যক্তি কোনো মজলিসে বসে নামাজের অপেক্ষায় থাকে সে ব্যক্তি নামাজ পড়া (নামাজের ওয়াক্ত হওয়া) পর্যন্ত নামাজেই মশগুল থাকে?
সুতরাং জুমআর দিন ইবাদত-বন্দেগি, কুরআন তেলাওয়াত ও দরূদ পাঠের মাধ্যমে অতিবাহিতহ করা প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব।
মহামারি করোনার এ সময়ে বিশেষ আমলের মাধ্যমে দিনটি অতিবাহিত করে আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা এবং মহামারি থেকে মুক্তি লাভের প্রার্থনা করাই মুমিন একমাত্র কাজ।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জুমআর দিনের বিশেষ এ আমলগুলো যথাযথভাবে আদায় করে ঘোষিত ফজিলত লাভ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমকেএইচ