ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ধর্ম

তারাবিহের আলোচনা

মুমিনের হৃদয়ে বইবে আনন্দের বন্যা

ইসলাম ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৬:১৬ পিএম, ১৫ এপ্রিল ২০২৩

অপরাধী সম্প্রদায়ের প্রতি ফেরেশতাদের আগমনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শুরু হবে ১৪৪৪ হিজরির ২৪তম তারাবিহ। আজকের তারাবিহতে সুরা যারিয়াতের ৩১-৬০ আয়াত, সুরা তুর, সুরা নজম, সুরা ক্বামার, সুরা আর-রাহমান, সুরা ওয়াক্বিয়াহ ও সুরা হাদিদ পড়া হবে আজ। সে সঙ্গে ২৭তম পাড়ার তেলাওয়াত শেষ হবে।

বিগত জীবনের গোনাহ মাফের আমল হলো রাতের তারাবিহ নামাজ। ২৪ রোজা প্রস্তুতিতে তারাবিহ পড়বে রোজাদার। আল্লাহ তাআলার অসংখ্য নেয়ামতের বর্ণনায় রোজাদার মুসল্লির হৃদয় বইবে আনন্দের জোয়ার। দুনিয়া ও পরকালের অবিরাম নেয়ামতের বর্ণনা করে আল্লাহ তাআলা বান্দাকে বার বার জিজ্ঞাসা করবে-

فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّکُمَا تُکَذِّبٰنِ

'তুমি তোমার প্রভূর কোন কোন নেয়ামতকে অস্বীকার করবে?

সুরা যারিয়াত: আয়াত ৩১-৬০

মক্কায় অবতীর্ণ সুরাটিতে আল্লাহর একত্ববাদ, নবুয়ত ও হাশরের ঘটনার বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। সুরাটিতে পয়গাম্বর ইবরাহিম, মুসা, নুহ আলাইহিমুস সালামের সময়ের বিবরণ রয়েছে। এ সুরায় সুবিন্যস্ত আকাশ ও পৃথিবী এবং সৃষ্টি জগতের জোড়া জোড়া প্রাণীর বর্ণনা ওঠে এসেছে। হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ফেরেশতাদের কাছে তাদের আগমনের খবর জানতে চান। আল্লাহ তাআলা বলেন-

قَالَ فَمَا خَطۡبُکُمۡ اَیُّهَا الۡمُرۡسَلُوۡنَ  قَالُوۡۤا اِنَّاۤ اُرۡسِلۡنَاۤ اِلٰی قَوۡمٍ مُّجۡرِمِیۡنَ  لِنُرۡسِلَ عَلَیۡهِمۡ حِجَارَۃً مِّنۡ طِیۡنٍ  مُّسَوَّمَۃً عِنۡدَ رَبِّکَ لِلۡمُسۡرِفِیۡنَ

ইবরাহিম বললেন, হে প্রেরিত ফেরেশতাগণ! তোমাদের বিশেষ কাজ কি? তারা বলল, নিশ্চয়ই আমরা এক অপরাধী সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছি। যাতে তাদের উপর নিক্ষেপ করি মাটির শক্ত ঢেলা, যা সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য চিহ্নিত আপনার রবের কাছ থেকে।’ (সুরা যারিয়াত: আয়াত ৩১-৩৪)

অপরাধী সম্প্রদায় বলতে হজরত লুত আলাইহিস সালামের সেই সম্প্রদায়কে বুঝানো হয়েছে, যাদের সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল সমলিঙ্গী ব্যভিচার (পুরুষের পায়ুমৈথুন)। তাদের প্রতি কাঁকর নিক্ষেপ করার কথা এসেছে কোরআনে। নিক্ষেপ করার অর্থ সে কাঁকর দিয়ে তাদেরকে হত্যা করা। এই কাঁকরগুলো না ছিল খাঁটি পাথরের, আর না ছিল শিলাবৃষ্টি। বরং এগুলি ছিল পোড়া মাটির তৈরি।

ফেরেশতারা বলল, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ চিহ্নযুক্ত ছিল অথবা প্রত্যেক কংকরের গায়ে সেই ব্যক্তির নাম লিখিত ছিল, যাকে ধ্বংস করার জন্যে কংকরটি প্রেরিত হয়েছিল। সে যেদিকে পলায়ন করেছে, কংকরও তার পশ্চাদ্ধাবন করেছে।’ (কুরতুবি; ফাতহুল কাদির)

আল্লাহ তাআলা ফেরেশতা প্রেরণ করে অপরাধীদের যখন শাস্তি দিয়েছিলেন তখন তিনি মুসলিম সম্প্রদায়কে আজান থেকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

فَاَخۡرَجۡنَا مَنۡ کَانَ فِیۡهَا مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ  فَمَا وَجَدۡنَا فِیۡهَا غَیۡرَ بَیۡتٍ مِّنَ الۡمُسۡلِمِیۡنَ

সেখানে যারা বিশ্বাসী ছিল, আমি তাদেরকে উদ্ধার করেছিলাম। আর সেখানে একটি (লুতের) ঘর ছাড়া আর কোনো আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) আমি পাইনি। (সুরা যারিয়াত: আয়াত ৩৫-৩৬)

আজাব আসার আগে আমি তাদেরকে সেখান থেকে বের হয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছিলাম; যাতে তারা আজাব থেকে বেঁচে যায়।

আর এই ঘরটি ছিল আল্লাহর নবী লুত আলাইহিস সালামের ঘর। যেখানে তাঁর দুই কন্যা এবং তাঁর উপর ঈমান আনয়নকারী কিছু লোক ছিল। বলা হয় যে, এরা মোট তের জন ছিল। এদের মধ্যে লুত আলাইহিস সালামের স্ত্রী শামিল ছিল না। বরং সে তার ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির অন্তর্ভুক্ত ছিল। (আয়সারুত তাফাসির)

আকাশ-জমিনসহ সৃষ্টির বর্ণনা দিয়ে তারই দিকে ধাবিত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মহান আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-

وَ السَّمَآءَ بَنَیۡنٰهَا بِاَیۡىدٍ وَّ اِنَّا لَمُوۡسِعُوۡنَ  وَ الۡاَرۡضَ فَرَشۡنٰهَا فَنِعۡمَ الۡمٰهِدُوۡنَ وَ مِنۡ کُلِّ شَیۡءٍ خَلَقۡنَا زَوۡجَیۡنِ لَعَلَّکُمۡ تَذَکَّرُوۡنَ   فَفِرُّوۡۤا اِلَی اللّٰهِ ؕ اِنِّیۡ لَکُمۡ مِّنۡهُ نَذِیۡرٌ مُّبِیۡنٌ

'আমি স্বীয় ক্ষমতাবলে আকাশ নির্মাণ করেছি এবং আমি অবশ্যই ব্যাপক ক্ষমতাশালী। আমি ভূমিকে বিছিয়েছি। আমি কত সুন্দরভাবেই না বিছাতে সক্ষম। আমি প্রত্যেক বস্তু জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি, যাতে তোমরা হৃদয়ঙ্গম কর। অতএব, আল্লাহর দিকে ধাবিত হও। আমি তাঁর তরফ থেকে তোমাদের জন্যে সুস্পষ্ট সতর্ককারী।' (সুরা যারিয়াত : আয়াত ৪৭-৫০)

জোড়ায় জোড়ায় সৃজনের নীতির ভিত্তিতে পৃথিবীর সমস্ত বস্তু সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রতিটি উদ্ভিদ ও প্রাণীর সৃষ্টিতে আমরা পুরুষ ও নারী জোড়া জোড়া হিসেবে দেখতে পাই। অনুরূপভাবে প্রতিটি বস্তুরই বিপরীত দিক রয়েছে। যেমন, রাত-দিন, জল-স্থল, সাদা-কালো, আসমান-জমিন, কুফরি-ঈমান, সৌভাগ্য-দুৰ্ভাগ্য ইত্যাদি।’ (কুরতুবি)

