বিপদ-অশান্তি থেকে মুক্তির ৩ আমল ও দোয়া
মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে ঘোষণা করেন, ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে কিছু ভয় ও ক্ষুধা দ্বারা এবং কিছু ধন-সম্পদ-প্রাণ ও ফল-ফসলের ক্ষতির মাধ্যমে পরীক্ষা করবো। আর আপনি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন। যারা তাদের ওপর কোনো বিপদ-আপদ আসে; তখন তারা বলে, নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চিতভাবে তার দিকেই ফিরে যাব।' (সুরা বাকারা: আয়াত ১৫৫-১৫৬)
মানুষের জীবনে অনেক সময় বিপদ-আপদ এসে পড়ে। এসব বিপদ-আপদ মুমিনের জন্য যেমন আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা, আবার অবাধ্যদের জন্য আজাবের কারণও বটে। এসব বিপদাপদ থেকে বেঁচে থাকতে তিন আমলের উপদেশ দিয়েছেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাহলো-
১. দান-সাদকা করা
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা সাদকা করো। আর সাদকা দ্বারা রোগীর রোগ চিকিৎসা করো। কেননা, সাদকা রোগ এবং বালা-মুসিবত দূর করে এবং আয়ু (হায়াত) ও নেকি বাড়িয়ে দেয়।’ (বায়হাকি)
হজরত আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সাদকার মাধ্যমে তোমাদের রোগীদের চিকিৎসা করো। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ, আবু দাউদ)
২. ইসতেগফার করা
কোরআন-সুন্নাহ মোতাবেক আল্লাহর কাছে নিজের গোনাহ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করা। বেশি বেশি ‘রাব্বিগফিরলি (رَبِّىْ اغْفِرْلِىْ)’; ‘আসতাগফিরুল্লাহা ওয়া আতুবু ইলাইহি (اَسْتَغْفِرُ الله وَ اَتُوْبُ اِلَيْهِ)’ পড়া। হদিসে পাকে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘যে ব্যক্তি সব সময় ইসতেগফার করতে থাকে, আল্লাহ তাআলা তাকে সংকট (বিপদ-আপদ) থেকে মুক্তির পথ বের করে দেন। যাবতীয় দুঃশ্চিন্তা থেকে মুক্তি ও প্রশান্তি দান করেন আর তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিকের ব্যবস্থা করেন।’ (আবু দাউদ)
মনে রাখতে হবে
মানুষের গোনাহ বেড়ে গেলে তার একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতা বেড়ে যায় এবং মানসিক অশান্তিও তীব্রতর হয়। এই গোনাহ, একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতা মহান আল্লাহর সাহায্য ও ইসতেগফার ছাড়া রোধ করা অসম্ভব।
নিশ্চয়ই দুনিয়ার সব গোনাহ, দুঃশ্চিন্তা, অশান্তি, বিপদ-আপদ ও একাকীত্ব মহান আল্লাহর একটি বাহিনীর মতো। যার মাধ্যমে তিনি তার বান্দাদের পরীক্ষা করে থাকেন।
তাই গোনাহ করলে বেশি বেশি ইসতেগফার করা। মনে অশান্তি দেখা দিলে বেশি বেশি নামাজ পড়া এবং একাকীত্ব অনুভূত হলেই বেশি বেশি কোরআনুল কারিম পড়া। কেননা গোনাহ, অশান্তি ও একাকীত্ব দূর করতে দুনিয়াতে বেশি বেশি ইসতেগফার করা, নামাজ পড়া ও কোরআন তেলাওয়াতের বিকল্প নেই।
৩. দরুদ পড়া
বিপদ-আপদে সঠিকভাবে দরুদ পড়া উত্তম আমল। তাই যে কোনো বিপদে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর বেশি বেশি দরূদ পড়া। ছোট এ দরুদটি পড়া যেতে পারে-
اَللَّهُمَّ صَلِّى وَ سَلِّمْ عَلَى نَبِيِّنَا مُحَمَّد
‘আল্লাহুম্মা সল্লি ওয়া সাল্লিম আলা নাবিয়্যিনা মুহাম্মাদ’
এক সাহাবি নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন- 'আমার পুরো দোয়াই আপনার প্রতি দরুদের জন্য নির্ধারিত করে দেবো।' তখন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তাহলে তোমার (সব) ইচ্ছা/অভিপ্রায় (চাওয়া-পাওয়া) পূরণের জন্য এটাই যথেষ্ট হবে আর তোমার গোনাহ ক্ষমা করা হবে।’ (তিরমিজি, মুসতাদরাকে হাকেম)
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ হাদিসের আলোকে বোঝা যায়, দরুদের বরকতে দুনিয়ার সব বিপদ-আপদ থেকে মহান আল্লাহ মানুষকে মুক্ত রাখবেন।
