তামাত্তু হজ পালনের ১৬ কাজ
চলছে হজের মাস জিলহজ। আর কদিন পরেই অনুষ্ঠিত হবে হজ। শারীরিক ও আর্থিকভাবে সাবলম্বীরা এ হজ আদায়ে ইতিমধ্যে পবিত্র নগরী মক্কা ও মদিনায় অবস্থান করছে। তাদের অনেকেই আদায় করবে ইফরাদ, কিরান ও তামাত্তু হজ। তামাত্তু হজ আদায়ের ১৬টি ধাপ তুলে ধরা হলো-
তামাত্তু হজ
হজের মাসগুলোতে (শাওয়াল, জিলক্বদ, জিলহজ) আলাদা আলাদা ইহরামে ওমরা ও হজ পালনেই সম্পন্ন হবে তামাত্তু হজ। প্রথমেই ওমরার নিয়তে ইহরাম বাধবে। অতঃপর ওমরা পালন শেষে মাথা ন্যাড়া করার মাধ্যমে ইহরাম থেকে হালাল হবে।
জিলহজের ৮ তারিখ পুনরায় হজের নিয়তে ইহরাম বেধে হজ সম্পাদন করবে এবং ১০ জিলহজ মিনায় বড় জামরাতে কংকর নিক্ষেপের পর কুরবানি করে মাথা ন্যাড়া হওয়ার মাধ্যমে হজের ইহরাম থেকে বের হবে।
> ওমরার ইহরাম (ফরজ)
যারা নিজ দেশ থেকে সরাসরি মক্কায় যাবে, তারা নিজ দেশ থেকেই ইহরাম বেঁধে অথবা মিকাত অতিক্রম করার আগেই ইহরাম বাঁধবেন। ইহরাম বাঁধার জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সেরে ওজু বা গোসল করা। অতপর মিকাত অতিক্রমের আগেই সেলাইবিহীন দুই কাপড় পরিধান করে দুই রাকাআত নামাজ আদায়ের পর ওমরার নিয়ত করা-
اَللَّهُمَّ لَبَّيْكَ عُمْرَةً فَيَسِّرْهُ لِى وَ تَقَبَّلْهُ مِنِّى
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা ওমরাতান। ফাইয়াসসিরহু লি ওয়া তাকাব্বালহু মিননি।’
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আমি ওমরা পালনের ইচ্ছা করছি; আপনি আমার জন্য তা সহজ করে দিন এবং তা কবুল করুন।’
অতঃপর উচ্চস্বরে ৪ ভাগে ৩ তালবিয়া পড়া-
لَبَّيْكَ ا للّهُمَّ لَبَّيْكَ - لَبَّيْكَ لاَ شَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكَ - اِنَّ الْحَمدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ - لاَ شَرِيْكَ لَكَ
উচ্চারণ : লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক; লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক; ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক্; লা শারিকা লাক।
অর্থ : > আমি হাজির হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত! > আপনার ডাকে সাড়া দিতে আমি হাজির। আপনার কোন অংশীদার নেই। > নিঃসন্দেহে সমস্ত প্রশংসা ও সম্পদরাজি নেয়ামত আপনার এবং একচ্ছত্র আধিপত্য আপনার। > আপনার কোন অংশীদার নেই।
> ওমরার তাওয়াফ (ফরজ)
তামাত্তু হজ আদায়কারীদের ওমরার তাওয়াফ আদায় করা ফরজ। এ তাওয়াফে ইজতিবা ও রমল করা আবশ্যক।
আরও পড়ুন > কাবা শরিফের তাওয়াফ বাম দিকে করার রহস্য কী?
> মাকামে ইবরাহিমে নামাজ (ওয়াজিব)
তাওয়াফ সম্পন্ন হলে মাকামে ইবরাহিম সন্নিকটবর্তী প্রান্তে দুই রাকাআত নামাজ আদায় করে দোয়া করা। এটা দোয়া কবুলের স্থান। অতপর দাঁড়িয়ে ঝমঝমের পানি পান করা।
> ওমরার সাঈ (ওয়াজিব)
সাফা পাহাড়ের উপরে আরোহন করে সেখান থেকে ক্বিবলামুখী হয়ে সাঈ’র নিয়ত করে সাফা হতে সাঈ শুরু করা। সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী নির্ধারিত চিহ্নিত স্থান দ্রুতবেগে অতিক্রম করা। মারাওয়া পাহাড়ে আরোহনপূর্বক দোয়া করা। অতপর আবার সাফায় আসা। এভাবে সাতবার সাঈ করা।
> মাথা মুণ্ডানো (ওয়াজিব)
পুরুষ হলে বিশ্বনবির আদর্শ অনুসারে সম্পূর্ণ মাথা মুণ্ডণ করা বা চুল ছাঁটা। মহিলা হলে চুলের আগা এক ইঞ্চি পরিমাণ কেটে ওমরার ইহরাম থেকে বের হওয়া।
হজের প্রস্তুতি
জিলহজ মাসের ৭ তারিখ হারাম শরিফে হজের নিয়মাবলীর ওপর যে খুতবা দেয়া হবে, তা মনোযোগ দিয়ে শোনা বা হজের করণীয়গুলো বুঝে নেয়া এবং হজের প্রস্তুতি গ্রহণ করা-
> হজের ইহরাম (ফরজ)
৮ জিলহজ হারাম শরিফ বা বাসা থেকে ওমরার মতো হজের নিয়তে ইহরাম বেঁধে মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া এবং জোহরের নামাজের আগেই মিনায় পৌঁছা।
> মিনায় অবস্থান (সুন্নাত)
জিলহজের ৮ তারিখ জোহর থেকে ৯ তারিখ ফজর পর্যন্ত ৫ ওয়াক্ত (জোহর, আসর, মাগরিব, ইশা ও ফজর) নামাজ মিনায় পড়া (মুস্তাহাব) এবং তথায় অবস্থান করা (সুন্নাত)। ৯ জিলহজ ফজরের পর সম্ভব হলে গোসল অথবা ওজু করে দুপুরের আগে আরাফাতের ময়দানে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
> আরাফাতের ময়দানে অবস্থান (ফরজ)
৯ জিলহজ জোহরের আগেই হজের অন্যতম রোকন পালনে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা। আর এটাই হলো হজের অন্যতম রোকন। ৯ জিলহজ সকালে মিনায় ফজরের নামাজ আদায় করে আরাফায় আসার প্রস্তুতি স্বরূপ গোসল করে একবার তাকবিরে
তাকবিরে তাশরিক > ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার; লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার; ওয়া লিল্লাহিল হামদ’ পাঠ করা। জোহরের নামাজের আগেই আরাফাতের ময়দানে আসা।
আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করে হজের খুতবা শোনা এবং নিজ নিজ তাবুতে জোহর ও আসরের নামাজ নির্দিষ্ট সময়ে আলাদাভাবে আদায় করা। অতঃপর আরাফাতের ময়দান থেকে ৯ জিলহজ সুর্যাস্তের পর মাগরিবের নামাজ না পড়ে মুজদালিফার দিকে রওয়ানা হওয়া।
> মুজদালিফায় অবস্থান (ওয়াজিব)
আরাফাতের ময়দান থেকে মুজদালিফায় গিয়ে মাগরিব ও ইশার নামাজ এক আজানে ও একই ইক্বামাতে একসঙ্গে আদায় করা। রাতে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান (সুন্নাত)। ১০ জিলহজ ফজরের নামাজের পর সূর্য ওঠার আগে কিছু সময় অবস্থান আবশ্যক।
তবে ১০ জিলহজ ফজরের পর সুর্য ওঠার আগেই মুজদালিফা ত্যাগ করে মিনার উদ্দেশে রওয়ানা হতে হবে।
মুজদালিফা থেকে কংকর সংগ্রহ : মুজদালিফায় অবস্থানকালীন সময়ে কংকর সংগ্রহ করা।
> কংকর নিক্ষেপ (প্রথম দিন)
১০ জিলহজ মুজদালিফা থেকে মিনায় এসে বড় জামরায় ৭টি (সাত) কংকর নিক্ষেপ করা (ওয়াজিব)। আর তা করতে হবে জোহরের আগে। কংকর নিক্ষেপের জায়গায় বাংলায় দিক-নির্দেশনা দেয়া হয় তা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করা।
আরও পড়ুন > কাবা শরিফ তাওয়াফে ‘ইজতিবা ও রমল’ করার রহস্য
> কুরবানি করা (ওয়াজিব)
কংকর নিক্ষেপের পর মিনায় কুরবানির পশু জবাই করা অথবা ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা জমা দিয়ে জবাইয়ের সময় নিশ্চিত হওয়া জরুরি। কেননা কুরবানির পর মাথা ন্যাড়া করতে হবে। তাই কুরবানির সঠিক সময় জেনে নেয়া আবশ্যক।
> মাথা মুণ্ডন করা (ওয়াজিব)
কুরবানি সম্পন্ন হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর মাথা হলক বা ন্যাড়া করার মাধ্যমে বিশ্ব নবির আদর্শের অনুসরণ করা। মাথা ন্যাড়া হওয়ার মাধ্যমে হজের ইহরাম থেকে বের হয়ে স্বাভাবিক কাজের জন্য হালাল হওয়া।
সতর্কতা : ১০ জিলহজ মিনায় জামরাতে আকাবায় কংকর নিক্ষেপ, কুরবানি এবং মাথা মুণ্ডনের মধ্যে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা জরুরি। মাথা মুণ্ডনের মাধ্যমে ইহরাম থেকে হালাল হয়ে যাবে। শুধুমাত্র শারীরিক সম্পর্ক (স্ত্রী সহবাস) ছাড়া সব কাজ করা যাবে।
> তাওয়াফে জিয়ারাত (ফরজ)
হজের সর্বশেষ রোকন হলো তাওয়াফে জিয়ারত। যা ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের আগে সম্পন্ন করতে হবে। ১২ তারিখ সূর্যাস্তের আগে করতে না পারলে দম বা কুরবানি দিতে হবে।
> কংকর নিক্ষেপ (ওয়াজিব)
১০, ১১ ও ১২ জিলহজ মিনায় অবস্থান করা এবং ১১ ও ১২ জিলহজ মিনায় অবস্থিত তিন জামরায় ৭টি করে ২১টি পাথর নিক্ষেপ করা। প্রথমে ছোট জামরায় তারপর মধ্যম, অতপর বড় জামরায় কংকর নিক্ষেপ করা। সর্বক্ষেত্রে দুর্বল ও নারীদের জন্য রাতে কংকর নিক্ষেপ করা উত্তম।
> মিনায় রাত যাপন
মিনায় অবস্থানরত দিনগুলোতে ১০-১২ জিলহজ পর্যন্ত মিনাতেই রাত যাপন করুন এবং ১৩ জিলহজ কংকর নিক্ষেপ শেষ করে মিনা থেকে ফিরে আসা সুন্নাত। (এর মাঝে মক্কায় এসে তাওয়াফে জিয়ারাত সম্পন্ন করে আবার মিনা যাওয়া।)
মিনা ত্যাগ : ১৩ জিলহজ মিনায় না থাকতে চাইলে ১২ জিলহজ সন্ধ্যার আগে মিনা ত্যাগ করা। সুর্যাস্তের আগে মিনা ত্যাগ করা উত্তম।
> বিদায়ী তাওয়াফ (ওয়াজিব)
সমগ্র বিশ্ব থেকে আগত সব হজপালনকারীর জন্য বিদায়ী তাওয়াফ আদায় করা ওয়াজিব। তবে হজ শেষে যে কোনো নফল তাওয়াফই বিদায়ী তাওয়াফে পরিণত হয়ে যায়।
হজ সম্পাদন শেষে মুসলিম উম্মাহর নিজ নিজ দেশে ফেরার পালা। দেশে ফেরার আগে মক্কা-মদিনায় যে যেখানেই অবস্থান করবে; তারা আল্লাহর স্মরণে ইবাদত-বন্দেগিতে সময় অতিবাহিত করবে এবং নির্ধারিত সময়ে দেশের ফিরে যাবে।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে উল্লেখিত কাজগুলো যথাযথ আদায়েরে মাধ্যমে হজে তামাত্তু আদায় করার তাওফিক দান করুন। সবাইকে হজে মাবরুর লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/আরআইপি