প্রতিটি জিনিস জোড়া জোড়া, নর ও নারী করেছি। অথবা ঐ জিনিসের বিপরীত জিনিসও সৃষ্টি করেছি। যেমন, আলো ও আঁধার, জল ও স্থল, চন্দ্র ও সূর্য, মিষ্ট ও তিক্ত, দিন ও রাত, ভালো ও মন্দ, জীবন ও মৃত্যু, ঈমান ও কুফরি, সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য, জান্নাত ও জাহান্নাম, মানব ও দানব ইত্যাদি। এমন কি জীবের বিপরীত জড়পদার্থও এই জন্য জরুরী যে, যাতে দুনিয়ারও জোড়া হয়। অর্থাৎ, দুনিয়ার মোকাবেলায় দ্বিতীয় জীবন আখেরাত। (আহসানুল বয়ান)

সুতরাং তোমরা আল্লাহর দিকে ধাবিত হও। আল্লাহর দিকে ধাবিত হওয়ার উদ্দেশ্য এই যে, তওবা করে গুনাহ থেকে ছুটে পালাও। প্রবৃত্তি ও শয়তান মানুষকে গুনাহের দিকে দাওয়াত ও প্ররোচনা দেয়। তোমরা এগুলো থেকে ছুটে আল্লাহর শরণাপন্ন হও। তিনি তোমাদের এদের অনিষ্ট থেকে বাঁচিয়ে রাখবেন।’ (ফাতহুল কাদির; কুরতুবি)

আল্লাহ তাআলা মানুষের রিজিক দাতা। তিনি মানুষের কাছে কোনো জীবিকা চান না। তিনি চান মানুষ তার ইবাদত-বন্দেগি করুক। আল্লাহ তাআলা কোরআনে এ কথা তুলে ধরেছেন, তিনি কেন মানুষ এবং জ্বিন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন? আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ مَا خَلَقۡتُ الۡجِنَّ وَ الۡاِنۡسَ اِلَّا لِیَعۡبُدُوۡنِ مَاۤ اُرِیۡدُ مِنۡهُمۡ مِّنۡ رِّزۡقٍ وَّ مَاۤ اُرِیۡدُ اَنۡ یُّطۡعِمُوۡنِ  اِنَّ اللّٰهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الۡقُوَّۃِ الۡمَتِیۡنُ

'আমার ইবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের কাছে জীবিকা চাই না এবং এটাও চাই না যে, তারা আমাকে আহার্য যোগাবে। আল্লাহ তাআলাই তো জীবিকাদাতা শক্তির আধার, পরাক্রান্ত।' (সুরা যারিয়াত : আয়াত ৫৬-৫৮)

আর যারা আল্লাহ তাআলা অবাধ্য, তাদের পরিণতি কী হবে? সে সম্পর্কেও আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে সতর্ক করেছেন এভাবে-

فَاِنَّ لِلَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا ذَنُوۡبًا مِّثۡلَ ذَنُوۡبِ اَصۡحٰبِهِمۡ فَلَا یَسۡتَعۡجِلُوۡنِ  فَوَیۡلٌ لِّلَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا مِنۡ یَّوۡمِهِمُ الَّذِیۡ یُوۡعَدُوۡنَ

‘সুতরাং যারা জুলুম করেছে তাদের জন্য রয়েছে তাদের সমমতাবলম্বীদের অনুরূপ প্রাপ্য (শাস্তি)। কাজেই তারা এটার জন্য আমার কাছে যেন তাড়াহুড়ো না করে। অতএব, যারা কুফরী করেছে তাদের জন্য দুর্ভোগ সে দিনের, যে দিনের বিষয়ে তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে।’ (সুরা যারিয়াত আয়াত ৫৯-৬০)