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, উল্লেখিত তিনটি আমল যথাযথভাবে আদায় করা। তাতে বিপদ-মুসিবত, রোগ-ব্যধি, দুঃশ্চিন্তা-হতাশা-একাকীত্ব ও অশান্তি দূর হয়ে যাবে। ইনশাআল্লাহ।
বিপদ থেকে মুক্তির দোয়া
তাই বিপদে কিংবা সমস্যায় পড়লে মুমিন মুসলমানের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। মহান আল্লাহ তাআলার উপর আস্থা এবং বিশ্বাসের সঙ্গে উল্লেখিত আমলের পাশাপাশি এসব দোয়ার যথাযথ আমলেই সম্ভব বিপদমুক্ত হওয়া। বিপদ ও সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য মুমিনের বিশেষ কার্যকরী দোয়া হচ্ছে-
> সুরা আল-ফাতেহা
الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ - الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ - مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ - إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ - اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ - صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ
এ সুরাটির বিশেষ একাধিক নাম হলো- আল-কাফিয়া বা যথেষ্টকারী, আশ-শাফিয়া বা আরোগ্যকারী। এটি আল্লাহর গুণ-প্রশংসার সুরা হওয়ায় এ সুরার আমলের দ্বারা ঝাঁড়-ফুক করাও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।
> اَللهُ... اللهُ رَبِّىْ لَا اُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا
উচ্চারণ : ‘আল্লাহু… আল্লাহু রাব্বি; লা উশরিকু বিহি শাইআ।’
অর্থ : ‘হে আল্লাহ!... আল্লাহ তুমিই আমার প্রভু। আমি তোমার সঙ্গে কাউকে শরিক করি না।’ (আবু দাউদ)
> لَا اِلَهَ اِلَّا اَنْتَ سُبْحَانَكَ اِنِّى كَنْتُ مِنَ الظَّالِمِيْنَ
উচ্চারণ : ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জ্বলিমিন।’
অর্থ : হে আল্লাহ! তুমি ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই; আমি তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। নিঃসন্দেহে আমি জালিমদের অন্তর্ভুক্ত।’ (তিরমিজি)
> প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-আপদ কিংবা দুশ্চিন্তা ও পেরেশানিতে উত্তীর্ণ হতে তাঁর উম্মতকে এ দোয়া পড়ার জন্য উৎসাহিত করেছেন-
حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيْل – نِعْمَ الْمَوْلِى وَ نِعْمَ النَّصِيْر
উচ্চারণ : হাসবুনাল্লাহু ওয়া নেমাল ওয়াকিল; নেমাল মাওলা ওয়া নেমান নাছির।'
অর্থ : আল্লাহ তাআলাই আমাদের জন্য যথেষ্ট, তিনি কতই না উত্তম কাজ সম্পাদনকারী। আল্লাহ তাআলাই হচ্ছে উত্তম অভিভাবক এবং উত্তম সাহায্যকারী।’
> لَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إلَّا بِالله
উচ্চারণ : ‘লা হাওলা ওয়া লা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ।'
অর্থ : ‘আল্লাহর সাহায্য ব্যতিত কোনো উপায় নেই আর কোনো ক্ষমতাও নেই।’ এ দোয়াটি জান্নাতের গোপন ভাণ্ডারসমূহের একটি। বিপদ ও সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে বহু মানুষ থেকে পরিক্ষীত দোয়াও এটি।
> أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ الَّذِي لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَىُّ الْقَيُّومُ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ - أَستَغْفِرُ اللهَ
উচ্চারণ : ‘আস্তাগফিরুল্লাহ; আস্তাগফিরুল্লাহাল্লাজি লা ইলাহা ইল্লা হুওয়াল হাইয়্যুল কইয়্যুমু ওয়া আতুবু ইলায়হি।'
অর্থ : ‘আমি আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমি ওই আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই, যিনি ছাড়া প্রকৃতপক্ষে কোনো মাবুদ নেই, তিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী এবং তাঁর কাছেই (তাওবাহ করে) ফিরে আসি।'
> لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ الْعَظِيمُ الْحَلِيمُ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ رَبُّ السَّمَوَاتِ، وَرَبُّ الْأَرْضِ، وَرَبُّ الْعَرْشِ الْكَرِيمِ
উচ্চারণ : ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুল আজিমুল হালিম; লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু রাব্বুল আরশিল আজিম; লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু রাব্বুস সামাওয়াতি ওয়া রাব্বুল আরদি ওয়া রাব্বুল আ’রশিল কারিম।’
অর্থ : ‘আল্লাহ্ ব্যতিত সত্য কোনো মাবুদ নেই, তিনি অতি মহান, অতি সহনশীল। আল্লাহ ব্যতিত কোনো সত্য ইলাহ বা উপাস্য নেই, তিনি বিশাল আরশের মালিক। আল্লাহ ব্যতিত সত্য কোনো মাবুদ নেই, তিনি আসমান-জমিনের এবং মহান আরশের মালিক।’ (বুখারি)
> اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ، وَ أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْعَجْزِ وَالْكَسَلِ، وَ أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْبُخْلِ وَالْجُبْنِ، وَ أَعُوذُ بِكَ مِن ضَلَعِ الدَّيْنِ وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাযানি, ওয়া আউজুবিকা মিনাল আজযি ওয়াল কাসালি, ওয়া আউজুবিকা মিনাল বুখলি ওয়াল জুবনি, ওয়া আউজুবিকা মিন দ্বালায়িদ দাইনি ওয়া ক্বাহরির রিজাল।’ (তিরমিজি)
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি আপনার আশ্রয় চাই দুশ্চিন্তা ও দুঃখ থেকে, অপারগতা ও অলসতা থেকে, কৃপণতা ও ভীরুতা থেকে, ঋণের ভার ও মানুষদের দমন-পীড়ন থেকে।’ ((বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি ও মিশকাত)
> হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোনো দুঃখ-কষ্ট বা চিন্তা, অস্থিরতা তথা হতাশাগ্রস্ত হতেন তখন বলতেন-
يَا حَيُّ يَا قَيُّوْمُ بِرَحْمَتِكَ أَسْتَغِيْثُ
উচ্চারণ : ইয়া- হাইয়ু ইয়া- ক্বাইয়ূ-মু বিরাহমাতিকা আস্তাগিছ।
অর্থ : ‘হে চিরঞ্জীব! হে চিরস্থায়ী! আপনার রহমতের মাধ্যমে আপনার নিকটে সাহায্য চাই।’ (তিরমিজি, মুসতাদরেকে হাকেম, মিশকাত)
> হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, বিপদগ্রস্তের দোয়া হচ্ছে-
اَللّهُمَّ رَحْمَتَكَ أَرْجُوْ فَلَاتَكِلْنِىْ اِلَي نَفْسِيْ طَرْفَةَ عَيْنٍ وَ أَصْلِحْ لِيْ شَانِي كُلُّهُ لا اِلَهَ اِلَّا أَنْتَ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা রাহমাতাকা আরঝু ফালা তাকিলনি ইলা নাফসি; ত্বারফাতা আইন; ওয়া আসলিহলি শানি কুল্লুহু; লা ইলাহা ইল্লাহ আনতা। (আবু দাউদ, মিশকাত)
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার দয়া কামনা করি। তুমি আমাকে এক মুহূর্তের জন্যও আমার নিজের হাত ছেড়ে দিও না। বরং তুমি স্বয়ং আমার সমস্ত ব্যাপার ঠিক করে দাও। তুমি ব্যতীত কোনো মা’বুদ নাই।
> اِنَّالِلَّهِ وَ اِنَّا اِلَيْهِ رَاجِعُوْنَ – اَللّهُمَّ اَجِرْنِىْ فِىْ مُصِيْبَتِىْ وَاخْلُفْ لِىْ خَيْرًا مِّنْهَا
উচ্চারণ : ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন; আল্লাহুম্মা আযিরনি ফি মুসিবাতি ওয়াখলুফলি খাইরাম মিনহা। (মুসলিম)
বিপদ ও মুসিবত যত ছোটই হোক বা যত বড়ই হোক সব সময় উল্লেখিত দোয়াগুলো পড়া। মনে রাখতে হবে যদি শরীরে একটি কাঁটাও বিধলেও তাতে এ দোয়া পড়া।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হাদিসে প্রমাণিত আমলগুলো যথাযথভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন। দুনিয়ার সব বিপদ-আপদ, বালা-মুসিবত ও অশান্তি থেকে মুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম