জিলহজের ১০ তারিখেই কুরবানি উত্তম
মাওলানা শাহ মুহাম্মাদ নুরুল্লাহ শাজুলি চেয়ারম্যান, শাজুলিয়া যুব কাফেলা; পরিচালক, শাজুলিয়া একাডেমি বাংলাদেশ। যিনি ইসলামের আলোকে মানুষের উত্তম জীবন-যাপনে দেশব্যাপী নিরলস দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। মানুষকে আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পথে ও মতে চলার দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছেন। দাওয়াতি কার্যক্রমকে বেগবান করার লক্ষ্যে গড়ে তুলেছেন যুবকদের জন্য সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক আধ্যাত্মিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান শাজুলিয়া যুব কাফেলায়।
আর কিছুদিন পরেই শুরু হবে মুসলমানদের বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। কুরআন ও হাদিসের আলোকে তিনি কুরবানির কিছু গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা নিয়ে জাগো নিউজের মুখোমুখি হয়েছেন। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন জাগো নিউজের ধর্ম বিভাগের সম্পাদক মুহাম্মদ ছাইফুল্লাহ। পাঠকদের জন্য জাগো নিউজে তা তুলে ধরা হলো-
জাগো নিউজ : কুরবানি কি?
নুরুল্লাহ শাজুলি : মানবমনে আল্লাহ প্রেমের বহি:প্রকাশ ঘটানোর মাধ্যম হচ্ছে কুরবানি। যা দ্বারা মানুষ তাঁর আবাধ্য নফসানিকে জবাই করে আল্লাহর কাছে নিজেকে সঁপে দেয়। যার শিক্ষা আল্লাহ কুরআনের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন- ‘নিশ্চয় আমার নামাজ আমার কুরবানি, আমার জীবন আমার মৃত্যু সবাই আল্লাহর জন্য।’
জাগো নিউজ : কার ওপর কুরবানি ওয়াজিব?
নূরুল্লাহ শাজুলি : প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্ক সম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার উপর কুরবানি করা ওয়াজিব।
জাগো নিউজ : কুরবানির সময় থাকে কতদিন?
নূরুল্লাহ শাজুলি : মোট তিনদিন কুরবানি করা যায়। জিলহজের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তবে জিলহজ্বের ১০ তারিখেই কুরবানি করা উত্তম।
জাগো নিউজ : নাবালেগের কুরবানির হুকুম কি?
নূরুল্লাহ শাজুলি : নাবালেগ শিশু-কিশোর তদ্রূপ যে সুস্থমস্তিষ্কসম্পন্ন নয়, নেসাবের মালিক হলেও তাদের উপর কুরবানি ওয়াজিব নয়। অবশ্য তার অভিভাবক নিজ সম্পদ দ্বারা তাদের পক্ষে কুরবানি করলে তা সহিহ হবে।
জাগো নিউজ : মুসাফিরের জন্য কুরবানির হুকুম কি?
নূরুল্লাহ শাজুলি : যে ব্যক্তি কুরবানির দিনগুলোতে মুসাফির থাকবে তার উপর কুরবানি ওয়াজিব নয়। তবে কুরবানি থেকে বিরত থাকার নিয়্যাতে কুরবানির সময় সফর করা বৈধ নয়।
জাগো নিউজ : দরিদ্র ব্যক্তির কুরবানির হুকুম কি?
নূরুল্লাহ শাজুলি : দরিদ্র ব্যক্তির উপর কুরবানি করা ওয়াজিব নয়; কিন্তু সে যদি কুরবানির নিয়্যাতে কোনো পশু কিনে তাহলে তা কুরবানি করা ওয়াজিব হয়ে যায়।
জাগো নিউজ : প্রথম দিন কখন থেকে কুরবানি করা যাবে?
নূরুল্লাহ শাজুলি : ঈদের নামাজের পরপরই কুরবানি করা যাবে। তবে বৃষ্টিবাদল বা অন্য কোনো ওজরে যদি প্রথম দিন ঈদের নামাজ না হয় তাহলে ঈদের নামাযের সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রথম দিনেই কুরবানি করা জায়েয।
জাগো নিউজ : কোন কোন পশু দ্বারা কুরবানি করা যাবে?
নূরুল্লাহ শাজুলি : উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানি করা যাবে। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানি করা জায়েয নয়।
জাগো নিউজ : কুরবানির পশুর বয়সসীমা কমপক্ষে কত হতে হবে?
নূরুল্লাহ শাজুলি : উট কমপক্ষে ৫ বছরের, গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কিছু কমও হয় এবং অবশ্যই ৬ মাসের বেশি হয়, কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, দেখতে ১ বছরের মতো মনে হয় তাহলে তা দ্বারাও কুরবানি করা জায়েয। ছাগলের ক্ষেত্রে ১ বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কুরবানি জায়েয হবে না।
জাগো নিউজ : এক পশুতে কতজন শরিক হতে পারবে?
নূরুল্লাহ শাজুলি : ছাগল, ভেড়া বা দুম্বার ক্ষেত্রে শুধু একজনই কুরবানি দিতে পারবে। আর উট, গরু, মহিষে সর্বোচ্চ সাত জন শরিক হতে পারবে। সাতের অধিক শরিক হলে কারো কুরবানি সহিহ হবে না।
জাগো নিউজ : কোনো অংশীদারীর নিয়্যাতে গলদ থাকলে কুরবানির হুকুম কি?