সুরা তুর : আয়াত ৪৯

সুরা তুর মক্কায় নাজিল হয়। এ সুরায় পরকালীন জীবনের সত্যতা, সত্যত্যাগীদের প্রতি কঠোর হুশিয়ারি এবং পরকালীন জীবনে সত্যের অনুসারীদের পুরস্কারের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আর তাতে তাওহিদ রেসালাত ও পরকালের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ওঠে এসেছে।

সুরাটির শুরুতে বেশ কিছু জিনিসের কসম করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তুর পাহাড়, আসমানি কিতাব, প্রশস্ত পত্র, বায়তুল মামুর, সমুন্নত ছাদ (আসমান) এবং উত্তাল সমুদ্রের। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ الطُّوۡرِ  وَ کِتٰبٍ مَّسۡطُوۡرٍ  فِیۡ رَقٍّ مَّنۡشُوۡرٍ  وَّ الۡبَیۡتِ الۡمَعۡمُوۡرِ  وَ السَّقۡفِ الۡمَرۡفُوۡعِ  وَ الۡبَحۡرِ الۡمَسۡجُوۡرِ

‘শপথ তুর পর্বতের, শপথ কিতাবের, যা লিখিত আছে উন্মুক্ত পাতায়; শপথ বায়তুল মামুরের, শপথ সমুন্নত ছাদের, শপথ উদ্বেলিত সাগরের।’  (সুরা তুর : আয়াত ১-৬)

সেই পাহাড়, যেখানে মুসা আলাইহিস সালাম মহান আল্লাহর সঙ্গে বাক্যালাপ করেছিলেন। এই পাহাড়টিকে তুরে সাইনা’ও বলা হয়। তার এই বিশেষ মর্যাদার কারণে মহান আল্লাহ তার কসম খেয়েছেন। তুরের কসম খাওয়ার দ্বারা মহান আল্লাহ এ পাহাড়টিকে সম্মানিত করেছেন।

লিখিত কিতাব বলে মানুষের আমলনামা বোঝানো হয়েছে, না হয় কোন কোন তফসীরবিদের মতে পবিত্র কুরআন বোঝানো হয়েছে। আবার কারো কারো মতে এর দ্বারা লাওহে মাহফুজই বুঝানো হয়েছে। কারো কারো মতে এর দ্বারা সকল আসমানী কিতাবকে বোঝানো হয়েছে।’ (ফাতহুল কাদির)

আকাশস্থিত ফেরেশতাদের কাবাকে বায়তুল মামুর বলা হয়। এটা দুনিয়ার কাবার ঠিক উপরে অবস্থিত। হাদিসে আছে যে, মেরাজের রাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বায়তুল মামুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এতে প্রত্যহ সত্তর হাজার ফেরেশতা ইবাদতের জন্যে প্রবেশ করে। এরপর তাদের পুনরায় এতে প্রবেশ করার পালা আসে না। প্রত্যহ নতুন ফেরেশতাদের নম্বর আসে।’ (বুখারি ৩২০৭, মুসলিম ১৬২)

সপ্তম আসমানে বসবাসকারী ফেরেশতাদের কাবা হচ্ছে বায়তুল মামুর। এ কারণেই মেরাজের রাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এখানে পৌঁছে ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে বায়তুল মামুরের প্রাচীরে হেলান দিয়ে উপবিষ্ট অবস্থায় দেখতে পান। (বুখারি ৩২০৭)

তিনি ছিলেন দুনিয়ার কাবার প্রতিষ্ঠাতা। আল্লাহ তাআলা এর প্রতিদানে আকাশের কাবার সঙ্গেও তাঁর বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করে দেন। প্রতি আসমানেই ফেরেশতাদের জন্য একটি ইবাদতঘর রয়েছে। প্রথম আসমানের ইবাদতঘরের নাম ‘বাইতুল ইযযত’৷ (ইবনে কাসির)

সমুন্নত ছাদ বা উঁচু ছাদ অর্থ আসমান, যা পৃথিবীকে একটি গম্বুজের মত আচ্ছাদিত করে আছে বলে মনে হয়।  এ থেকে আকাশ বুঝানো হয়েছে যা পৃথিবীর জন্য ছাদস্বরূপ। কোরআনের অন্যত্র এটাকে ‘সুরক্ষিত ছাদ’ বলা হয়েছে। وَجَعَلْنَا السَّمَآءَ سَقْفًا مَّحْفُوْظًا وَهُمْ عَنْ آيَتِهَا مُعْرِصُوْنَ কেউ কেউ এ থেকে আরশ বুঝিয়েছেন। যা সমস্ত সৃষ্টিকুলের জন্য ছাদ।

সমুদ্রকে আটকিয়ে বা থামিয়ে রাখা হয়েছে যাতে তার পানি মাটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে হারিয়ে না যায় এবং স্থলভাগকে প্লাবিত করে না ফেলে এবং পৃথিবীর সব অধিবাসী তাতে ডুবে না মরে। অথবা জলভাগকে স্থলভাগ গ্রাস করতে বাধা দিয়ে রাখা হয়েছে নতুবা তা অনেক আগেই গ্ৰাস করে ফেলত। কেউ কেউ একে মিশ্ৰিত অর্থে গ্রহণ করে থাকেন। অর্থাৎ এর মধ্যে মিঠা ও লবণাক্ত পানি এবং গরম ও ঠান্ডা সব রকম পানি এসে মিশ্রিত হয়। আর কেউ কেউ একে কানায় কানায় ভরা ও তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ অর্থে গ্রহণ করেন।

এ সুরায় অবিশ্বাসীদের কঠিন পরিণতির কথা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আবার জান্নাতীদের জন্য তুলে ধরা হয়েছেন অবিরাম নেয়ামতের বর্ণনা। জান্নাতের তাদের পরিবেশ করা হবে অনেক নেয়ামত।

এ সুরার শেষাংশে আল্লাহ তাআলা তার প্রিয় বন্ধু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তার শেষ রাতে তার তাসবিহ পড়ার নির্দেশ দেন। যা মুমিন মুসলমানদের জন্য নসিহত ও শিক্ষা। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ اصۡبِرۡ لِحُکۡمِ رَبِّکَ فَاِنَّکَ بِاَعۡیُنِنَا وَ سَبِّحۡ بِحَمۡدِ رَبِّکَ حِیۡنَ تَقُوۡمُ  وَ مِنَ الَّیۡلِ فَسَبِّحۡهُ وَ اِدۡبَارَ النُّجُوۡمِ

'আপনি আপনার পালনকর্তার নির্দেশের অপেক্ষায় সবর করুন। আপনি আমার দৃষ্টির সামনে আছেন এবং আপনি আপনার পালনকর্তার সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করুন যখন আপনি গাত্রোত্থান করেন। এবং রাত্রির কিছু অংশে এবং তারকা অস্তমিত হওয়ার সময় তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করুন।' (সুরা তুর : আয়াত ৪৮-৪৯)

শক্ৰদের শক্রতা-বিরোধিতার পরিপ্রেক্ষিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে সুরার উপসংহারে প্রথমে বলা হয়েছে যে, আপনি আমার দৃষ্টিতে আছেন। অর্থাৎ আল্লাহর চোখ আপনার হেফাজতে আছে। আপনাকে তিনি তাদের প্রত্যেক অনিষ্ট থেকে বাঁচিয়ে রাখবেন। অন্য এক আয়াতে আছে (وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ) ‘আল্লাহ তাআলঅ মানুষের অনিষ্ট থেকে আপনার হেফাজত করবেন।’ (সুরা আল-মায়েদা: আয়াত ৬৭)

এরপর আল্লাহ তাআলার সপ্ৰশংস পবিত্ৰতা ঘোষণায় আত্মনিয়োগ করার আদেশ দেয়া হয়েছে, যা মানবজীবনের আসল লক্ষ্য এবং প্রত্যেক বিপদ থেকে বেঁচে থাকার প্ৰতিকারও। বলা হয়েছে, আল্লাহর সপ্ৰশংস পবিত্ৰতা ঘোষণা করুন যখন আপনি দণ্ডায়মান হন। আপনি যখনই কোন মজলিস থেকে উঠবেন আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবীহ করে উঠবেন।

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও এ নির্দেশ পালন করতেন এবং মুসলিমদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে তারা যেন কোন মজলিস থেকে উঠার সময় আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবিহ পাঠ করে। এভাবে সেই মজলিসে যেসব কথাবার্তা হয়েছে তার কাফফারা হয়ে যায়। হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি কোনো মজলিসে বসল এবং সেখানে অনেক বাকবিতণ্ডা করল সে যদি উঠে যাওয়ার সময় বলে-

سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ، أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ، أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْكَ

‘হে আল্লাহ! আমি আপনার প্রশংসাসহ তাসবিহ পাঠ করছি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি ছাড়া কোনো হক্ক মাবুদ নেই। আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাই এবং আপনার কাছে তওবা করছি।’ (তিরমিজি ৩৪৩৩, মুসনাদে আহমাদ ২/৪৯৪)

হজরত আতা ইবনে আবি রাবাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, তুমি যখন মজলিস থেকে ওঠ, তখন তাসবিহ ও তাহমিদ পাঠ কর। তুমি এই মজলিসে কোনো সৎকাজ করে থাকলে তার পুণ্য অনেক বেড়ে যাবে। পক্ষান্তরে কোনো পাপ কাজ করে থাকলে এই বাক্য তার কাফফারা হয়ে যাবে।

দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, যখন তোমরা ঘুম থেকে জেগে বিছানা ছাড়বে তখন তাসবিহসহ তোমার রবের প্রশংসা কর। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটিও নিজে আমল করতেন এবং ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর একথাগুলো বলার জন্য সাহাবীদের শিক্ষা দিয়েছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি রাতে জাগ্রত হয়ে এই বাক্যগুলো পাঠ করে, সে যে, দোয়াই করে, তা-ই কবুল হয়। বাক্যগুলো হলো-

لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ، وَلَهُ الْحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ  سُبْحَانَ اللَّهِ ، وَالْحَمْدُ لِلَّهِ ، وَلا إِلَهَ إِلا اللَّهُ ، وَاللَّهُ أَكْبَرُ وَلا حَوْلَ وَلا قُوَّةَ إِلا بِاللَّهِ

‘একমাত্র লা-শরিক আল্লাহ ছাড়া হক কোনো ইলাহ নেই, তাঁর জন্যই যাবতীয় রাজত্ব, তাঁরই জন্য যাবতীয় প্রশংসা। আর তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। পবিত্র ও মহান আল্লাহ, সমস্ত প্ৰশংসা আল্লাহরই, তিনি ছাড়া আর কোনো হক ইলাহ নেই, এবং তিনিই মহান। আর আল্লাহ ছাড়া কোনো বাঁচার পথ নেই, কোনো শক্তিও নেই’

তারপর বলল, হে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিন, অথবা দোয়া করল, তার দোয়া কবুল করা হবে। তারপর যদি সে অজু করে নামাজ পড়ে, তবে তার নামাজ কবুল করা হবে।’ (বুখারি ১১৫৪)

তৃতীয় অর্থ হচ্ছে, আপনি যখন নামাজের জন্য দাঁড়াবেন তখন আল্লাহর হামদ ও তাসবিহ দ্বারা তার সূচনা করুন। এ হুকুম পালনের জন্য নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, তাকবিরে তাহরিমার পর নামাজ শুরু করবে এ কথা বলে-

سُبْحَانَكَ اللهُمَّ وَبِحَمْدِكَ، تَبَارَكَ اسْمُكَ، وَتَعَالَى جَدُّكَ، وَلَا إِلَهَ غَيْرُكَ (মুসলিম: ৩৯৯)

চতুর্থ অর্থ হচ্ছে, যখন আপনি আল্লাহর পথে আহবান জানানোর জন্য প্রস্তুত হবেন তখন আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবিহ দ্বারা তার সূচনা করুন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ নির্দেশটিও স্থায়ীভাবে পালন করতেন। তিনি সবসময় আল্লাহর প্রশংসা দ্বারা তার খুতবা শুরু করতেন। তাফসির বিশারদ ইবনে জারীর রাহিমাহুল্লা আরও একটি অর্থ বর্ণনা করেছেন। সে অর্থটি হচ্ছে, আপনি যখন দুপুরের আরামের পর উঠবেন তখন নামাজ পড়বেন। অর্থাৎ জোহরের নামাজ। (কুরতু্বি)

সুরা নজম : আয়াত ৬২

মক্কায় অবতীর্ণ সুরা নজমে আল্লাহ তাআলা বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়ত ও রেসালাত এবং কোরআনের সত্যতার প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রত্যেকটি কথাকে যে মানবজাতির জন্য অনুসরণীয় তাও ঘোষণা করা হয়েছে। বিশেষ করে বিশ্বনবির পবিত্র জবান থেকে যা বের হয় তা শুধু আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ ওহি।

এ সুরার আলোচ্য বিষয় হলো- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সত্য নবি হওয়া এবং তাঁর প্রতি অবতীর্ণ ওহিতে সন্দেহ ও সংশয়ের অবকাশ না থাকার কথা বর্ণিত হয়েছে। এরপর মুশরিকদের নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়েছে।

সুরা ক্বামার : আয়াত ৫৫

মক্কায় অবতীর্ণ এ সুরাটিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি বিশেষ মুযেজার উল্লেখ রয়েছে। যা বিশ্বনবির নবুয়তের দলিল হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। সুরা ক্বামারের আলোচিত বিষয়গুলো হলো- ক্বিয়ামাত নিকটবর্তী হওয়ার ঘোষণা; তাওহিদ এবং রেসালাতের দলিল প্রমাণ উল্লেখ, ঈমান এবং নেক আমলের জন্য পুরস্কারের প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি আল্লাহর নাফরমানির শাস্তি সম্পর্কেও সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে।

সুরাটিতে কোরআন বুঝার আহ্বান জানানো হয়েছে। আর একাধিকবার এ কথাও বলা হয়েছে যে, কোরআন বুঝা সহজ। আল্লাহ বলেন-

وَ لَقَدۡ یَسَّرۡنَا الۡقُرۡاٰنَ لِلذِّکۡرِ فَهَلۡ مِنۡ مُّدَّکِرٍ

'আমি কোরআনকে বুঝার জন্যে সহজ করে দিয়েছি। অতএব, কোনো চিন্তাশীল আছে কি?' (সুরা ক্বামার : আয়াত ৪০)

বিশেষ করে ইসলাম পূর্ববর্তী যুগে যারা এ পৃথিবীতে আল্লাহর নাফরমানি করেছে- আদ-সামুদ জাতি, হজরত লুত আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়, ফেরাউনের দলবলসহ তাদেরকে কিভাবে ধ্বংস করা হয়েছে এ সকল বর্ণনা ওঠে এসেছে এ সুরায়।

