অত্যাচারী মানুষের প্রতিও যে সহানুভূতি দেখাতে বললেন বিশ্বনবি
মানুষের প্রতি মানুষের রয়েছে অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য। সে দায়িত্ববোধ থেকেই একজন মুমিনের উচিত তার অপর মুমিন ভাইয়ের মান-মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি দেখানো। তার অধিকার রক্ষায় যথাযথ দায়িত্ব পালন করা।
এ কারণেই পরস্পরের অধিকারের ব্যাপারে সতর্ক থাকার অসংখ্য উপদেশ দিয়েছেন প্রিয়নবি। আবার এক মুমিন অপর মুমিনের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির পাশাপাশি যথাযথ দয়া ও মায়াশীল হওয়ার ব্যাপারে তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
মানুষের অধিকার, মান-মর্যাদা, দয়া ও সহানুভূতি প্রকাশের গুরুত্ব তুলে ধরতে এ সম্পর্কে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিক-নির্দেশনামূলক কয়েকটি হাদিসে তুলে ধরা হলো-
- হজরত আবু মুসা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য অট্টালিকার ন্যায়। যার এক অংশ অন্য অংশকে মজবূত করে রাখে। তারপর তিনি (এটা বুঝাতে)তাঁর এক হাতের আঙ্গুলগুলো অপর হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে ঢুকালেন।’ (বুখারি ওমুসলিম)
- হজরত আবু মুসা রাদিয়াল্লাহু আনহু আরও বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তীর সঙ্গে নিয়ে আমাদের কোনো মসজিদ অথবা কোনো বাজার অতিক্রম করবে। তার উচিত হবে, সে যেন হাতের তালু দ্বারা তীরের ফলাগুলোকে ধরে নেয়। যাতে কোনো মুসলিম এ ফলা দ্বারা কোনো প্রকার কষ্ট না পায়।’ (বুখারি ও মুসলিম)
- হজরত নুমান ইবনে বামির রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মুমিনদের একে অপরের প্রতি সম্প্রীতি, দয়া ও মায়া-মমতার উদাহরণ হলো (একটি) দেহের মত। যখন দেহের কোনো অঙ্গ অসুস্থ হয় তখন তার জন্য সারা দেহ অনিদ্রা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়।’ (বুখারি ও মুসলিম)
- হজরত আবু হুরাইরাহ্ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (তাঁর নাতি) হাসান ইবনে আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুকে চুমু দিলেন। ঐ সময় তাঁর কাছে আক্বরা ইবরে হাবেস বসা ছিলেন। আক্বরা বললেন, ‘আমার দশটি ছেলে আছে, আমি তাদের কাউকেই কোনো দিন চুমু দেইনি।’ প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন- ‘যে দয়া করে না, তার প্রতিও দয়া করা হয় না।’ (বুখারি ও মুসলিম)
- হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, কিছু বেদুঈন লোক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে এসে বলল, ‘আপনারা কি আপনাদের শিশু-সন্তানদেরকে চুমু দিয়ে থাকেন? প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ’, তারা বলল, ‘আল্লাহর কসম! আমরা চুমু দেই না।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আল্লাহ যদি তোমাদের অন্তর থেকে দয়া উঠিয়ে নেন, তবে আমি কি তার মালিক করে দিতে পারি?’ (বুখারি ও মুসলিম)
- হজরত জারির ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করবে না, আল্লাহও তার প্রতি দয়া করবেন না।’ (বুখারি ও মুসলিম)
- হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন লোকদের নিয়ে নামাজ পড়ে, তখন সে যেন সংক্ষেপ করে। কারণ তাদের মাঝে দুর্বল, অসুস্থ ও বৃদ্ধ লোক থাকে। আর যখন কেউ একাকি নামাজ পড়ে, তখন সে ইচ্ছামত (নামাজ) দীর্ঘ করতে পারে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
- হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো কখনো (নফল) আমল করতে পছন্দ করা সত্ত্বেও এই ভয়ে ছেড়ে দিতেন যে, লোকেরা তা আমল করবে এবং তার ফলে তাদের উপর তা ফরয করে দেয়া হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
- হজরত ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘(এক) মুসলিম (অপর) মুসলিমের ভাই। সে তার উপর অত্যাচার করবে না এবং তাকে অত্যাচারীর হাতে ছেড়ে দেবে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূর্ণ করবে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূর্ণ করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের কোনো এক বিপদ দূর করে দেবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার বহু বিপদের একটি বিপদ দূর করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ-ত্রুটি গোপন করবে, আল্লাহ কিয়ামতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন করবেন।’ (বুখারি, মুসলিম)
- হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মুসলিম মুসলিমের ভাই। সে তার বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, তাকে মিথ্যা বলবে না (বা মিথ্যাবাদী ভাববে না), তার সাহায্য না করে তাকে অসহায় ছেড়ে দেবে না। এক মুসলিমের মর্যাদা (ক্ষুন্ন করা), মাল (হরণ করা) ও খুন (হত্যা করা) অপর মুসলিমের জন্য হারাম। তাকওয়া তথা আল্লাহ-সচেতনতা এখানে (অন্তরে) রয়েছে। কোনো মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ মনে করাটাই একটি মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য যথেষ্ট।’ (তিরমিজি)
- হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ (পূর্ণ) মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই পছন্দ করবে, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
ইসলাম মুমিন-মুসলমানের অধিকারের ব্যাপারে এতবেশি মর্যাদা দিয়েছে যে, কোনো মুসলমান যদি অত্যাচারীও হয় তবে তাকেও সহানুভূতি দেখানো। এমনকি তা কিভাবে সম্ভব? তা-ও বর্ণনা করেছেন বিশ্বনবি-
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমার ভাইকে সাহায্য কর, সে অত্যাচারী হোক অথবা অত্যাচারের শিকার হোক।’ তিনি (হজরত আনাস) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! অত্যাচারিতকে সাহায্য করার বিষয়টি তো বুঝলাম, কিন্তু অত্যাচারীকে কিভাবে সাহায্য করব?’ তিনি বললেন, ‘তুমি তাকে অত্যাচার করা থেকে বাধা দেবে, তাহলেই তাকে সাহায্য করা হবে।’ (বুখারি)
এ হচ্ছে ইসলামে এক মুসলিমের প্রতি অন্য মুসলিমকে সার্বিক সহায়তা দেয়ার নমুনা। আর সে কারণেই প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক মুসলমানের ওপর অন্য মুসলমানের কিছু হক পালন করাকে আবশ্যক করে দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘(এক) মুসলিমের উপর (অপর) মুসলিমের পাঁচটি অধিকার রয়েছে-
>> সালামের জবাব দেয়া।
>> রোগীকে (কোনো মুসলিম অসুস্থ হলে তাকে) দেখতে যাওয়া।
>> (কোনো মুসলিম মারা গেলে তার) জানাজায় অংশ গ্রহণ করা।
>> (কোনো মুসলিম দাওয়াত দিলে) দাওয়াত গ্রহণ করা এবং
>> কেউ হাঁচি দিলে তার জবাব দেয়া।’ (বুখারি ও মুসলিম)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী পাস্পরিক সম্পর্ক মান-মর্যাদা, সহানুভূতি ও দয়া প্রকাশে যথাযথ দায়িত্ব পালন কার তাওফিক দান করুন। হাদিসের আলোকে জীবন গঠন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমএস