ফিতরা গরিবের হক
রমজান, ফিতরা ও ঈদ একই সূত্রে গাঁথা। ফিতরার মধ্যেই নিহিত আছে গরিব প্রতিবেশির আনন্দ ও ঈদ উৎসব। এর মাধ্যমে তৃপ্ত ও তুষ্ট হয় মুমিন মুসলমান। সারা মাস ধরে রোজা পালনের পর ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে প্রতিবেশি অসহায় স্বজনদের জন্য সাধ্যানুযায়ী ঈদের উপহার উপঢৌকন প্রদান। আর ফিতরা হচ্ছে ইসলামি অনুশাসনের এক নির্দশন। যা সাম্যের বিধান সমাজে প্রচলন করে।
আল্লাহর এক অপার বিস্ময় যে, বান্দার জন্য রোজা ফরজ করেছেন। বান্দা আল্লাহর ভয়ে পানাহার ও যৌনাচার, মুনকার কাজ ত্যাগের মাধ্যমে রোজা পালন করে। এই রোজা পালনের সময় কোনোভাবে যদি রোজার আংশিক ক্ষতি, ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়; তার সমাধানে; তার মুক্তির মাধ্যম হচ্ছে- অসচ্ছল, অসহায় ব্যক্তিদের মাঝে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে ফিতরা আদায় করা। যা আমাদের জন্য একান্ত আবশ্যকীয়।
ফিতরা :
‘ফিতর’ মানে হলো ‘রোজা ছাড়া’। অর্থাৎ যা রমজানের রোজা ছাড়ার কারণে আদায় করতে হয়। আর ফিতরাহ মানে হলো প্রকৃতি। যেহেতু ফিতরার মাধ্যমে মানুষ তার পালণীয় রোজার যাবতীয় খতগুলো; ভুলগুলো থেকে আত্মশুদ্ধি ও আত্মার আমলকে নির্মল করার জন্য অসহায়দের মাঝে দেয়া আবশ্যক, তাই এর নাম ফিতরাহ।
ফিতরা আদায়ের উপকারিতা :
১. সাদাকাতুল ফিতর দ্বিতীয় হিজরির শাবান মাসে বিধিবদ্ধ হয়। রোজাদারকে সকল অবাঞ্ছনীয় অসারতা ও যৌনাচার তথা ফাহেশা কাজ থেকে পবিত্র করার জন্য; যা রোজাকালীন অবস্থায় করে ফেলেছে। এই সাদাকাহ হবে রোজার ভুল-ত্রুটির ঘাটতির ক্ষতির পরিপূরক। কেননা ছাওয়াবের কাজ-কর্ম মানুষের পাপ তথা গুনাহকে ধ্বংস করে দেয়।
২. এ সাদাকাহকে ফরজ করার আরেকটি কারণ হচ্ছে- ঈদের দিন গরিব ও মিসকিনদের আনন্দ-বিনোদন, উত্তম খাবারের সহজলভ্যতার জন্য। যাতে তারাও ধনীদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে। যারা দিন আনে দিনে খায়; ভিক্ষাবৃত্তি করে খাবার যোগাড় করতে হয়; খাবারের জন্য অন্য লোকের দারস্থ হতে হয়; তাদেরকে অন্তত ঈদের দিনটাতে যাতে লাঞ্ছিত হতে না হয় এবং ঘরের খাবার দেখে মনের ভেতর যেন খুশির ঢেউ আসে, এ জন্যই সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজবিজ্ঞানী, উম্মতের দরদী নবী ও রাসূল হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই সুব্যবস্থার প্রচলন করে গেছেন।
হাদীসে এসেছে-
হজরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিমদের স্বাধীন ও ক্রীতদাস, পুরুষ ও নারী এবং ছোট ও বড় সকলের জন্য এক সা’ (প্রায় আড়াই কেজি) খেজুর বা যব খাদ্য (আদায়) ফরজ করেছেন। (বুখারি, মুসলিম)।
৩. আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দীর্ঘ একটি বছর আমাদেরকে সুস্থ্য ও নিরাপদ রাখার পর মুবারক মাস রমজানে দান করেছেন। তাই এ সুস্থ্য দেহের জাকাত হল ফিতরা।
৪. এই সাদাকাহ আদায় করতে হয় আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্য। কেননা আল্লাহ মেহেরবানী করে আমাদেরকে দীর্ঘ এক মাস মহামূল্যবান ফরজ ইবাদত রোজা রাখার তাওফিক দান করেছেন।
৫. সর্বোপরি এই নিয়ামতের মাস, আনুগত্যের মাসের শেষে যাতে আত্মশুদ্ধি প্রক্রিয়া পরিপূর্ণ হয়। সকল হ্যাঁ-সূচক ও না-সূচক আনুগত্যের পর আত্মাকে বিশুদ্ধ ও পবিত্র করার লক্ষ্যে আল্লাহর পথে মাল (অর্থ) খরচের মাধ্যমে নিজেদেরকে পবিত্রতা করার জন্যই ফিতরার ব্যবস্থা করেছেন।
যারা এই ফিতরা আদায় করবেন:
ফিতরা তারাই দিবেন যাদের ঈদের পূর্ব রাত ও ঈদের দিনে নিজের এবং পরিবারের সবার একান্ত প্রয়োজনীয় আহারের চেয়ে অতিরিক্ত খাদ্য বা সম্পদ মজুদ থাকে। ফিতরা দেয়ার জন্য জাকাত ফরজ হওয়ার বিষয়াবলীর কোনো বিধান নেই। এ কথা বলা যাবে না যে, আমার উপর তো জাকাত ফরজ নয়; বা আমি তো নিসাব পরিমাণ মালের (সম্পদের) মালিক নই। সুতরাং যার কাছে রমজানের শেষ রোজায়, ঈদের যাবতীয় খরচ মিটিয়ে অতিরিক্ত অর্থ থাকবে তার উপর পরিবারের পক্ষ থেকে সবার ফিতরাহ আদায় করতে হবে।
১. ফিতরা দেয়ার জন্য জায়গা-জমি, বাড়ি-গাড়ি, ধন-সম্পদ নিসাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়া জরুরি নয়। এ সাদাকাহ কাফফারার মতো যা ধনী-গরিব সকলেই আদায় করতে বাধ্য। যেমন- প্রত্যেক স্বাধীন ও ক্রীতদাস বান্দার জন্য...। (বুখারি)
২. পরিবারের সবার উপর নির্ধারিত হারেই ফিতরা দিতে হবে। পরিবারের কর্তা ব্যক্তির একার ফিতরা নয়, বরং তার অধীনস্ত ছোট-বড়, চাকর-বাকর, ছেলে-মেয়ে এমনকি সদ্যভূমিষ্ট (ঈদের নামাজের পূর্বে জন্ম নিলেও) বাচ্চার জন্যও সাদাকাতুল ফিতরা দিতে হবে।
হাদিসে এসেছে-
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, প্রত্যেক স্বাধীন ও ক্রীতদাস, পুরুষ ও নারী, ছোট ও বড়, গরিব ও ধনীর উপর। (মুসনাদে আহমাদ, বাইহাকি)
৩. এমনকি যে ব্যক্তির ফিতরা আদায় করার মতো কিছু আছে; কিন্তু তার ওই পরিমাণ দেনা বা ঋণ আছে, তবুও তাকে ফিতরাহ আদায় করতে হবে। তবে যদি ঋণদাতা তার ঋণ পরিশোধ করার তাগাদা দেয় তাহলে সেক্ষেত্রে আগে ঋণ পরিশোধ করাই আবশ্যক। আর তার জন্য জাকাত ফরজ নয়। (ফিকহুজ জাকাত)।
ফিতরার পরিমাণ নির্ধারণ :
১৪৩৬ হিজরি, ১৪২২ বঙ্গাব্দ এবং ২০১৫ সালের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক নির্ধারিত ফিতরা হচ্ছে সর্বনিম্ন ৬০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১৬৫০ টাকা।
ইসলামি শরিয়াহ মতে- গম/আটা, খেজুর, কিসমিস, পনির ও যব ইত্যাদি পণ্যগুলোর যে কোনো একটি দিয়ে ফিতরা প্রদান করা যায়।
ক. গম বা আটা দিয়ে ফিতরা আদায় করলে এক কেজি ৬৫০ গ্রাম অথবা এর বর্তমান বাজার মূল্য ৬০ টাকা আদায় করতে হবে;
খ. খেজুর দিয়ে আদায় করলে তিন কেজি ৩০০ গ্রাম কিংবা এর বাজার মূল্য ১ হাজার ৬৫০ টাকা;
গ. কিসমিস দিয়ে আদায় করলে তিন কেজি ৩০০ গ্রাম কিংবা এর বাজার মূল্য ১ হাজার ২০০ টাকা;
ঘ. পনির দিয়ে আদায় করলে তিন কেজি ৩০০ গ্রাম কিংবা এর বাজার মূল্য ১ হাজার ৬০০ টাকা এবং
ঙ. যব দিয়ে আদায় করলে তিন কেজি ৩০০ গ্রাম অথবা বাজার মূল্য ২০০ টাকা। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
এ বছর উপরোল্লেখিত এ নির্ধারিত হারে ফিতরা আদায় করতে হবে। এর বাইরেও যাদের সামর্থ্য আছে তারা আরও বেশি টাকা ফিতরা দিতে কোনো অসুবিধা নেই। বরং আল্লাহ তার দানের অগণিত ছাওয়াব দান করবেন।
কী দিয়ে ফিতরা আদায় করবো :
যে দেশে যে খাদ্য শষ্য হয় তার মূল্য নির্ধারণ করেই আমাদের ফিতরা আদায় করতে হবে। যে দেশে গম হয় না খেজুর হয় তারা খেজুর দিয়ে ফিতরা আদায় করবে। খেজুর হয় না কিসমিস হয়; কিসমিস দিয়ে ফিতরা আদায় করবে। মূল কথা হচ্ছে প্রত্যেক দেশের প্রধান খাদ্য শষ্য, ফল বা গোশত যাই হোক না কেন, ফিতরায় তা দান করলে ফিতরা আদায় হয়ে যাবে। তাতে সে খাদ্যের কথা হাদিসে উল্লেখ থাক অথবা না থাক।
সর্বোপরি প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। নাবালক ছেলে-মেয়ের পক্ষ থেকে বাবাকে এ ফিতরা দিতে হয়। আর তা দিতে হয় ঈদ-উল ফিতরের নামাজের আগেই। আসুন আমরা ফিতরা আদায় করে গরিবের দু:খ লাঘব করি; তাদের মুখে হাসি ফোটাই; ভাগ করে নিই ঈদের আনন্দ-বিনোদন। আল্লাহ আমাদেরকে ফিতরা আদায় করে আমাদের রোজার ছোটছোট অপরাধ ও ভুলগুলো থেকে মুক্ত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
তথ্যসূত্র : বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ, মুসনাদে আহমদ ও ইসলামি ফাউন্ডেশন।
জাগো নিউজের সঙ্গে থাকুন। রমজান সম্পর্কিত সুন্দর সুন্দর ইসলামী আলোচনা পড়ুন। কোরআন-হাদিস মোতাবেক আমলি জিন্দেগি যাপন করে রমজানের রহমত, বরকত ও মাগফেরাত অর্জন করুন। আমিন, ছুম্মা আমিন।
এমএমএস/এসআইএস/এআরএস/এমআরআই