সুরা রাহমান : আয়াত ৭৮

মাদিনায় অবতীর্ণ শ্রুতিমধূর ও ব্যাপক পরিচিত ও তিলাওয়াতকৃত সুরা আর রহমানে দুনিয়া ও আখিরাতের আল্লাহর অনন্ত অসীম নিয়ামাতের বর্ণনা করা হয়েছে। এ সুরার মূল বক্তব্য হলো-

>> বিশ্বলোকের গোটা ব্যবস্থাপনা এক আল্লাহর ছাড়া আর কারো কতৃত্ব নেই;

>> গোটা বিশ্বলোকের ব্যবস্থাপনা পূর্ণ ভারসাম্যের সঙ্গে ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কোনোভাবে এ ভারসাম্য বিনষ্ট হবে না;

>> আল্লাহ তাআলার কুদরত ও বিস্ময়কর কার্যকলাপের কথা বলার সঙ্গে মানব-দানবরা আল্লাহর যে নিয়ামাত ভোগ করছে, তার দিকেও ইঙ্গিত করা হয়েছে;

>> মানুষ ও জিন জাতিকে তার কর্মের হিসাবের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। এ সুরায় পৃথিবীর নাফরমান মানুষ ও জিনের মর্মান্তিক পরিণতির কথা বলা উল্লেখ করা হয়েছে।

>> মানব ও দানবদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে, পরকালকে ভয় করেছে, তাদেরকে প্রদেয় নিয়ামাতের বিস্তারিত বিবরণ পেশ করা হয়েছে এ সুরায়।

সুরা ওয়াক্বিয়া : আয়াত ৯৬

সুরাটি মক্কায় অবতীর্ণ। আল্লাহ তাআলার অনন্ত অসীম শক্তি ও অপূর্ব মহিমার বিস্তারিত বিবরণ স্থান পেয়েছে সুরা ওয়াক্বিয়ায়। বিশেষ করে পরকালে মানুষের সমগ্র জীবনের কর্মকাণ্ডের পরিণতি অবশ্যই ভোগ করতে হবে।

জন্মের ন্যায় মৃত্যু যেমন সত্য, ঠিক মৃত্যুর ন্যায় পরকাল, হাশরের ময়দানে পুনরুত্থানও সত্য। যার বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে এ সুরায়। সর্বোপরি এ সুরার শেষে আখিরাতের আলোচনা বর্ণনা করা হয়েছে।

সুরা হাদিদ : আয়াত ২৯

মদিনায় অবতীর্ণ সুরা হাদিদে ইসলামি শরিয়তের বুনিয়াদি বিধি-নিষেধ এবং মৌলিক আক্বিদা তথা তাওহিদ সম্পর্কে হিদায়াত রয়েছে এবং উত্তম চরিত্র অর্জনে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এ সুরার মূল বক্তব্য হলো-

- বিশ্বজগৎ এক আল্লাহর সৃষ্টি, তিনি ভূ-মণ্ডল ও নভোমণ্ডল সব কিছুর একচ্ছত্র অধিপতি। সবকিছুই তার কর্তৃত্বাধীন। তাঁর কর্তৃত্বের কোনো কিছুতেই শরিক নেই।

- সত্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য; আল্লাহর দ্বীনকে কায়েম করার জন্য মানুষের কর্তব্য হলো- আত্মত্যাগের পরিচয় দেয়া।

- দুনিয়ার ধন-সম্পদ, সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্য নিতান্ত ক্ষণস্থায়ী বিষয়। দুনিয়ার এ ক্ষণস্থায়ী জীবনকে পরকালীন চিরস্থায়ী জীবনের সম্বল সংগ্রহে ব্যয় করাই কল্যাণকামী মানুষের কর্তব্য।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআনের এ গুরুত্বপূর্ণ সুরাগুলো বুঝে পড়ার এবং তাঁর ওপর আমল করার পাশাপাশি নিজেদের আকিদা-বিশ্বাসকে শিরকমুক্ত রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএমএস/জেআইএম

আরও পড়ুন