কুরবানি আত্মত্যাগের প্রতীক
কুরবানি মুসলনমানদের দ্বিতীয় বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব। যুগ যুগ ধরে এ উৎসব পালিত হয়ে আসছে। কুরবানি দেওয়ার রীতি পৃথিবীর আদিকাল থেকেই চলে আসছে। এর মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য অনেক। কুরবানি শব্দের অর্থ উৎসর্গ বা ত্যাগ। মূলত ঈদুল আজহা হচ্ছে পশু কুরবানির মাধ্যমে নিজের অন্তরের পশুত্বকে জবাই করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে ত্যাগ স্বীকার করা।
আল্লাহর নবি হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম কর্তৃক পুত্র ঈসমাইল আলাইহিস সালামকে কুরবানির পরীক্ষার মাধ্যমই বর্তমানে প্রচলিত কুরবিানির সূত্রপাত হয়েছে। ইসলামি শরিয়তে মুসলিম জাতির জীবনটাই একটি কুরবানিতুল্য। এ কুরবানি হতে পারে- জানের, মালের, সম্পদের, সময়ের, স্বার্থের, সামথ্যের, ইচ্ছার ও পশু জবাইয়ের। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য স্বার্থ, সম্পদ ও আত্মত্যাগের মহিমাই হলো কুরবানি।
হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম-এর ঐতিহাসিক ত্যাগের মহান দিনটি এই শিক্ষা দেয় যে, প্রকৃত ভালোবাসা সম্পদে নয়, ভোগে নয় বরং ত্যাগে। মানুষের যা কিছু আছে তা অন্যের জন্য ত্যাগের মধ্যেই প্রকৃত সুখ। ঈদুল আজহার অর্থ নিছক পশু হত্যা নয় বরং ত্যাগ ও উৎসর্গের অঙ্গীকার। কবির ভাষায় বলতে হয় ‘ওরে হত্যা নয়, আজ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন।’
আল্লাহ তাআলা মুত্তাকিদের কুরবানি কবুল করেন। কুরবানির উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করা। পশু কুরবানি হচ্ছে আত্ম কুরবানির প্রতীক। কুরবানির পশু জবাই আসলেই প্রতীকী ব্যাপার। আল্লাহ তাআলা নিজেই বলেছেন, পশুর গোশত, চামড়া, রক্ত কিছুই তার কাছে পৌঁছায় না। পৌঁছায় শুধু বান্দার তাকওয়া ও পরহেজগারি।
শুধু পশু নয়, পশুত্বের কুরবানি দিতে হয়। প্রতিটি মানুষের ভিতর নফসে আম্মারা নামক একটি হিংস্র পশু আছে ,যা প্রতিনিয়ত মানুষকে অন্যায় ও পাপ কাজে প্ররোচিত করে থাকে এবং আত্মাকে পাপিষ্ঠ আত্মায় পরিণত করে। পশুত্ব হলো অপরিচ্ছন্ন শত কালিমাময় আত্মা অর্থাৎ পাপিষ্ঠ আত্মা। মানুষের অন্তরাত্মা পাপে ভরা, যেটার সম্মিলিত নামই পশুত্ব। সর্বপ্রথম এই পাপিষ্ঠ আত্মা অর্থাৎ পশুত্বকে কুরবানি করার পর পশু কুরবানি করা উচিৎ।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, মানব জাতির আদি পিতা হজরত আদম আলাইহিস সালাম-এর দুই সন্তানের কুরবানির মাধ্যমেই এ রেওয়াজ চালু হয়। وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِن أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الآخَرِ অর্থাৎ `আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের বাস্তব অবস্থা পাঠ করে শুনান। যখন তারা ভয়েই কিছু উৎসর্গ নিবেদন করেছিল, তখন তাদের একজনের উৎসর্গ গৃহীত হয়েছিল এবং অপরজনের গৃহীত হয়নি। (সূরা মায়িদা : আয়াত ২৭) তারপর সব নবি রাসূলের ওপরেই কুরবানির হুকুম ছিল।
সর্বশেষ হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম-এর কুরবানি ছিল মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ কুরবানি। যা আল্লাহর নিকট এত অধিক পছন্দনীয় ছিল যে, সমগ্র মানব জাতির সামর্থবানেদের জন্য কুরবানিকে ওয়াজিব করে দিয়েছেন। এ শিক্ষা মুসলিম পরিবারের মধ্যে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ এবং মহান আদর্শকে স্মরণ করিয়ে দেয়। মুসলিম জাতিকে এ মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্যই হজ ও কুরবানির অনুষ্ঠান। কিন্তু দূঃখের বিষয়, বর্তমানে বিজাতীয় অপসংস্কৃতি এবং চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর চরম আঘাত হেনেছে। কুরবানি শুধুমাত্র একটি নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। লোক দেখানো পশু কেনা, পশু কিনতে গিয়ে প্রতিযোগিতা ও আড়ম্বড়তার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অথচ কুরবানি করার বিধান এ জন্য হয়নি। লোক দেখানো ইবাদত নিশ্চয়ই আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার নয়।
পরিশেষে…
মহান স্রষ্টার প্রতি যথার্থ আনুগত্য প্রদর্শন, তাঁর সন্তুষ্টি ও মানব কল্যাণে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করার জন্য ধর্মীয় অঙ্গীকার ঘোষণায় সামাজিক আনন্দের উৎসব হিসেবে ঈদুল আজহা উদযাপিত হয় সারা বিশ্বে। এ উৎসব আত্ম-বিশ্লেষণ ও আত্মশুদ্ধিসহ পশুত্ব কুরবানির উৎসব। তাই আমাদের ত্যাগের মানসিকতা তৈরি করতে হবে। মনুষ্যত্ব ও মানবতাবোধকে জাগ্রত করতে হবে। যথাযথভাবে কুরবানি করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও বান্দার ভালোবাসা অর্জন করতে হবে। তবেই কুরবানি পালনের যথার্থতা উপলব্ধি করা সম্ভবপর হয়ে উঠবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের কুরবানির ত্যাগ ও উৎসর্গকে কবুল করুন। আমিন।
জাগোনিউজ২৪.কমের সঙ্গে থাকুন। সুন্দর সুন্দর ইসলামি আলোচনা পড়ুন। কুরআন-হাদিস মোতাবেক আমলি জিন্দেগি যাপন করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করুন। আমিন, ছুম্মা আমিন।
এমএমএস/পিআর