নূরুল্লাহ শাজুলি : যদি কেউ আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে কুরবানি না করে গোশত খাওয়ার নিয়্যাতে অথবা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে কুরবানি করে থাকে। তাহলে তার কুরবানি সহিহ হবে না। এমন ব্যক্তিকে অংশীদার বানালে শরিকদের কারো কুরবানিই হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে শরিক নির্বাচন করতে হবে।
জাগো নিউজ : কুরবানির পশুতে আকিকার হুকুম কি?
নূরুল্লাহ শাজুলি : গরু, মহিষ ও উটের ক্ষেত্রে কুরবানির সঙ্গে আকিকার নিয়্যাতে শরিক হতে পারবে। এতে কুরবানি ও আকিকা দুটোই সহিহ হবে।
জাগো নিউজ : কুরবানির পশু কেমন হওয়া উচিত?
নূরুল্লাহ শাজুলি : কুরবানির পশু হৃষ্টপুষ্ট হওয়াই উত্তম।
জাগো নিউজ : নিজের কুরবানির পশু নিজে জবাই করতে পারবে কি?
নূরুল্লাহ শাজুলি : হ্যাঁ কুরবানির পশু নিজে জবাই করাই উত্তম। নিজে না পারলে অন্যকে দিয়েও জবাই করাতে পারবে। এক্ষেত্রে কুরবানিদাতা পুরুষ হলে জবাইস্থলে তার উপস্থিত থাকা ভালো।
জাগো নিউজ : কুরবানির পশু থেকে (জবাইয়ের আগে) উপকৃত হওয়া যাবে কিনা?
নূরুল্লাহ শাজুলি : কুরবানির পশু কেনার পর তা থেকে উপকার লাভ করা জায়েজ নয়। যেমন- দুধগ্রহণ করা, হালচাষ করা, আরোহণ করা, পশম কাটা ইত্যাদি। সুতরাং কুরবানীর পশু দ্বারা এসব করা যাবে না। যদি করে তবে উপকার গ্রহণের মূল্য সদকা করে দিতে হবে।
জাগো নিউজ : কোনো শরিকের মৃত্যু হতার হুকুম কি?
নূরুল্লাহ শাজুলি : কয়েকজন মিলে কুরবানি করার ক্ষেত্রে জবাইয়ের আগে কোনো শরিকের মৃত্যু হলে তার ওয়ারিসগণ যদি মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানি করার অনুমতি দেয় তবে তা জায়েয হবে। নতুবা ওই শরিকের টাকা ফেরত দিতে হবে। অবশ্য তার স্থলে অন্যকে শরিক করা যাবে।
জাগো নিউজ : কুরবানির পশুর বাচ্চা হলে তার হুকুম কি?
নূরুল্লাহ শাজুলি : কুরবানির পশু বাচ্চা দিলে ওই বাচ্চা জবাই না করে জীবিত সদকা করে দেওয়া উত্তম। যদি সদকা না করে তবে কুরবানীর পশুর সঙ্গে বাচ্চাকেও জবাই করবে এবং গোশত সদকা করে দিবে।
জাগো নিউজ : কুরবানির গোশত বণ্টনের উত্তম পদ্ধতি কি?
নূরুল্লাহ শাজুলি : কুরবানির গোশতের এক তৃতীয়াংশ নিজ পরিবারের জন্য, এক তৃতীয়াংশ গরীব-মিসকিনকে এবং এক তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে দেওয়া উত্তম। অবশ্য পুরো গোশত যদি নিজে রেখে দেয় তাতেও কোনো অসুবিধা নেই।
জাগো নিউজ : ঋণ করে কুরবানী করার হুকুম কি?
নূরুল্লাহ শাজুলি : কুরবানি ওয়াজিব এমন ব্যক্তিও ঋণের টাকা দিয়ে কুরবানি করলে ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। তবে সুদের উপর ঋণ নিয়ে কুরবানি করা যাবে না।
জাগো নিউজ : কুরবানির গোশত দিয়ে খানা শুরু করার বিধান কি?
নূরুল্লাহ শাজুলি : ঈদুল আযহার দিন সর্বপ্রথম নিজ কুরবানির গোশত দিয়ে খানা শুরু করা সুন্নত। অর্থাৎ সকাল থেকে কিছু না খেয়ে প্রথমে কুরবানির গোশত খাওয়া সুন্নত। এই সুন্নত শুধু ১০ যিলহজের জন্য। ১১ বা ১২ তারিখের গোশত দিয়ে খানা শুরু করা সুন্নত নয়।
জাগো নিউজ : জাগো নিউজের পক্ষ থেকে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
নূরুল্লাহ শাজুলি : আপনাকে, জাগো নিউজ ও সব পাঠকমহলকেও ধন্যবাদ। আল্লাহ সবাইকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। আমিন।
জাগোনিউজ২৪.কমের সঙ্গে থাকুন। সুন্দর সুন্দর ইসলামি আলোচনা পড়ুন। কুরআন-হাদিস মোতাবেক আমলি জিন্দেগি যাপন করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করুন। আমিন, ছুম্মা আমিন।
এমএমএস/পিআর